রেমিট্যান্স পরিস্থিতি
সাম্প্রতিক সময়ে আরো একবার রেমিট্যান্স তথা বিদেশে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত বাংলাদেশিদের পাঠানো টাকার বিষয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। এর কারণও বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গেই সম্পর্কিত। বেশ কিছুদিন ধরে দেশে মার্কিন ডলারের তীব্র সংকট চলছে। একদিকে সরকারিভাবে যথেষ্ট পরিমাণ ডলার পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে ডলারের দাম।
অর্থনীতির ভাষায় ‘বিনিময় মুদ্রা’ হিসেবে চিহ্নিত এই ডলারের দাম কিছুদিন আগেও খোলা বাজারে ছিল কমবেশি ৮৪ টাকা। কিন্তু কয়েক মাস ধরে একই ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ৯২-৯৫, এমনকি ১০২-১০৩ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ এক খবরে জানানো হয়েছে, বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকারও বেশি। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের যে মূল্যই নির্ধারণ করুক না কেন, ডলার কিনতে হচ্ছে কার্ব বাজারের মূল্যেÑ যেখানে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নির্দেশনা মানা হয় না। উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে সোনার ব্যবসায়ীসহ চোরাচালানীরা জড়িত রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে অপরাধী চক্রগুলোর মিলিত কর্মকান্ডের পরিণতিতে ডলারের বাজার অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে।
একই চক্রগুলোর দৌরাত্ম্যের পরিণতিতে রেমিটান্সের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সরকার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে । আর সে কারণে একদিকে অবৈধ হুন্ডির ব্যবসা যেমন লাফিয়ে বেড়েছে তেমনি আশংকাজনকভাবে কমে গেছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের খবরে জানানো হয়েছে, বেশ কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঘরে আটকে রয়েছে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুর দিকেও এর পরিমাণ ছিল ২০৯ কোটি ডলার। গত বছরের আগস্ট মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণে পতন ঘটতে শুরু করে এবং ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৯ কোটি ডলার।
টানা ছয় মাস ধরে পতনের পর রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়ে ১৬৯ কোটি ডলার পর্যন্ত হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে ১৯৫ কোটি ডলারেও পৌঁছেছিল। কিন্তু এর পরই পতনের শুরু হয়। এমনকি ঈদের মাস এপ্রিলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৬৮ কোটি ডলারÑ যদিও তার আগের মাস মার্চে এসেছিল ২০১ কোটি ডলার। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৮০ কোটি ডলার এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরব। দেশটি থেকে এসেছে ২৭৩ কোটি ডলার।
উদ্বেগের একটি বড় কারণ হলো, মধ্যবর্তী সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছে। সে হিসাবে রেমিট্যান্সও অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা বাড়েনি বরং তুলনামূলক হিসাবে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স অনেক কমেছে। উদ্বেগেরও সৃষ্টি হয়েছে একই কারণে।
ওদিকে রেমিট্যান্স কমবার পাশাপাশি মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলেও দেশকে মারাত্মক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মার্কিন ডলারের সরকারি দাম ছিল ১০৭ টাকা। অন্যদিকে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা দরে। এর ফলে প্রতি ডলারের জন্য তিন টাকা করে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে প্রবাসীরা সহ সকলেই ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। একই কারণে সরকারি ভাবে তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার বিক্রির পরিমাণও অনেক কমে গেছে। রেমিট্যান্স তো কমেছেই।
তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, মার্কিন ডলারকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সহসা কোনো শুভ পরিবর্তন ঘটবার সম্ভাবনা নেই। এর ফলে রেমিট্যান্স পরিস্থিতিতেও ভালো কিছু ঘটবে না। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের মতে মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্য যেমন সমন্বয় করা দরকার তেমনি দরকার হুন্ডির অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়াও। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত সময় নষ্ট না করে এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া এবং সমস্যামুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া। এজন্য বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে। পণ্যের রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্যও সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।