শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

উন্নয়ন চাই কিন্তু কেমন উন্নয়ন?

এম এ খালেক

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু অর্জিত উন্নয়নের স্বরূপ নিয়ে অনেকের মাঝেই দ্বিধা-দ্বন্দ এবং প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি উন্নয়ন বলতে আমরা কি বুঝি তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। শাব্দিক অর্থে ‘উন্নয়ন’ বলতে যাই বুঝানো হোক না কেনো আসলে এই শব্দটির অর্থ এবং ব্যাপ্তি অনেক বড়। কাজেই উন্নয়নকে পরিমাপ করতে হলে ব্যাপক অর্থেই তার মূল্যায়ন করতে হবে। একটি দেশের নাগরিকগণ দেশের সার্বিক উন্নয়ন কামনা করে। আর সরকার জন প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেবায় জন্য নানা ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে থাকে। উন্নয়নের জন্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করেন তা জনগণই প্রদান করে থাকেন। সরকারের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। তাকে জনগণের নিকট থেকে করারোপের মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত সম্ভাব্য অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। অথবা বিদেশ থেকে ঋণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সেই ঋণের অর্থ জনগণকেই পরিশোধ করতে হয়। যেহেতু সরকারের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই তাই তাকে এমনভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সাজাতে হয় যাতে সাধারণ মানুষের নিকট তা দৃশ্যমান হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন। তাই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণের জন্য ছোট বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। বিভিন্ন স্থানে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকার তার উন্নয়ন কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের নিকট দৃশ্যমান করতে তৎপর থাকেন। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তা-ঘাট নির্মাণ বা ব্রিজ-কার্লভার্ট তৈরিকে বুঝায় না। উন্নয়নের পরিধি আরো ব্যাপক। উন্নয়ন বলতে বিশাল একটি পরিসরকে বুঝায়। উন্নয়নের সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক শব্দটি যোগ করি ঠিকই কিন্তু সার্বিকভাবে উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বুঝায় না,এর সঙ্গে আরো অনেক কিছু যুক্ত থাকে। উন্নয়ন হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে একটি ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক এবং জনকল্যাণমূলক। জনস্বার্থে সংঘটিত পরিবর্তনকেই আমরা সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে পারি। স্মর্তব্য উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতিকে বুঝায় না। উন্নয়ন হচ্ছে সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় সামিল হওয়া। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে একটু ভিন্ন পরিসরে জানার ও বুঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির বাইরের অনেক বিষয়ও যুক্ত রয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে মানব সম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি অনেক বিষয় এসে যায়। অর্থাৎ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধিত হলেই তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না যদি একই সঙ্গে অন্যান্য খাতের কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নয়ন সাধিত না হয়। সমাজের জন্য কল্যাণকর এমন অনেক কিছুই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষার গুণগত মান এবং পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলোও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। কোনো দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলো কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা, গুণগত শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি কার্যক্রমে পিছিয়ে থাকলো তাহলে সেই উন্নয়নকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে না। এমনকি খন্ডিত উন্নয়নও বলা যাবে না। উন্নয়নের সুফল যদি সব শ্রেণি পেশার মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে না পারে তাহলে সেই অবস্থাকেই প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে না। 

