দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হাইকোর্টের পরামর্শের রায় চেম্বারে স্থগিত
স্টাফ রিপোর্টার: ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আওতাভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি দুর্নীতিমুক্ত হলে বাংলাদেশ পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য বলে পরামর্শ দেওয়া হাইকোর্টের রায় আগামী ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। আগামী ২৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
হাইকোর্টের রায় স্থগিতের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গত রোববার আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার জজ আদালত এই আদেশ দেন।
আদালতে এদিন দুদকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান। আর রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন।
এর আগে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের (রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রম) আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হন, তাহলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয় বলে হাইকোর্ট তার এক রায়ে তুলে ধরেন।
রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আওতাভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি দুর্নীতিমুক্ত হলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য।
‘মো. কামরুজ্জামান সরকার বনাম রাষ্ট্র ও অন্য’ শীর্ষক পৃথক ফৌজদারি আপিলের ওপর দেওয়া রায়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ এমন মতামত তুলে ধরেছেন। সর্বমোট ৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি ৮ নবেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
ঘুস গ্রহণের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় তিতাস গ্যাসের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান সরকার ও টেকনিশিয়ান আবদুর রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর জেল-জরিমানার রায় দেন বিচারিক (নিম্ন) আদালত। রায়ে উভয়কে পাঁচ বছর করে কারাদ- ও ২৫ হাজার টাকা করে অর্থদ- দেওয়া হয়। তারা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর হাইকোর্টে পৃথক আপিল আবেদন করেন। পৃথক আপিল মঞ্জুর করে তাদের দ-াদেশ বাতিল করে ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।
হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দুদকের জন্য একটা স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন করাসহ জাতীয় সংসদকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।
রায়ে জাতীয় সংসদের প্রতি হাইকোর্ট বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, জাতীয় সংসদ পরামর্শগুলো গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশ আগামী ১০ বছরের মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
পরামর্শে হাইকোর্ট বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় যে প্রতিষ্ঠানের (বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন) মাধ্যমে অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, একই প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুদকের কর্মকর্তা নিয়োগ করা। দুদকের অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও পৃথক, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড গঠন করা। দুদকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পাওয়ার পর যোগদানের সময় সম্পদের বিবরণ দাখিল করা।
প্রতি বছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পত্তির হিসাব জনসমক্ষে বা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। অপর এক পরামর্শে বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে দুদকের চেয়ারম্যান, হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে থেকে দুদকের সদস্য নির্বাচন করা।
রায়ে আরেক পরামর্শে বলা হয়, সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের জন্য দুদকের পৃথক প্রসিকিউশন প্যানেল গঠন করা। প্রতি তিন বছর পরপর প্যানেল পুনর্গঠন করা। প্রসিকিউশন প্যানেলে আইনজীবী মনোনয়নের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বোর্ড গঠন করা। প্রসিকিউশন প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত আইনজীবীদের জন্য যুগোপযোগী সম্মানিসহ অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা করা।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে ই-মেইলে পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলকে (সুপ্রিম কোর্টের) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি অবগতি, পর্যালোচনার জন্য এই রায় ও আদেশের অনুলিপি জাতীয় সংসদের সব সংসদ সদস্যকে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠাতে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অবগতি-পর্যালোচনার জন্য এই রায় ও আদেশের অনুলিপি অধস্তন আদালতের সব বিচারককে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠাতেও রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ রয়েছেন আদালত। আদালত বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য নির্ধারিত পদসমূহে কমিশনের বাইরের কোনো কর্মকর্তাকে পদায়ন না করা।
বলা হয়েছে, দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধানের বিষয় ও ফলাফল মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ¥াসিক ও বাৎসরিক পর্যায়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। তাছাড়া দুর্নীতিবাজ কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের ফলাফল কিংবা তার সম্পত্তির তালিকা বাধ্যতামূলকভাবে কমিশন কর্তৃক জনগণকে অবহিত করা। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওয়েবসাইটে ধারাবাহিকভাবে এ সব তথ্য প্রকাশ করা।
রায়ে বলা হয়, যেকোনো তথ্যের জন্য কোনো ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে বিধি মোতাবেক দরখাস্ত আনয়ন করলে তাকে দরখাস্ত প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে ফলাফল অবহিত করা। সেক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে মনযোগী হওয়া।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৭ (ক) ধারার আওতা ও পরিধি বৃদ্ধি করা এবং ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ১৯৮৬ (জুলাই, ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত)-এ বর্ণিত ১ থেকে ২৫ নং টেবিলে বর্ণিত (সাংবিধানিক দায়মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত) ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে তফসিল বর্ণিত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা’ সংক্রান্ত বিধান সংযুক্ত করা। দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিটি অনুসন্ধান এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করা।