রবিবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

মহানবী (সা)-এর উত্তম আদর্শ

ড. ইকবাল কবীর মোহন

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবার সেরা নবি। সকল যুগের সেরা মানুষ। সর্বশেষ নবি তিনি। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এসে এই অন্ধকার জগতকে শোভায় সৌন্দর্যে কুসুমিত করেছেন। বিপথগামী মানুষকে হেদায়াতের পথে-এক আল্লাহর পথে পরিচালিত করেছেন। সেই নবির উম্মত আমরা। শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শও তেমনি শ্রেষ্ঠ। তাঁর জীবনও ছিল উত্তম আদর্শের নমুনা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মহত্তম আদর্শের মডেল। তাঁর জীবনাচরণ ছিল সুষমা আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দয়া-মায়া, ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা, ক্ষমা-করুণা, ধৈর্য-সাহস, সত্য-সততা, নীতি-ন্যায়নিষ্ঠা সকল ক্ষেত্রেই তিনি মহান আল্লাহর নিয়ামতে পূর্ণ এক মহামানব। তাইতো তখনকার দিনে তাঁর শক্ররাও ছিল তাঁর অনুরক্ত, ভক্ত। তারাই তাঁকে ডাকত ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী বলে। আজকের যুগে অমুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদরা তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে বিবেচনা করে, মান্য করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের কয়েকটি অপূর্ব ঘটনার উল্লেখ করছি এই প্রবন্ধে।

এক. সুমামা নামীয় ইয়ামামার এক সরদার ঈমান গ্রহণ করলেন। এতে মক্কার কাফের-কুরাইশরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। তারা সুমামাকে খুব অপমান-অপদস্থ করল, তাঁকে মারধোর করল। সুমামা কুরাইশদের আচরণে খুব কষ্ট পেলেন। এই কষ্ট বুকে ধারণ করেই সুমামা তার দেশে ফিরে গেলেন। দেশে গিয়ে সুমামা গোত্রের সকলকে তার অপমানের কথা জানালেন। খাদ্যশস্যের এক অপূর্ব ভান্ডার ইয়ামামা। মক্কার লোকেরা এখানকার শস্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইয়ামামার লোকেরা ঠিক করল তারা মক্কায় কোনো খাদ্যশস্য পাঠাবে না। অবশেষে তাই করা হলো। এতে মক্কায় খাদ্যের প্রচ- অভাব পড়ে গেল। ফলে মক্কাবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়ল। কোনো উপায় না পেয়ে কুরাইশ নেতারা ছুটল সুমামার কাছে। ভুলের জন্য মাফ চাইতে। 

কুরাইশরা সুমামার কাছে ক্ষমা চাইল। তাকে মক্কায় খাবার পাঠাতে অনুরোধ জানাল। সুমামা বিনয়ের সাথে বললেন, বিষয়টি নবীজির হাতে। কথা বলতে হয় তো নবীজির কাছে বলতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই হবে। আর তবেই মক্কায় খাদ্য সরবরাহ করা হবে। 

সুমামার কথা শুনে কুরাইশদের মাথায় বাজ পড়ল। তাদের প্রধান শত্রু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাদের দেব-দেবী উজ্জার দুশমন, বাবা হোবলের দুশমন। আর এই মুহাম্মাদের নিকট যেতে হবে! তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! কিন্তু তাদের যে কিছুই করার নেই। তারা যে নিরুপায়। খাদ্যশস্যের বিষয় সুরাহা না হলে না খেয়ে মারা যাবে তারা। অগত্যা তারা মদিনার পথে ছুটল। 

কুরাইশদের মনে প্রচ- ভয়। তারা জানে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ক্ষমা করবেন না। কেননা, এই কুরাইশরাই নবীজিকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন তিনি তো প্রতিশোধ নেবেন। এ কথা ভাবতে ভাবতে কুরাইশরা একসময় হাজির হলো মদিনায়। নবীজির সাথে দেখা করল। তাঁকে সবকিছু খুলে বলল। 

