মানবিকতা ছাড়া সমাজ হয় না
জাফর আহমাদ
মানুষ সামাজিক জীব। একাকী কখনো বসবাস করতে পারে না বরং সমাজবদ্ধ হয়ে চলাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে মিল-মহব্বতের বন্ধনে সে আবদ্ধ হয়। এই পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মায়াজালে মধ্যেই বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। সমাজ মানে পরস্পর সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। বাংলা একাডেমীর আধুনিক বাংলা অভিধানে “সমাজ’ এর এই অর্থ করা হয়েছে। শব্দটির শাব্দিক অর্থ থেকে বুঝা যায় সহযোগিতা ও সহানুভূতি ছাড়া সমাজ হয় না। সমাজ মানেই পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহানুভূতির ভিত্তিতে যে সংঘ বা পরিষদ গড়ে উঠে তার নাম সমাজ।
কিন্তু মানুষভর্তি পৃথিবীতে মানবিকতার আজ বড়ই অভাব দেখা দিয়েছে। মানুষ আছে কিন্তু মানবিকতা নেই। মানবিকতার অভাবে পৃথিবীটা বার বার হেলে দুলে উঠছে। ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীটা আল্লাহর কঠিন নিগূঢ়ে বাঁধা থাকলেও এরমধ্যে বসবাসকারী মানুষগুলো একপেশে, ইমব্যালান্সড ও প্রািন্তক জীবন-যাপনের কারণে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি হচ্ছে। সেই অর্থেই আমি বলেছি পৃথিবীটা বার বার দুলে উঠছে। আমাদের সামনে বিশাল যে প্রকৃতি রাজ্য আছে তা পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে বিধায় সেখানে শান্তি বিরাজ করছে। আল কুরআনের পরিভাষায় জুলুমাত সমাজ সভ্যতাকে গ্রাস করে ফেলেছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো, আল কুরআনের কাছে ফিরে আসা। কুরআনই জুলুমাত থেকে আলোকিত পৃথিবীর সন্ধান দিতে পারে। আল কুরআনের প্রধান নাসিহাত হলো, মানবিক হওয়া বা কল্যাণকামী হওয়া।
পৃথিবীতে যাদেরকে আমরা সামাজিক জীব হিসাবে অভিহিত করি, সমাজের সেই জীবেরা তাদের সমজীবী অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া একাকী বেঁচে থাকতে পারে না। আরবী ‘জার’ শব্দের অর্থ প্রতিবেশী। বাঁশঝাড়ের ‘ঝাড়’ শব্দটির সাথে আরবী ’জার’ শব্দের ভাবার্থ অপ্রত্যাশিতভাবে মিলে যায়। বাংলা অভিধানে ‘ঝাড়’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ঘন বৃক্ষাবলী। যেহেতু বাঁশগুলো পাশাপাশি অবস্থান করে তাই একে বাঁশঝাড় বলা হয়। বাঁশগুলো মিলেমিশে পাশাপাশি একসাথে বসবাস করে বিধায় বিভিন্ন ঝড়-তুফানকে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। অন্যথায় একাকী একটি বাঁশ ফাঁকা জায়গায় কখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না। মানুষও নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ছাড়া কোন মানুষই একাকী বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। এ জন্য কুরআন ও হাদীসে প্রতিবেশীর মধ্যে সম্প্রীতি, সহ-অবস্থান, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমাজবদ্ধতা বা দলীয় জীবন ও ঐক্যের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো। (নিসাঃ ৩৬)
ইসলামী সমাজের পরিচয়ে সমাজব্যবস্থা বলতে বুঝায় কোন বিশেষ রীতি-নীতি ও আইন-কানুন যা দ্বারা বিদ্যমান বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ইসলামী রীতি-নীতি, আইন-কাঠামো ও বিধি-বিধান দ্বারা যে সমাজ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা।
ইসলাম সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থার ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ইসলামী জীবন দর্শনের মৌলিক অবকাঠামো হলো সমাজ। তাই একটি সুশৃঙ্খল সামাজিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য, সহযোগিতার নির্দেশনা আল কুরআন ও হাদীসের পরতে পরতে রয়েছে। সামাজিক অশান্তি সৃষ্টির সকল কার্যকলাপকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।
