সর্বকালের মহান ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ (সা.)
জাফর আহমাদ
পৃথিবীর ভূপৃষ্ট যত বড় বড় নায়ক-মহানায়ক, সমাজ সংস্কারক, দোর্দ- প্রতাপশালী বিপ্লবী, মহাবিপ্লবীদের ভার ধারণ করেছে তাদের মধ্যে পৃথিবী তার সর্বাঙ্গে একমাত্র যে মহামানবের স্পর্শকে অনুভব করে, যার অবদান ও কীর্তিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তিনি বিশ্বমানবতার অকৃত্রিম বন্ধু, পূর্ণাঙ্গ মহামানব, কালেমার পতাকাবাহী মরু-সাইমুম, শেষ নবী, বিশ্বনবী, বিশ^নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)। যার চরিত্রে অসংখ্য গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। যাকে পেয়ে তৃষ্ণার্ত পৃথিবী তৃপ্তি লাভ করেছিল। যিনি জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আমূল পরিবর্তন করে সমগ্র সমাজ সভ্যাতাকে আল্লাহর রঙ এ রাঙিয়ে গেছেন। তিনি নিছক এমন কোন ধর্মীয় নেতা ছিলেন না যে, শুধুমাত্র মসজিদে বসে মানুষদেরকে ধর্মীয় বাণী শুনাতেন বা অধিকাংশ সময় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। অথবা তিনি এমনটিও ছিলেন না যে, শুধু ইমামতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বা উপরন্ত ধর্মীয় দিকটি দেখাশুনা করতেন। আর সšু‘ষ্টি চিত্রে বাইরের পৃথিবীর নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন অসৎ, আল্লাহ বিমুখ তাগুতী শক্তির হাতে। কুরআন হাদীস স্বাক্ষী তিনি এমনটি করার জন্য প্রেরিত হননি। বরং পৃথিবীর অসংখ্য খোদার নাগপাশ থেকে সমাজ ও সভ্যতাকে মুক্ত করে এক আল্লাহর গোলামে পরিণত করার সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “তিনিই তো তার রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন এটিকে অন্যান্য সর্বপ্রকার দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেন-তা মুশরিকদের যতই অপছন্দ হউক না কেন।”(সুরা আছ-সফ-৯)
আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হেদায়াত তথা আল কুরআন ও সত্য দ্বীন তিনি পেয়েছেন তা মানুয়ের গোটা জীবন ব্যবস্থার প্রত্যেকটি বিভাগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে কেবলমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও বিধান বিজয়ী ছিল।
সেখানে আল্লাহর আনুগত্য ও বিধানের বিপরীত সকল প্রকার চিন্তা, চেতনা নাম মাত্রও ছিল না। আর এটিই তার কাজ এবং এ কাজ তাঁকে অবশ্যই করতে হয়েছে। কাফের ও মুশরিকরা মেনে লয় তবুও, না মেনে নেয় তবুও এবং বিরোধীতা ও প্রতিরোধের মুখে সমগ্র শক্তির মোকাবেলা করে রাসুল (সা.) এ ‘মিশন’ অবশ্যই পূর্ণ করতে হয়েছে। পাহাড়সম বাধা আর বিরোধীতা নিয়ে তাবত তাগুতি শক্তির সাথে লড়ে গেছেন। এ জন্য তাঁকে অসংখ্য নির্যাতন, দুঃখ-কষ্ট, কঠিন ষড়যন্ত্রসহ অত্যাধিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লোভনীয় অফারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুই তার মিশনকে সম্মুখে এগিয়ে নেয়ার পথকে রোধ করতে পারেনি।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমরা দৈনন্দিন কুরআনের সাথে যে ধরনের আচরণ করে যাচ্ছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) জীবন চরিতের সাথে ঠিক সে আচরণই করে যাচ্ছি। প্রত্যেকেই আমরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কুরআনকে যেমন শতধা ভাগ করেছি। আল্লাহর রাসুল (সা.) এর জীবন চরিতকেও আমরা আমাদের সুবিধা মত ভাগ করে বিশেষ অংশের উপর আমল করে যাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আল কুরআন ও রাসুল (সা.) এর চরিতের সহজ ও সরল কাজগুলো ঘটা করে পালন করে যাচ্ছি, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সমস্যার সমাধানের জন্য ধারস্থ হচ্ছি মানবরচিত মতবাদের কাছে। ফলে পার্থিব জীবনে আমরা বিশ্বময় অপমানিত ও লাঞ্জিত হচ্ছি। কুরআনের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাস করবেন- ‘যারা কুরআনকে টুকরো টুকরো করেছে। সুতরাং তোমার মালিকের শফথ, ওদের সবার কাছে আমি অবশ্যই প্রশ্ন করবো। সে সব বিষয়ে, যা কিছু আচরণ তারা (কুরআনের সাথে) করতো। (সুরা হিজর-৯১-৯৩)
