হিজাব বিতর্ক ও জাতিসংঘ
হিজাব বিতর্ক সর্বসাম্প্রতিক নয় বরং দীর্ঘদিনের। একটি বৈশি^ক ইসলাম বিদ্বেষী ও অতি উৎসাহী গোষ্ঠী বরাবরই মুসলিম নারীদের হিজাব পরার অধিকারকে অস্বীকার করে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটিয়েছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে হিজাব পরার ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আদালতেবিশ্ব ব্যবস্থার কারাগারে
দেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। প্রিয় স্বদেশে আমরা বেড়ে উঠি, দেশকে আমরা ভালোবাসি। দেশপ্রেমিক মানুষ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে চায়, চায় নিজের স্বাধীনতার গ্যারান্টিও। কারণ, স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে না পারলে মানুষের কাক্সিক্ষত বিকাশ সম্ভব নয়। এমন বাস্তবতায় রাজনীতি মানুষের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে দর্শন ও কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় শাসন, ক্ষমতা, অর্থনীতি, বণ্টন ব্যবস্থা, জনগণেল মৌলিক অধিকার, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ছাড়াও আরও বহু বিষয় জড়িয়ে গেছে রাজনীতির সাথে। প্রসঙ্গত পরিবেশ, বায়ুদূষণ, জলবায়ু সংকট, জ্বালানি ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আর ভূরাজনীতির কথা কম বলাই ভালো। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় স্বাধীনতা, মুক্তভাবনা, সৃজনশীলতা, বিজ্ঞান চর্চা ও মানবাধিকারের কথা বহুলভাবে উচ্চারিত হলেও মানুষ আসলে ‘বিশ্বব্যবস্থা’ নামক এক বৃহৎ কারাগারে বন্দী হয়ে পড়েছে। তার স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, মর্যাদা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। দরিদ্র দেশের জনগণের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। তাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নানাভাবে আক্রান্ত, ক্ষত-বিক্ষত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় দরিদ্র মানুষের মতো দরিদ্র দেশও শোষিত-বঞ্চিত ও অপমানিত। মানব মর্যাদা ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো এই গ্রহে লোপ পেতে বসেছে। যারা সভ্যতার শাসক তারাই তো এসব বিষয়ের কারিগর। নাকি ভিন গ্রহের কোনো এলিয়ন এসবের জন্য দায়ী?
বর্তমান পৃথিবীতে ছোট ছোট দেশের সংখ্যাই তো বেশি। দেশ ছোট হলে কি হবে, রাজনীতি সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বেদনার বিষয় হলো, ছোট দেশগুলোর রাজনীতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, আগ্রাসনের শিকার হয়। আঞ্চলিক ও বিশ্ব মোড়লরা এর নায়ক। তবে তাদের আচরণের সব কিছু তেমন প্রকাশ পায় না। নির্বাচনের সময় চিত্রটা কিছুটা পাল্টে যায়। তখন কথা হয় এবং কিছু গোমরও ফাঁস হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার আমাদের প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপে হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন দেশটির বিরোধী দল প্রোগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপস (পিপিএম)-এর মোহামেদ মুইজ্জু। ৫৪ শতাংশ ভোটার তাকে ভোট দিয়েছেন বলে প্রাথমিক ফলাফলে জানা গেছে, নির্বাচনে মুইজ্জুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। আগামী ১৭ নবেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা রয়েছে মোহামেদ মুইজ্জুর। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কে এই মুইজ্জুর? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুইজ্জু চীনঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। শক্তিশালী প্রতিবেশী ও অর্থনৈতিক সহযোগী ভারত বিরোধী তিনি। এদিকে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত মালদ্বীপের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে মুইজ্জুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মোহামেদ মুইজ্জু (৪৫) যুক্তরাজ্য থেকে পুরকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে মালদ্বীপের রাজধানী মালের মেয়র তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের শাসনামলে তিনি নির্মাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন আল-জাজিরার প্রতিবেদক কটনি চেং। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রদত্ত সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা মুইজ্জুর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, ‘মালদ্বীপের অর্থ, বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে ভারত গভীরভাবে জড়িত। আমি মনে করি, এটা বন্ধ করা তার পক্ষে কঠিন হবে। ডদিও তিনি প্রকাশ্যে চীনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।’ উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের অতিমাত্রার প্রভাব মালদ্বীপের বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ করে না। আর এই সুযোগে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে সফল হয়েছেন মুইজ্জু। মালদ্বীপের জন্য চীন ভালো, না ভারতÑ সেটা ভিন্ন আলোচনা। তবে এটা উপলব্ধি করা গেল যে, ছোট দেশগুলোর রাজনীতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে জনগণের স্বাধীনতা ও মর্যাদা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে কি সভ্যতার কিছুই করণীয় নেই?