কুরাইশদের দুঃখের কথা শুনে নবীজির মন বিগলিত হলো। তিনি কুরাইশদের অবস্থা শুনে কষ্ট পেলেন। মক্কার লোকেরা খাবারে কষ্ট পাবে-এটা নবীজি মেনে নিতে পারলেন না। তাই তিনি সুমামাকে খবর পাঠালেন। তাকে অবরোধ তুলে নিতে বললেন। সুমামা নবীজির নির্দেশ পেয়ে মক্কায় খাদ্য পাঠাতে শুরু করল।  

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ দেখে কুরাইশরা অবাক হলো। তাই শ্রদ্ধায় নবীজির প্রতি তাদের মস্তক অবনত হলো। নবীজির সুন্দর মন দেখে তারা বিস্মিত হলেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে তারা গ্রহণ করল না। বরং সেই কাফেরই রয়ে গেল।  

দুই.

মক্কা বিজয়ের পরের এক ঘটনা। কুরাইশদের একটি শাখা মাখদুম গোত্র। বড় সম্মানিত গোত্র এটি। অন্য গোত্রের বিচার সালিশ তারা করে। কিন্তু এই গোত্রের এক মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়েছে। চুরির ঘটনায় মহিলার হাত কাটা যাবার অবস্থা হয়েছে। ইসলামি আইনে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। 

মানী গোত্র। সম্ভ্রান্ত ঘর। আর এই গোত্রের মহিলার হাত কাটা যাবে? তাই গোত্রের লোকেরা লজ্জায় পড়ে গেল। তারা নবীজিকে বুঝিয়ে ক্ষমা পাবার একটা পথ খুঁজছিল। এজন্য তারা বেছে নিলো উসামাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পালিত পুত্র ক্রীতদাস জায়েদের পুত্র উসামা। নবীজির বড় আদরের পাত্র তিনি। এই উসামাকেই নিজের উটের ওপর বসিয়ে নবীজি মক্কা বিজয়ের দিন শহরে প্রবেশ করেছিলেন। উসামাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন নবীজি। সেই উসামা মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে। মাখদুমের লোকেরাও রয়েছে তার সাথে। 

নবীজি উসামাকে তার কথা শুনাতে বললেন। উসামা বিনীতভাবে নবীজিকে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! মাখদুম গোত্রের কথা বিবেচনা করে মহিলাকে ক্ষমা করা যায় কি না?’ 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘উসামা! আল্লাহ যে শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তুমি কি আমাকে তার ব্যতিক্রম করতে বলছ?’ 

নবীজির কথা শুনে লজ্জা-শরমে উসামার মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি তার অপরাধ বুঝতে পারলেন। তাই বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন নবীজির কাছে। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারপর বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ নিরপেক্ষ বিচারের অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় লোকেরা অন্যায় করলে নামমাত্র বিচারে তারা ছাড়া পেয়ে যেত। আর একই অপরাধে গরীবের ওপর নেমে আসত কঠোর সাজা। কেবল এ কারণেই বনি ইসরাইল জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

নবীজির কথা শুনে উপস্থিত সাহাবিরা নীরব হয়ে গেলেন। বনু মাখদুম গোত্রের লোকেরাও চুপ মেরে গেল। কেউ আর কোনো কথাই বলতে পারল না। সবার নীরবতা ভেঙে নবীজি আরও বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম! আজ যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এ অপরাধে লিপ্ত হতো সেও আল্লাহর সাজা থেকে রেহাই পেত না। আমি তখনই তার হাত কেটে ফেলতাম।’

ন্যায়বিচার ও আল্লাহর বিধান মানার একি সুন্দর নজির স্থাপন করলেন আল্লাহর নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটাই ছিল ইসলামের সুমহান আদর্শ। 

তিন.

