রবিবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) 

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান বিশ্ব অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার এক আঁতুড়ঘর। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, সমাজে সমাজে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাজ্য।  অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দুর্বলের যেন এই গ্রহে কোনো স্থান নেই। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলছে চরম মাৎসনায়। যে যেভাবে পারছে শোষণ, তোষণ, জোর জবরদস্তির মাধ্যমে কেবল নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত আছে। অথচ সৃষ্টিকুলের সেরাজীব হিসাবে মানুষের এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না। শান্তি এবং শৃংখলার সাথে পারস্পরিক সহাবস্থান, মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একবিশ্ব, এক পরিবার” প্রতিষ্ঠাই করাই ছিলো মানুষ হিসাবে বিশ্ববাসীর প্রধানতম মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।  মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, 

‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃজন করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন; এরপর তাদের উভয় থেকে বহু নর ও নারী সম্প্রসারণ করেছেন। (সুরানিসা)

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো আদর্শে  এবং তাঁর মহান জীবন দর্শন অনুসরণের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের এই তাগুতি অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত সহজেই করা যায়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, হে নবী, নিশ্চয়ই আপনাকে আমি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরুপ প্রেরণ করেছি।” এই আয়াতের মর্মমূলে প্রবেশ করলে অতি সহজেই বিষয়টি অনুমেয়। তৎকালীন আরব সমাজে বিদ্যমান আইয়্যামে জাহিলিয়াতের মতো দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে মহানবী (সা.) সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধির যে রূপরেখা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে গেছেন, সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল বর্তমান বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ বিষয়ে জর্জ বার্নার্ড’শ বলেন, আমাদের মধ্যযুগীয় পাদ্রিরা হয় অজ্ঞতার কারণে, না হয় দুঃখজনক বিদ্বেষের ফলে পয়গম্বরের মহান ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্মকে কালো অবয়বে উপস্থাপন করেছেন। আমি পূর্ণ দিবাদৃষ্টিতে এ কথা ঘোষণা করতে চাই যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মুক্তিদাতা। বরং আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বিশ্বের শাসন ও একনায়কত্ব যদি আজ মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কামেল পুরুষের হাতে সোপর্দ করা হয়, তবে এই পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার এমনভাবে সমাধান হয়ে যেত যে, গোটা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার দোলনায় পরিণত হতো’। 

এবার আসা যাক বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর জীবন দর্শন প্রসংগে। সকলেরই জানা আছে, পবিত্র কাবাগৃহে হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপন এর ঘটনা। আরব উপদ্বীপের বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোকে সাথে নিয়ে কেবল প্রখর বুদ্ধিমত্তা দিয়েই শিশুনবী (সা.) রক্তপাতহীনভাবে এ কাজটির চমতকার সমাধান করেছিলেন। সেদিন কেউ প্রতিবাদ করা দূরের কথা, বরং সবাই খুশি হয়েছিলেন এবং শিশু আল আমিনকে বাহবা দিয়েছিলেন।  

মহানবী (সা.)-এর জীবনের তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যা আজও মানবজাতিকে শান্তির পথ দেখায়। যার নাম হচ্ছে ‘হিলফুল ফুজুল’। এর অর্থ শান্তিসংঘ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে মহানবী (সা.) এ গুরুত্বপূর্ণ শান্তিসংঘ গঠন করেছিলেন। আরব সমাজের সব অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে তাঁর সমবয়সী কিছু যুবককে নিয়ে এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।  আসুন জেনে নিই ‘হিলফুল ফুজুল’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- ১. মজলুম ও অসহায়দের সাহায্য করা। ২. সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। ৩. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করা। ৪. পথিক ও মুসাফিরের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৫. কোনো জালেমকে মক্কায় প্রবেশ করতে না দেয়া এবং দুষ্কৃতকারীদের অন্যায় আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। তৎকালীন আরব সমাজ থেকে অন্যায়, অপরাধ, জুলুম, অবিচার এবং বৈষম্য দূরীকরণে এ সংগঠনের অবদান ছিল অসামান্য।

