বৃহস্পতিবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Online Edition

কেরামতি 

মোহাম্মদ লিয়াকত আলী 

কেরামত আলী মানুষটা একেবারে হাবা-গোবা, বোকা-সোকা। সংসােেরর কোন কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না।

 ছোট খাটো কোন কাজ দিয়েও ভরসা পায়না বুদ্ধিমতি স্ত্রী। দৈনন্দিন বাজার করা বড় কাজ না হলেও একেবারে ছোট না। মাঝে মাঝে বাজারে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখে, মানুষটার কোন উন্নতি হলো কিনা। 

 মাছ গোস্তের দাম অনেক। দেখে শুনে কিনতে হয়। নইলে পস্তাতে হয়।

  তাই এরকম ব্যয়বহুল কেনাকাটায় নিজেও সাথে যায়। স্বামীকে বলে : -দেখে শেখো, কিভাবে বাজার করতে হয়? এভাবেই চলে কেরামত আলীর সংসার। স্ত্রী চেষ্টা করে মেরামত করার। কিন্তু ফলাফল তেমন দৃশ্যমান নয়। যেই লাউ সেই কদু। তবু চেষ্টা চালিয়ে যায় স্ত্রী। বাজারের ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে :

-যাও, কিছু শাক-সবজি নিয়ে আসো। দেখি কেমন মুরুদ।  কোন কথা না বলেই বাজারে ছুটে কেরামত আলী। টিপে টিপে দামদর করে বাজার করে।

  আলুর দাম যেভাবে বাড়ছে, নতুন আলু না আসা পর্যন্ত কোথায় যেয়ে ঠেকে, আল্লাহই জানে।

  পাঁচ কেজি আলু কিনে ব্যাগে ভরে। তারপর ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, বেগুন, শাকের আঁটি দিয়ে ব্যাগ ভরে।

  এবার ফিরার পালা। ব্যাগটা কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে । হাঁটে আর ভাবে :

-আজ কোন দোষ খুঁজে পাবে না গিন্নি। ব্যাগ ভরা সলিড মাল।  কিন্তু ব্যাগটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে। ডানে তাকিয়ে দেখে, একলোক মোবাইলে ছবি তুলছে।  ঘরে ঢুকতেই গিন্নি হাত বাড়িয়ে ব্যাগ ধরে। 

ফ্লোরে ঢেলে বাজারের মান যাচাই করে। 

-না, মিনষে কিছু শিখেছে। ভালোই বাজার করেছে।

 কিন্তু কেরামত আলী হতবাক। আলু নেই। পাঁচ কেজি আলু গায়েব। জিন-ভুতের কাজ নাকি? 

  কেরামত আলী শুনেছে, তাজা মাছের লেজ মেছো ভুতের খাদ্য। ভুতপ্রেত আলু খায়, এমন খবর বাপ-দাদার জন্মেও শুনেনি।

 টেবিলের উপরে রাখা মোবাইলটা বাজছে। রিসিভ বাটন টাচ করতেই প্রতিবেশী মতিউরের কন্ঠ :

-কনগ্রাচুলেশন কেরামত, একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস। কে শিখিয়েছে এমন প্রতিবাদের ভাষা? সাংবাদিকরা ছুটে আসছে তোর বাড়িতে। ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য রেডি হ। টিভি অন কর। লাইভ  প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। 

  কিছুই ঢুকে না কেরামত আলীর মাথায়। গিন্নী রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। হাঁক দেয় কেরামত। 

:আমি পাগল হয়ে গেলাম। জিন ভুত ধেয়ে আসছে। 

  দৌড়ে আসে গিন্নী। স্বামী বেচারা চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে। -হোয়াট হ্যাপেন্ড? এমন করছো কেন?

-টিভি অন কর। কুইক। ভয়ে ভয়ে রিমোর্ট টিপে টিভি চালায় মিসেস কেরামত। অবাক করা দৃশ্য। রাস্তায় আলু ছড়িয়ে আছে। ভাস্যকার মাইক্রোফোনে বলছে :

-সম্মানিত দর্শক-শ্রোতা। আপনারা দেখছেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে একজন ভুক্তভোগীর অভিনব প্রতিবাদ।

  প্রতিবাদী কেরামত আলী রাস্তায় নেই। রাস্তায় পড়ে আছে তার ছড়ানো ছিটানো আলু। রাস্তার দুই পাশে শতশত মানুষ হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে কেরামত আলীকে:

-কেরামত ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে। আলুর দাম বাড়লো কেন, জবাব চাই, দিতে হবে। ছুটে আসছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। বাড়ছে কৌতূহলী জনতার ভিড়।

  পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসছে পুলিশ বাহিনী। 

 আবার মাইক্রোফোন নিয়ে ভাস্যকার:

-সম্মানিত দর্শক শ্রোতা। আমাদের সাথেই থাকুন। দেখুন প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া।

  জনস্রোত বয়ে যাচ্ছে কেরামত আলীর বাড়ির দিকে। বাঁশি বাজিয়ে লাঠি হাতে দাঙ্গা পুলিশ চেষ্টা করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের।

   গিন্নী শুধায়:

-বাজারে যেয়ে কি করে এসেছো?

-মানুষ যা করে, আমিও তাই করেছি। বাজার করেছি। এখন কেস্টা বেটাই চোর।

  -কিন্তু আমার চিন্তা একটাই। আলু কেন রাস্তায়? ওয়েট, ওয়ান মিনিট। ক্লু একটা পেয়ে গেছি। বাজারের ব্যাগটা চেকিং করা দরকার। 

  ব্যাগের তলায় একটা ফুটা। তলাবিহীন রুটির ঝুড়ির কথা এখন কেউ বলে না। স্বামীকে দেখিয়ে বলে :

-বাজারে যাওয়ার আগে ব্যাগ ভালো করে দেখে নাওনি? 

-পকেট দেখে নিয়েছি, টাকা আছে কিনা। ব্যাগ দেখার কি আছে?  -এই দেখো, তলায় ফুটা। নিশ্চয়ই ইঁদুরের কাজ। -ইঁদুরেরও ভেরাইটি আছে। বাত্তি ইঁন্দুর সাইজে ছোট। কিন্তু জ্বালায় বেশি। ফুরুত করে যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে।  ইঁদুর নিয়ে গবেষণা থেমে যায় বাইরের শোরগোলে। কেরামত ভাই, কেরামত ভাই, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।  কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দেয় মিসেস কেরামত আলী। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে কয়েকজন সাংবাদিক।  -এবার মিডিয়ার সামনে কিছু বলুন। -আমার বলার কিছু নেই। যা বলার, আপনারাই বলুন।   নীরব প্রতিবাদী নীরবই থাকতে চান।

ঠেলে ঠুলে ভিতরে ঢুকে কয়েকজন পুলিশ। হ্যান্ডশেক করে একজন বলেন :

-আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। 

-বিশ্বাস করুন, আমার কোন দোষ নেই স্যার।

-আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনাকে এরেস্ট করা হবে না। ডিসি সাহেব আপনাকে ডেকেছেন। কথা বলবেন। কেরামত আলীকে নিয়ে চলে যায় পুলিশ বাহিনী। পিছনে ছুটে সাংবাদিক বাহিনী। সরে পড়ে সাধারণ মানুষ। দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকে মিসেস কেরামত।  কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনি পেরিয়ে ডিসি সাহেবের রুমে ঢুকে কেরামত আলী। 

-ওয়েলকাম মিস্টার কেরামত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আপনাকে সুস্বাগতম। আপনার শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমরা মুগ্ধ। হরতাল অবরোধে না যেয়ে এই অভিনব কৌশল অবলম্বন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা পারছি না। সব কিছু সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে। আপনাদের মতো মানুষের সহযোগিতা পেলে আমরা সফল হতে পারবো ইনশাআল্লাহ। 

  টিভিতে এজাতীয় বক্তৃতা শুনে শুনে কেরামত আলীর কান ঝালাপালা। কিন্তু এখন ভালোই লাগছে। 

নিজের প্রশংসা শুনতে সবাই পছন্দ করে। 

  ঘরে বাইরে নিন্দা শুনে শুনে অভ্যস্ত কেরামত আলী আজ প্রশংসা পাচ্ছে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। 

  ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরে কেরামত। চেহারা দেখেই বুঝতে পারে বুদ্ধিমতি স্ত্রী, স্বামী তার বিশ্বকাপ জয় করে এসেছে। 

-কেমন খেলে পুলিশের রিমান্ড। 

-জবাব নাই। একেবারে পান্তা ভাতে ঘি।

- কেমন করে এমন হলো? 

-শুনেছি ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখালো নেংটি ইঁদুরের কেরামতি।  

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ

string(11) "18.97.9.175"