নির্দেশে অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও কোন কোন দেশে তা এখনো বহাল রয়েছে। যা ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপ।
মূলত, কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে আন্তর্জাতিক একটি চক্র এই অপকর্মটি অব্যাহত রেখেছে। যা মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মারাত্মক লঙ্ঘন। দাবি করা হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয় বরং সকল ধর্মের নির্বিঘেœ নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে হয় তার উল্টোটা। সে ধারাবাহিকতায় বিশ^ব্যাপী হিজাব বিরোধী প্রচারণা। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতও তা থেকে মোটেই আলাদা নয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমী দেশ ফ্রান্সের অবস্থান একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের। কারণ, তারা ২০০৪ সালে মুসলিম নারীদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশটির মুসলিমসহ সচেতন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও ফ্রান্স সরকার বিষয়টিকে মোটেই আমলে নেয়নি।
আর অতীতের ধারাবাহিকতায় আসন্ন প্যারিস অলিম্পিক গেমসে ফরাসি দলের নারী অ্যাথলেটদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছে দেশটির সরকার। বিষয়টি নিয়ে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে জাতিসংঘও। এই বিশ^সংস্থা দেশটির এমন সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, নারীদের পোশাক নিয়ে জোরাজুরি করা ঠিক নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র মার্তা হুর্তাদো জেনেভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নারীরা কী পরবে কী পরবে না, তা নিয়ে কারও জোরাজুরি করা উচিত নয়। এটি ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপ।
এর আগে ফ্রান্সের ক্রীড়ামন্ত্রী অ্যামেলি ওদিয়া-কাস্তেরা ঘোষণা দেন, অলিম্পিক গেমসে তাদের নারী অ্যাথলেটরা হিজাব পরতে পারবেন না। দেশটির কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। হিজাব নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, ক্রীড়া অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের ধর্মীয় প্রতীক বহনের বিরোধিতা করে ফরাসি সরকার। ফরাসী এই দাবিকে অযৌক্তিক ও বিদ্বেষাত্মক বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল।
হিজাবের বিরুদ্ধে ফ্রান্স সরকারের এই নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার মুখপাত্র বলেছেন, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের আন্তর্জাতিক কনভেনশন যেকোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণকে প্রত্যাখ্যান করে। তার ভাষায়, কনভেনশনের যেকোনো রাষ্ট্রপক্ষ এক্ষেত্রে ফ্রান্সের বাধ্যবাধকতা রয়েছে... উভয় লিঙ্গের নিকৃষ্টতা বা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোকে সংশোধন করার। হুর্তাদো বলেন, একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। সে কারণে ধর্ম বা বিশ্বাস পালনে বিধিনিষেধ কেবল নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য। এখানে নির্দিষ্ট করে জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতার জন্য গুরুতর হুমকি, এমন পরিস্থিতিকে বুঝিয়েছেন জাতিসংঘ মুখপাত্র।
ফ্রান্সে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক বহু পুরোনো। ১৯ শতকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্যাথলিক প্রভাবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় ফরাসিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেকোনো ধরনের ধর্মীয় প্রতীক বহন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ফরাসি স্কুলগুলোতে খ্রিস্টানদের ক্রস, ইহুদিদের কিপ্পা বা মুসলিমদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ। যা কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মবিদ্বেষ হিসাবেই বিবেচনা করা হয়।
ফ্রান্সে বর্তমানে ৫০ লাখের বেশি মুসলিম বসবাস করেন। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু দেশটির পর্দা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো মুসলিমদের কাছে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৪ সালে স্কুলগুলোতে হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফ্রান্স। ২০১০ সালে উন্মুক্ত স্থানে মুখ ঢেকে চলাচল নিষিদ্ধ করে দেশটি। গত জুনে নারী ফুটবলারদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছে ফ্রান্সের কাউন্সিল অব স্টেট। গত মাসে স্কুলগুলোতে বোরকাও নিষিদ্ধ করেছে তারা। এসব সিদ্ধান্তে মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হলেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় ফরাসি কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। তাই এই বিশ^সংস্থার উচিত এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেয়া। যাতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকরা নির্বিঘেœ নিজ নিজ ধর্ম পালন ও পছন্দমত পোশাক ব্যবহার করতে পারেন। যার দায়িত্ব জাতিসংঘ কোনভাবেই এড়াতে পারে না।