মহানবী ( সা.) কেবল একজন ধর্মপ্রচারকই নন; বরং তিনি বিশ্ব ইতিহাসের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী মহাপুরুষ ছিলেন। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মদীনা সনদ বা চার্টার অব মদীনা। মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ৪৭ ধারা সম্বলিত মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। এর পূর্বে এরূপ কোনো মৈত্রী সংবিধান ছিল না। এই সনদের ধারাগুলো পাঠ করলে সহজেই বুঝা যায় যে, শুধু তৎকালীন মদিনা নয়, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায়ও শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় মদীনা সনদের কার্যকারিতা এবং উপযোগিতা  কতটা গুরুত্বপূর্ণ। 

ষষ্ঠ হিজরীর জ্বিলকদ মাসে (মার্চ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) মদিনা শহরবাসী এবং কুরাইশ গোত্রের মধ্যে সম্পাদিত হয় একটি ঐতিহাসিক সন্ধিচুক্তি। যা হুদাইবিয়া সন্ধি হিসাবে সমধিক খ্যাত। আপাতদৃষ্টিতে এই চুক্তির শর্তসমূহ মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলেও ইহা শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর একটি সুদুরপ্রসারী চিন্তা এবং প্রজ্ঞার ফসল। পবিত্র আল কুরআনে সুরা ফাতাহ’য় এই চুক্তিকে প্রকাশ্য বিজয় হিসাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,  (হে নবী) নিশ্চয়ই আপনাকে আমি একটি সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।” আল কুরআনের এই বাণী কিছুদিন পরেই সত্যে পরিণত হয়। মক্কার কাফেররা এই সন্ধিচুক্তিটি ভঙ্গ করে  প্রকারান্তরে মক্কা বিজয়কেই ত্বরান্বিত করেছিল। শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় হুদাইবিয়া সন্ধির গুরুত্ব এখনও অনস্বীকার্য। 

এরপর আসা যাক ১০ম হিজরী (৬৩২ খ্রিঃ) এর বিদায় হজ্বের ভাষণ সম্পর্কে। এই ভাষণটি সমগ্র মহাবিশ্বে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দলিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে যথাযথ সম্মান এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় এই ভাষণ সর্বকালের সব মানুষের জন্য একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক। জীবনের এই শেষ ভাষণে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানান,  

হে মানব সকল! সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াতকে আমরা দুপায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’ কে চিরদিনের জন্য হারাম ঘোষণা করা হল। 

হে লোক সকল! বল আজ কোন দিন? সকলে বলল “আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্জের বড় দিন”, সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মতো, এই হারাম মাসের মতো, এইব সম্মানিত নগরীর মতো পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে। হে মানব সকল!

নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম । আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে। হে লোক সকল! পুরুষদেরকে নারী জাতির ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষদের উপরও রয়েছে নারীদের অধিকার।

মানব সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় এরচেয়ে উত্তম বাণী আর কি হতে পারে? ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বৈশ্বিক জীবনের সমস্ত খুটিনাটি বিষয়েও মহানবী (সা.) এর জীবন দর্শন সমগ্র মানবজাতির জন্য আলোর দিশারী। আর এজন্যই হয়ত জাতি, ধর্ম, মুসলমান, অমুসলিম নির্বিশেষে সব বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, রাসুল  মুহাম্মদ (সা.) সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি জাগতিক ও  পারলৌকিক উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সাফল্যে উদ্ভাসিত। এজন্য বিশিষ্ট ঐতিহাসিক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার  আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ “দি হান্ড্রেড” এ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মনীষীর তালিকায় সর্বাগ্রে মহানবী (সা.) কে স্থান দিয়েছেন। আর এতে করে বিষয়টি এমন নয় যে, তিনি মহানবী (সা.) কে ধন্য করেছেন, মহানবী (সা.) এর নাম সর্বাগ্রে দিয়ে বরং তিনি নিজেই ধন্য হয়েছেন। আসুন, আমরা জীবনের সকল স্তরে মহানবী (সা.) এর জীবন দর্শন অনুসরণ করি। তাহলে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে নিরবচ্ছিন্ন সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