অনুপম আদর্শের প্রতীক মহানবী (সা.)
ড. আবদুল আলীম তালুকদার
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অনুপম আদর্শের প্রতীক নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কে মহান আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং আল্লাহ্ তাআলা নিজেই তাকে ন্যায় ও আদর্শভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করেছেন। কুরআনুল কারীমের সুরা আল আহ্যাব এর ২১ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের জন্য রাসূল (স.)-এর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ এছাড়াও সুরা আল আ’রাফ এর ১৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা নবী মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে আরো ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি (নবী মুহাম্মদ) তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসুল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি।’ তাছাড়াও রাসূল (সা.)-এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা প্রদান করে উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়িশা (রা.) বলেছেন, ‘কুরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র।’
উত্তম চরিত্রের অধিকারী মহানবী (সা.) ছিলেন সৃষ্টির সেরা মানুষ।
জগত বিখ্যাত লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘দ্য হান্ড্রেড’ গ্রন্থে মহানবী (সা.)কে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীর সর্বকালের সকল মহামনীষীদের উপরে। তাছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অনেক ঐতিহাসিকরাও অকপটে স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। চরম বিরোধী প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান নিজেই স¤্রাট হিরাক্লিয়াসের সম্মুখে নবি (সা.)-এর সততা, আমানতদারিতা ও সচ্চরিত্রতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। মহানবী (সা.)-এর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ্পাক সূরা কালামের ৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।’
মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করে গোটা বিশ্ববাসীর সামনে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। হযরত উক্বা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তুমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো। তোমার প্রতি যে যুলুম করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে যে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে প্রদান করো। (মুসনাদে আহমদ: ১৭২১২)
মহান আল্লাহ্ নিজেই তাঁর বান্দাদের উৎসাহিত করেছেন তাঁর প্রিয় রাসূলকে আগ্রহচিত্তে অনুসরণ ও মনে-প্রাণে ভালোবাসার জন্য। তাইতো তিনি সুরা আলে ইমরানের ৩১ নং আয়াতে বলেন, ‘হে রাসূল, আপনি বলে দিন তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ করো; তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’
নবী (সা) এ নশ্বর ধরাতে আগমন করেছেন মানবজাতিকে সচ্চরিত্রবান হওয়ার অনুশীলনে অভ্যস্ত করে তোলার লক্ষ্যে। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে হাদিসটি বর্ণিত। নবি (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে।’ [সহিহ বুখারি (আদাবুল মুফরাদ): ২৭৩]
মহানবী (সা.) এমন একজন আদর্শ মহামানব ছিলেন যার উন্নত নৈতিক চরিত্রমাধুর্যতা, সততা, বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তৎকালীন মক্কার কুরাইশরা এমনকি চিরশত্রু মুশরিকরাও কোনো প্রকার সন্দিহান ছিলেন না। বাল্যকালেই তো তিনি কুরাইশদের আস্থা অর্জন করেছিলেন তাঁর সততা, অসমসাহসিকতা, বিনয়-ন¤্রতা, বিশ্বস্ততা, ধৈর্যশীলতা, অকল্পনীয় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ও মহানুভবতার মতো বিরল চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে। আর তাঁর এসব প্রশংসনীয় গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে কুরাইশগণ তাঁকে ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
নবী (সা.) শৈশবকাল থেকেই অত্যন্ত লজ্জাশীল ছিলেন। এ মর্মে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, ঘরের ভিতরে অবস্থানকারিনী কুমারী মেয়ের চেয়েও রাসূল (সা.) বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কোনো কিছু দেখে অপছন্দ করতেন তখন তার চেহারা দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম। (সহিহ বুখারি: ৬১০২)
হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রা.) বলেন, আমি আমার পিতাকে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গীদের ব্যাপারে তাঁর আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রাসূল (সা.) সদা হাস্যোজ্জ্বল ও অতি বিনয়ী, নরম-কোমল স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি কখনো অট্টহাসি হাসতেন না। সর্বদা তাকওয়া অবলম্বন করতেন। তাঁকে কখনই কারো সাথে রূঢ় আচরণ করতে দেখিনি। তিনি উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। মৃদু স্বরে অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় কথা বলতেন। তবে তাঁর মধ্যে ভীরুতা ও কাপুরুষতা ছিল না। তাঁর স্বভাব-চরিত্রে কখনো অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো বা কাউকে কোনো বিষয়ে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করতে দেখিনি। কারো সাথে ওয়াদা করলে তা সর্বতোভাবে পালন করতেন। কোনে কাজে-কর্মে কাউকে নিরাশ করতেন না আবার মিথ্যে প্রতিশ্রুতিও দিতেন না। তিনি সর্বদা ৩টি বিষয় (১. ঝগড়া-বিবাদ ২. আত্ম-অহমিকা ৩. অযথা কথা-বার্তা বলা) থেকে দূরে থাকতেন। এছাড়াও তিনি কারো নিন্দা করতেন না, কাউকে মিথ্যে অপবাদ দিতেন না। যে কথার দ্বারা সওয়াবের ভাগি হওয়া যায় শুধু তা-ই তিনি বলতেন। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন উপস্থিত ¯্রােতারা অত্যন্ত মনোযোগ ও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাঁর কথার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। এক কথায় তাঁর নিরুপম বাগ্মিতার সুনাম তৎকালীন সময়ে আরব বিশ্বের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
নবি করিম (সা.) ছিলেন শ্রেষ্ঠতম দানশীল ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাছে কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতেন না। কারো উপকারে লাগবে এমন কিছু নিজের কাছে থাকলে চাহিবামাত্র তা পরোপকারার্থে দিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। তবে তিনি অপচয় করতেন না। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দানশীল’ (সহিহ বুখারি: ১৯০২)। তাছাড়া হযরত আবু মুসা বিন আনাস (রা.) হতে আরেকটি হাদিস বর্ণিত, তিনি তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এর ক্ষেত্রে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে অথচ তিনি তা দেননি।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবি (সা.) অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। স্বল্প আহার করতেন এবং যে কোনো বিষয়ে অল্পতেই তুষ্ট থাকতেন। চেনা-অচেনা সবাইকে আগে সালাম দিতেন। ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় নির্বিশেষে যে কেউ দাওয়াত দিলে তা সাদরে গ্রহণ করতেন। গৃহস্থালীর কোনো কাজ করতে তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করতেন না।
ঘরের কাজ-কর্ম তিনি নিজ হাতেই করতেন। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে এবং তা নিজে বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসতে মোটেও হীনমন্যতায় ভোগতেন না। পায়ের জুতা ছিড়ে গেলে নিজ হাতে মেরামত করতেন। জামা-কাপড় সেলাই করতেন।
ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার পালিত উট-দুম্বা-বকরিকে নিজেই মাঠে চড়াতে নিয়ে যেতেন এবং নিজ হাতেই ঘাস-তৃণজাতীয় লতা-গুল্ম খাওয়াতেন। সময় মতো সেগুলোকে পানি পান করাতেন এবং গৃহপালিত পশুর দুগ্ধ তিনি নিজ হাতে দোহন করতেন।
গৃহকর্মীদের নিজের কাছে বসিয়ে খাবার খাওয়াতেন। গম-যব পিষতে পিষতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।
বর্তমান এই পঙ্কিলময় ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে শান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দিতে মহামানব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর নিষ্কলুষ আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।