একটি মানবিক সমাজের অপরিহার্য কিছু বৈশিষ্ট্য : এক, কল্যাণ কামনা করা। এটি এমন একটি উপাদান, যা ছাড়া সুস্থ সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। একে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া মানুষ একদিনও চলতে পারে না। মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। রাসুলুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কল্যাণকামীতাই দ্বীন, কল্যাণকামীতাই দ্বীন, কল্যাণকামীতাই দ্বীন।” (নাসাঈ, আবু দাউদ) জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি এই মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিকট বায়’আত গ্রহণ করেছি যে, সালাত কায়েম করবো, যাকাত প্রদান করবো এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করবো।” (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকেন।” ( মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ ও ইবনে মাযাহ)
দুই, সহনশীলতা ও সহাবস্থান। একটি সুস্থ সমাজের জন্য সামাজিক সহনশীলতা একান্ত প্রয়োজন। এটি ছাড়া সমাজের শান্তি আসতে পারে না। সহনশীলতা মানুষের মৌলিক চারিত্রিক সৎগুণ। সহনশীলতা ছাড়া সহাবস্থান কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সহনশীলতার বিপরীত বৈশিষ্ট্য হলো অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতার কারণে ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হয়। সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হয়। যেই সমাজের অধিবাসীরা এ বদগুণে আক্রান্ত, সেখানকার পরিবেশ মানবিকতার পরিবর্তে অমানবিক ও অশান্তিতে ভরে উঠে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাসা বাঁধে। দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এটি যদি কোন সরকার প্রধানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়, তবে সংশিষ্ট রাষ্ট্রটির সকল স্তরে অশান্তি ও অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুন্ঠিত হয়। দেশের সম্মানিত লোকজন অপমানিত হয়। সমাজের সকলস্তরে ক্রোধ, বিদ্বেষ, পেশীশক্তি, সংকীর্ণতা ও কুৎসিত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ দানা বেঁধে উঠে। জনগণের ওপর রাষ্ট্র প্রধান শক্তির অপপ্রয়োগ করে। ফলে স্বৈরশাসনের উদ্ভব হয়। সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার জনগণের জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্র পরিচালকদের। কোন প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি অমানববিক ও অসহনশীল হয়, তবে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চলবে না। প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। এমনিভাবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের সকল স্তরে সহনশীলতার অপরিহার্যতা অত্যধিক।
তিন, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন না করা। একজন মুসলমান কখনো তার অপর ভাইকে উপহাস করতে পারে না এবং কষ্ট দেয়া বা হেয় প্রতিপন্ন করার নিমিত্তে বাজে কথা, অপবাদ ও মিথ্যা দোষারোপও করতে পারে না। কাউকে উত্ত্যক্ত করা, গালি দেয়া ও তাদের পরস্পরের মধ্যে গোলযোগ বিভেদ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করা এবং মানুষকে কষ্ট দেয়া কবীরা গুনাহ। প্রকৃতপক্ষে এটি ইসলামের চিরশত্রু শয়তানের কাজ। যে সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের পরিবেশ বর্তমান থাকে, বুঝতে হবে সেখানকার অধিবাসীরা দৈনন্দিন তাঁর শত্রুর কাজকেই বাস্তবায়িত করছে। এ ধরনের কর্মকান্ডকে আল্লাহ তা’আলা জঘন্য কাজ বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা একদল আর এক দলকে উপহাস করো না। কেননা যাদেরকে উপহাস করা হয় তারা উপহাসকারীদের চেয়ে ভালোও হতে পারে। তোমরা একদল মহিলা আর এক দল মহিলাকে উপহাস করো না। কেননা যাদেরকে উপহাস করা হয় তারা উপহাসকারীদের চেয়ে ভালোও হতে পারে। আর তোমরা পরস্পরের দুর্নাম ও কুৎসা রটিওনা এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। খারাপ নামে ডাকা ঈমানের পর খুবই জঘন্য কাজ, যারা এ কাজ থেকে বিরত হয় না তারাই জালিম।” (সুরা হুজরাতঃ )
