রবিবার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান

আব্বা বসে আছেন বারান্দায় তার প্রিয় ইজি চেয়ারে। পাশে হুক্কা, নলওয়ালা। টানছেন ধীরে ধীরে। হুক্কার কলকি থেকে উড়ছে ধোঁয়া। একটা সুগন্ধি বাতাসে। এমন দৃশ্য রোজকার। বন্ধু-বান্ধবরা আসেন। আড্ডা জমে। আসরের নামাজ শেষ করে মাগরিবের আগ পর্যন্ত এখানেই কাটে সময়। সিঁড়িতে পা ফেলতেই আড়চোখে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন এতো দেরি! আমি মাথা নিচু করে থাকলাম। এ সময় আম্মা এসে হাজির। হাতে চা ভর্তি কাপ। তিনিও জিজ্ঞাসার নজরে তাকালেন, জড়ো হচ্ছে রক্তজবা পশ্চিম আকাশে। হিম হিম বাতাস যেনো উড়াল পাখি। মাঠ ভর্তি শীতের চাদর। শুয়ে আছে হাত পা এলিয়ে। দূরে গেইটে উলফত দারোয়ান। দালানের তিন পাশে বিশাল ময়দান। এক দেড়শ ফিট তো হবেই। গেইট থেকে বাসা। এখানে একটি মাত্র দালান। তাই তিন পাশ শুনসান। ঝিম মেরে ছিলাম। কি বলবো ভাবছিলাম। তাকালেন আব্বা। চোখে শক্ত জিজ্ঞাসা। মাঝবরাবর দাঁড়ালেন আম্মা। ছেলেটার পেটে দানাপানি পড়েনি এখনো। ঘরে যাও হাতমুখে পানি ঢালো। তারপর খাবার টেবিলে বসো। স্কুল টিস্কুল নিয়ে কথা পরে হবে। সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তাই আম্মাকে আড়াল করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। ভয় পিছনে লেগেই থাকলো। মাগরিব শেষে আবার ডাকলেন। এরি মধ্যে আম্মার নামাজও শেষ। কোথায় ছিলে এতো সময়? লাইব্রেরিতে, বললাম নিচু গলায়। পরীক্ষার আগে লাইব্রেরিতে কেন? বইটই হারিয়ে ফেলেছো নাকি। না, বই-টই হারাইনি। বই পড়তে গিয়েছিলাম। সেখানে বিশাল লাইব্রেরি। পছন্দসই বই নিয়ে পছন্দসই টেবিলে বসে পাঠ করা যায়। সারি সারি টেবিল চেয়ার। অনেক পাঠক। হৈচৈ নাই। ও বুঝেছি, পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলে? আব্বা হাসলেন। আবার কিছুটা রাগও করলেন। মাহাতাব চাচা বললেন পাবলিক লাইব্রেরিতে যাও ভালো কথা। তবে পরীক্ষাটা শেষ হোক তারপর। ওখানকার বই ঘাটলে পরীক্ষার পড়ায় মনোযোগ দিবে কখন। পরীক্ষাতো দরজায় টোকা দিচ্ছে। তাও আবার ফাইনাল। আব্বাও ফাইনাল কথা জানিয়ে দিলেন। পরীক্ষার আগে লাইব্রেরি টাইব্রেরি সব পকেটে রাখো। লীনুকে জানিয়ে দিলাম পরীক্ষার আগে আর ঐ পথে হাঁটা হচ্ছে না। খেজুর কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন আব্বা। পাবলিক লাইব্রেরিতে পথ বরাবর। পরীক্ষার আয়োজন চলছে স্কুল জুড়ে। এখন বিষয় কেবল পরীক্ষা। কি ছাত্র কি স্যার। ফাইনালের আগে আগে বুক ধরফর অনেকেরই। চোখে বসে থাকে ভয়ের কাঠফড়িং। অবশেষে পরীক্ষাটা এসেই গেলো। তারিখ-টারিখ জানিয়ে দিলেন স্যার। এখন শুধু সময় গোনা। গুনবো কি আর। পরীক্ষা মাত্র এক সাপ্তাহ দূরে। ইলিয়াসের ঘন্টা বাজতেই এই বছরের ক্লাস শেষ। হাঁটছি আমি আর হালীম। লীনুর দেখা নাই। মুহিবুরও হাওয়া। আলীয়া মাদরাসার কোণায় আসতেই ডান দিকের সড়ক হোসনি দালান