বনু হানিফা গোত্র। দুর্ধর্ষ এক কুচক্রী গোত্র এটি। বহু অপরাধের ধারক ও বাহক ছিল এই গোত্রের লোকেরা। মুসাইলামার মতো মিথ্যুক নবির জন্ম হয়েছিল এই গোত্রে। এই গোত্রেরই প্রচ- বিদ্বেষী ও খুনী এক সরদার ছিল সুমামা ইবনুল আদাল। বহু খুনে তার হাত রঞ্জিত হয়েছিল। অসংখ্য মুসলমানের সর্বনাশ হয়েছে তার হাতে। এবার সে বন্দি হলো। মুসলমানরা সবাই তার কতলের জন্য দাবি তুলল। ইসলামের এই বড় দুশমনের একমাত্র শাস্তি হলো কতল। একসময় বন্দিকে নিয়ে হাজির করা হলো নবীজির কাছে। তিনি বন্দিটির দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,  ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’ 

বন্দি জবাবে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে একজন বড় দুশমন এবং অপরাধীকেই হত্যা করবেন। আর যদি দয়া করেন তা হলে একজন সত্যিকার অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবেন। তা না করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে, বলুন তা হলে কত মুক্তিপণ দিতে হবে?’ 

সুমামার কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকলেন।  কিছু না বলেই নবীজি উঠে চলে গেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই কথা বলল সুমামা। তখনও নবীজি কোনো কথাই বললেন না। তিনি সুমামার যাবতীয় খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। সুমামা জানত মৃত্যুই তার একমাত্র শাস্তি। এজন্য সে প্রস্তুতও ছিল। একদিন হঠাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামার কাছে গেলেন। এ সময় একজন সাহাবিকে ডাকলেন। এরপর তিনি সুমামাকে মুক্ত করে দিতে নির্দেশ দিলেন। সাহাবি তাই করলেন। 

নবীজির কা- দেখে বিস্মিত হলো সুমামা। এটা যে কল্পনাও করা যায় না। মুক্ত হয়ে সে চলে গেল নীরবে। উপস্থিত সাহাবিরা ভাবলেন সুমামা আবার গোত্রের লোকদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেবে।  কিন্তু না। ঘটনা ঘটল উলটো। একটু পরেই সুমামা ফিরে এলো নবীজির কাছে। মদিনার উপকন্ঠে একটা কূপ থেকে গোসল সেরে এসেছে সুমামা। এসেই নবীজিকে মিনতির সুরে বলল, ‘আমাকে সত্য ধর্মের দীক্ষা দিন।’  

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামাকে আরও ভাবতে বললেন। সুমামা বলল, ‘এখনই  আমি সত্য ধর্মে ফিরে আসতে চাই।’ সুমামা আবেগভরা কন্ঠে জানাল, ‘প্রিয়নবি, এ শহর ছিল আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। আর আজ তা হলো সবচেয়ে প্রিয়। কিছুক্ষণ আগেও এই ধর্ম ছিল আমার কাছে সবচেয়ে জঘন্য, আর এখন সবচেয়ে উত্তম। আপনার চেয়ে অধিক উত্তম ও প্রিয় মানুষ আমার আর কেউ নেই।’ 

একথা বলেই সুমামা ইবনুল আদাল বুকফাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অঝোর কান্নায় তার দেহ-মন বিগলিত হলো। ক্ষমার মহিমায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই মানুষকে আপন করে নিলেন। দীক্ষিত করলেন আল্লাহর দীন ইসলামে। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি উত্তম আচরণ ও আদর্শ পেশ করেছেন। ফলে ইসলাম হয়েছিল বিজয়ী। নবীজির মহান আদর্শের ছোঁয়ায় দুনিয়াজুড়ে ইসলাম মানুষের মুক্তির  দিশা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও এই মহান আদর্শ ফুরিয়ে যায়নি। আমরা মুসলমানরা সেই উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলেই আমাদের আজকের এই দুর্দশা। আমরা যেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে পারি - আল্লাহ তা’আলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