চার, একতা ও ঐক্য বজায় রাখা। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য, গোলযোগ ও হৈ-হাংগামা সৃষ্টি করা করাও কবীরা গুনাহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, “শয়তান এখন আর এ আশা করে না যে আরব উপদ্বীপের মুসলমানেরা তার পূজা করবে। তবে তাদের মধ্যে বিভেদ অনৈক্য ও কোন্দল সৃষ্টির আশা এখনো পোষণ করে।” কাজেই দুই ব্যক্তি বা দুই দলের মধ্যে যারা গন্ডগোল ও কলহ সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে কষ্টদায়ক ও উস্কানিমূলক কথার আদান প্রদান করে, তারা শয়তানের দলভুক্ত চোগলখোর ও নিকৃষ্টতম মানুষ। সর্বপ্রথম মুসলমান হিসাবে এ ঐক্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের নিমিত্তে। দ্বিতীয়ত ঈমানের দাবি পূরণের জন্য এ ঐক্য হবে দেশ ও জাতি গঠনের নিমিত্তে। এ জন্য বিভিন্ন দল ভাল কাজগুলো পরস্পরে চালু করার ব্যাপরে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং বিতর্কিত কাজগুলো চিহ্নিত করে তা অত্যন্ত দরদের সাথে পরিত্যাগের পরামর্শ দিতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে ঈমানদার লোকেরা) সৎকাজে ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য কর এবং পাপ ও সীমালংঘনে কারো সাহায্য করোনা।” (সুরা মায়েদাঃ ২)
ঐক্যকে বিনষ্ট করে এমন বিষয়গুলো পরিত্যাগ করতে হবে। যেমন কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা হলে ঐক্য বিনষ্ট হয়। হেয় প্রতিপন্ন বা বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য নয় বরং একমাত্র সংশোধনের উদ্দেশ্যেই গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে। কারণ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন “এক মুমেন অন্য মুমেনের আয়না স্বরূপ”। মুসলমানদেরকে উত্ত্যক্ত করা, গালি ও মিথ্যা অপবাদ দেয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে অপর মুসলমানের জান-মাল ও সম্ভ্রমের ক্ষতি করা হারাম। (মুসলিম ও তিরমিযি) রাসুল (সঃ) আরো বলেন, “মুসলমান মুসলমানের ভাই। কেউ কারো ওপর জুলুম করে না, কেউ কাউকে অপমান করে না এবং ঘৃণা করে না। কোন মুসলমানের পক্ষে এর চেয়ে খারাপ কাজ আর কিছু হতে পারে না, যে তার মুসলমান ভাইকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে। (সহিহ মুসলিম) রাসুল (সা.) বলেছেন, “মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী এবং তার সাথে যুদ্ধ বাধানো কুফরী। (সহিহ মুসলিম)
পাচ, সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ইসলামের অপরিহার্য দাবি। ইসলামের সামগ্রিক জীবন দর্শনের দিকে গভীর দৃষ্টিনিবেশ করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের মৌলিক বিষয় তথা তাওহীদ, রেসালাত, নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্ব সহ অন্যান্য কর্মকান্ডগুলোও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার জন্যই নিরন্তর কাজ করে যায়। কারো সাথে সাক্ষাত হলেই সামাজিক সম্প্রীতি ও সহঅবস্থানের প্রাথমিক যে শিক্ষা ইসলাম পেশ করেছে তা হলো ‘আসসালামু আলাইকুম’ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হউক।’ এর মাধ্যমে ব্যক্তি ব্যক্তিকে এ জানান দিল যে, প্রকৃতপক্ষেই আমি তোমার একজন কল্যাণকামী। সহঅবস্থান ও সামাজিক সম্প্রীতি শিক্ষার উত্তম পরিবেশ চালু করার জন্য এর চেয়ে উত্তম পদ্বতি আর কোন ব্যবস্থায় আছে কি? তদপুরি আমরা লক্ষ্য করবো ইসলামের বিশ্বাস ও কর্ম কিভাবে সহঅবস্থানের শিক্ষা দিয়ে থাকে।