বরাবর। হালীম বললো চল এ পথে যাই। দুপা হাঁটতেই ক্যাফে কাশ নামের একটি রেস্টুরেন্ট। খুব নামিদামি। পয়সাওয়ালারা খানাপিনা করে। ভিতরটা বেশ সাজানো গোছানো। টেবিলে টেবিলে কাপড় বিছানো। ঝকমকে তকতকে। ঘরভর্তি মিটমিটে আলো। হালকা নীল শার্ট-প্যান্ট। সাদা টুপি মাথায়। হাসিহাসি চেহারা। ওরা সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করে। কি দেবো। আমি দু’একবার এসেছি এর আগেও। বললাম সিংগারা দেন। তারপর চা। হালীম হা করে তাকিয়ে দেখছে। কোনো হৈচৈ নাই- এ আবার কেমন হোটেল। বললাম এটি ভদ্র লোকের হোটেল। এখানে দামও বেশি। সিংগারা দুই আনা, চা একআনা। অন্য হোটেলে এর অর্ধেক। এখানকার সিংগারার নাম কলিজি সিংগারা। মজাও দারুণ। টেবিলে টেবিলে বোতল ভর্তি। সিরকা। সিংগারায় ঢেলে খেলে খুব স্বাদ। এই স্বাদ চাখতেই বারবার ক্যাফে কাশে আসি। হালীমের প্রথম আসা। তার চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ। ক্যাফে কাশের ঢেউ। হালীম জিজ্ঞেস করলো আবার কবে আসবি এখানে। পরীক্ষার পর বলতে বলতে পা রাখলাম রাস্তায়। তখনো বুকডন দিচ্ছে ক্যাফে কাশের কলিজি সংগারা, জিব্বা, ঠোঁটে।

হোসনি দালান পিছনে ফেলে নীমতলি। ডাইনে ঘুরলে রেল কলোনি। হালীমদের বাসা। কয়েক পা গেলেই জাদুঘর। নীমতলি জাদুঘর। এ ঘরে এসেছি দলবেঁধে। বেশ কয়েকবার। এসেছিলাম লোভে। জাদু দেখার লোভে। ঘরে ঢুকে তো অবাক। কোথায় জাদু কোথায় ম্যাজিক। ঘরভর্তি ঢাল-তলোয়ার, পাঞ্জাবী আচকান। সব দাদা, দাদার বাপ দাদার আমলের। আছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার তলোয়ার, মুর্শিদকুলি খাঁর মাথার মুকুট, মহাবীর রুসতমের মুকুট ইয়া বড়। আরো কত কি। তাহলে এই জাদুঘরের ছিরি! আমার কথা শুনে হালীম হাসলো। জানালো তোর সেই জাদুর বানান ‘জ’ দিয়ে। এ রকম ‘জাদুঘর’। এ ঘরে হাঁটতে হাঁটতে গা ছম ছম করে উঠছে। মনে হচ্ছে পেছনে যেনো কারা হাঁটছে। কথা বলছে ফিস ফিস। উড়ছে ভয়ের বাতাস। আগে তো এমন লাগেনি। হালীমকে বললাম চল যাই। আমার যেনো কেমন কেমন লাগছে। একটি ভাংগা দালান ইটফিট সব হা করে আছে। জমে আছে শেওলা ঘাস। পাশে একটি মিনার। তার অবস্থাও আধভাংগা। তৈরি করতে করতে কাজ ফেলে রেখে চম্পট দিয়েছে কারিগররা। এই দালান কত বছরের পুরানো কে জানে। মিনারের পাশ ঘেঁষে একটি ছোট্ট বিমান। ফড়িংয়ের মতো পাখা মেলে বসে আছে। হালীম বললো এটি নাকি যুদ্ধ-বিমান। যুদ্ধ বিমান এখানে কেন? এই বিমান কিসের জাদু দেখাবে! কাছে গিয়ে বিমান দেখিনি কখনো। যাক, ভালোই হলো। ঘুরেফিরে বিমানটি দেখলাম। চারপাশে ঘাস জমে আছে। ভাংগা দালানÑমিনার দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। ওদের দেখার যেনো কেউ নাই। যারা ছিলো তারাও পালিয়েছে কোথায় কে জানে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সূর্য নামতে শুরু করেছে। ঠান্ডা বাতাসের চোখ ফুটে ফুটে।  (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