অথচ কুরআন ছিল রাসুল (সা.) এর পথের সার্বক্ষণিক গাইড ও শক্তিশালী মিত্র। দৈনন্দিন এ কুরআনই কঠিন সংগ্রামে তাঁকে শক্তি যোগাত। সে কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়নে আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যেমন এর সাথে জড়িত হই না। তেমনি রাসুল (সা.) এর পুরো জীবন থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করি না। কুরআন থেকে পুরোপুরি ও সত্যিকার হেদায়াত লাভ সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এর অর্থ অনুধাবন করা না যায়। তেমনি আল্লাহর রাসুল (সা.) এর জীবন থেকে সত্যিকার হেদায়াত লাভ যেমন সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সমগ্র জিন্দিগীকে একটি জীবন একটি আদর্শ হিসাবে গ্রহণ না করা যায়। কুরআন যেমন শুধু মাত্র সওয়াবের উদ্দেশ্যে তেলাওয়াত করা এবং পবিত্র গ্রন্থ, আধ্যাতিকতার প্রতীক, পবিত্র মুযেযা ইত্যাদি বলে চিত্তকে শান্ত করার জন্য অবতীর্ণ হয়নি। তেমনি রাসুল (সা.) চরিত্রের বিশেষ কোন দিক বা অধ্যায় আলোচনা করে আবেগ প্রকাশ করলেই তাঁর সঠিক মুল্যায়ন বা দায়িত্ব পালন করা হবে না।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এর চরিত্র ছিল আল কুরআন। তাই আল-কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাসুল চরিতকে বুঝা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আল-কুরআনের শিক্ষাকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে রাসুল (সা.) এর ২৩ বৎসরের জীবনের আলোকেই বুঝতে হবে। কারণ বিশ্বনেতা হযরত মোহাম্মাদ এর যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঐ আন্দোলনের চাহিদা অনুযায়ী যখন যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই অবতীর্ণ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন ‘যারা কুরআনকে অস্বীকার করে তারা বলে আচ্ছা পুরো কুরআনটা তার উপড় একবারেই নাযিল হয় না কেন ? আসলে কুরআন তো এভাবেই নাযিল হওয়া উচিৎ ছিলো যাতে করে এই ওহি দ্বারা আমি তোমার অন্তরকে মযবুত করে দিতে পারি এ কারণেই আমি একে থেমে থেমে নাযিল করেছি।’ (সুরা-ফোরকান-৩২)
তাই কুরআন বুঝার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সংগ্রামী জীবনকে সামনে রাখতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ এর সংগ্রামের মাধ্যমে কুরআনকে সহজে বুঝেছিলেন। যারা রাসুল এর জীবনের আলোকে কুরআনকে বুঝতে চান না কিংবা তদনুযায়ী কাজ করতে নারাজ তাদেরকে বনর্ণা করা হয়েছে এমন গাধা হিসেবে, যারা ওজন বহন করে কিন্তু তারা জানে না কি বহন করছে এবং তা থেকে না হতে পারে উপকৃত। তারা সেই হতভাগা, যাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নবী (সা.) বিচারের দিন অভিযোগ করবেন - “হে আমার আল্লাহ, আমার জাতির লোকেরা এই কুরআনকে উপহাসের বস্তুু বানিয়ে নিয়েছিল।” (সুরা ফুরকান-৩০)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ বিশ্বমানবতার একমাত্র মুক্তির দূত। এ মহামানবের আদর্শ ছাড়া মানুষের মুক্তির চিন্তা করা একটি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নহে। বর্তমান এ বিপর্যস্ত পৃথিবীটাই প্রধান স্বাক্ষী। সারা পৃথিবী জুড়ে মানব রচিত বা মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি আইন ও কানুন দিয়ে শান্তি আনয়নের চেষ্টা সাধনা করা হচ্ছে। কিন্তু শান্তি তো দূরের কথা, বরং মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমরা কুরআনের হুকুম অনুযায়ী নামায, রোযা, হজ্জ পালন করছি কিন্তু আল কুরআনের সামাজিক মর্যাদা আমরা দিতে চাই না। এমনিভাবে আমরা কেউ কেউ রাসুল (সা.) এর মক্কী জীবনের উপর আমল করে যাচ্ছি, মনে হবে যেন রাসুলের মাদানী জীবনের অনুসরণ অতিমানবীয় কাজ।
অথবা এ মাক্কী জীবনের কাজ শেষ করতে পারলেই মাদানী জীবন এমনি এমনি তৈরি হয়ে যাবে। কেউবা আবার রাসুলের মিষ্টি মিষ্টি সুন্নতগুলোর অনুসরণ নিয়ে ব্যস্ত। একদল এমন রয়েছেন যারা রাসুল (সা.) এর মাটির তৈরি নাকি নুরের তৈরি, তিনি গোল টুপি পড়েছেন নাকি কিস্তি টুপি ও দাঁড়িয়ে দুরুদ পড়ব নাকি বসে ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক তর্কে লিপ্ত আছেন। অনেকটা রসনাভোজি প্রিয় ব্যক্তিদের ন্যয় কিছু ভাইসব তো সারাক্ষণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলৌকিক দিকগুলো মজা করে উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু এতসব ভাইয়েরা রাসুল (সা.) ইসলামী সমাজ গড়ার কথা একবারও মুখে আনেন না। যার ফলে আমাদের জন্য পৃথিবীটা আজ ছোট হয়ে আসছে।
এ করুণ পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে দ্রুত আমাদেরকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ জীবনের কাছে ফিরে আসতে হবে এবং রাসুল (সা.) যেভাবে আল কুরআনকে সামাজিক মর্যাদা দিয়েছিলেন সে ভাবে কুরআনের মর্যাদা দিতে হবে।