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইস্যুটিকে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। একজন প্রখ্যাত সুইডিস অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যদি কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা যায় তাহলে তাকে আমি প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলবো। একটি দেশের জিডিপি প্রবৃ্িদ্ধ যখন দীর্ঘদিন ক্রমাগত ৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ হারে বাড়তে থাকবে, গড় জিডিপি’র হার ক্রমাগত অন্তত ৫ থেকে ৭ বছর টেকসইভাবে বাড়তে থাকবে তখন তাকে অর্থনেতিক উন্নয়ন বলা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুধু আর্থিক সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকলেই তাকে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায় না। এর সঙ্গে সামাজিক অন্যান্য সূচকও ইতিবাচক ধারায় থাকতে হবে। যেমন, কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উচ্চমাত্রায় থাকলেও সেই প্রবৃদ্ধির সুফল যদি সামান্য কিছু মানুষের নিকট কুক্ষিগত হয় সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হন তাহলে সেই অবস্থাকে প্রকৃত বা সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। যেমন আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে। শুধু মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বাড়লেই তাকে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, দুর্নীতি প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমাগত ইতিবাচক উন্নয়ন সাধিত হতে হবে। অর্থাৎ শুধু রাস্তা-ঘাট নির্মাণ বা এ ধরনের দৃশ্যমান কিছু কার্যক্রম সাধিত হলেই তাকে প্রকৃত বা সার্বিক উন্নয়ন বলা যায় না। সুষম উন্নয়ন তো নয়ই। সাধারণভাবে ‘দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান কিন্তু ইতিবাচক এমন যে কোনো পরিবর্তনকেই’ উন্নয়ন বলা যেতে পারে। ‘উন্নয়ন’ একটি সামগ্রিক শব্দ। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে উন্নয়নের একটি খন্ডিত ধারণা মাত্র। উন্নয়নের সুফল যদি সামান্য কিছু মানুষের হস্তগত হয় তাহলে তাকে কোনোভাবেই সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে যাতে সবাই ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, সামাজিক শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া, সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপিত হওয়াসহ আরো অনেক কিছুর উপর উন্নয়নের সফলতা নির্ভর করে। একটি দেশের সরকার বিপুল সংখ্যক রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করলো কিন্তু সামাজিক অসমতা দূর না হয়ে আরো বৃদ্ধি পেলো অথবা সেই উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ভোগ করতে পারলো না তাহলে তাকে সুষম বা প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে না। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সামগ্রিক উন্নয়নের একটি অংশ হতে পারে কিন্তু সেটাই প্রকৃত বা একমাত্র উন্নয়ন নয়। কয়েক বছর আগে আমি দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, যিনি বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন তার সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক দশক আগে দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের হার ছিল ১২ শতাংশ। এখন তা ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে-বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন? উত্তরে তিনি বলেন, যারা নতুন মধ্যবিত্ত হয়েছেন তারা কিভাবে মধ্যবিত্ত হলেন? তারা কি সৎ পথে উপার্জিত অর্থ দ্বারা মধ্যবিত্ত হয়েছেন নাকি অসৎভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মধ্যবিত্ত হয়েছেন সবার আগে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তার এই উত্তরের মর্মার্থ সহজেই অনুধাবন করা যায়। সমাজে যখন দুর্নীতি এবং অনাচার বেড়ে যায় তখন ব্যক্তি বিশেষ সেই দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন। এভাবে অর্থ বিত্ত অর্জনের মাধ্যমে একটি শ্রেণি বিত্তবান হচ্ছেন। দৃশমানভাবে তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়গছে। কিন্তু এটাকে তো সত্যিকার উন্নয়ন বলা যাবে না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের মাঝে অর্থনৈতিক ব্যবধান ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। এখন অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে যে সাফল্যের দাবি করা হচ্ছে তা ইতিমধ্যেই ফিকে হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। একটি ব্যক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের জরিপে উল্লেখ করেছিল, করোনাকালে দেশে নতুন করে অন্তত ৩ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক নতুন দরিদ্র মানুষগুলোকে কি আমরা আবারো তাদের পূর্ববর্তী আর্থিক অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছি? 

আমাদের দেশে একটি বিষয় অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাহলো, প্রতি ৫ বছর পর পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। যারা সরকারে থাকেন তারা একভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চান। আর সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। যে বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় তারাই ক্ষমতায় গেলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এটা বড় দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও আমরা এমন একটি ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারিনি যার মাধ্যমে বিতর্কহীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। নির্বাচন নিয়ে চলে নিরন্তর দ্বন্দ্ব-সংঘাত। নির্বাচনের আগে সরকার জনসমর্থন পাবার প্রত্যাশায় উন্নয়নমূলক অনেক কার্যক্রম হাতে নেন। সেগুলো জাতীয় স্বার্থে কতটা প্রয়োজন তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়না। আমাদের অনেকের মাঝে একটি ধারণাগত মারাত্মক ভুল প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই অজ্ঞতাবশত অথবা ভুলবশত রাষ্ট্র এবং সরকারকে এক বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, সরকার মানেই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র মানেই সরকার। কিন্তু আসলে তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। 

মূলত এ কারণেই আমরা অনেক সময় সরকারে ভুলগুলোকেও মেনে নিই। আসলে রাষ্ট্র এবং সরকারের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। রাষ্ট্র একটি স্বাধীন এবং অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা। সরকার আর রাষ্ট্র কোনোভাবেই এক বিষয় নয়। ৪টি আবশ্যিক উপকরণ সহযোগে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জনসংখ্যা, সার্বভৌমত্ব এবং সরকার। এর মধ্যে সরকার হচ্ছে একমাত্র দুর্বল এবং পরিবর্তনশীল উপকরণ। অন্য উপকরণগুলো স্থায়ী বা অপরিবর্তিনীয়। কিন্তু অনেকেই সরকারকেই রাষ্ট্রের মালিক বলে মনে করেন। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নাগরিকদের নিকট থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবার পর কোনো কোনো সরকার এমন আচরণ করেন যাতে মনে হয় তারাই বুঝি রাষ্ট্রের সর্বময় মালিকানার একক অধিকারী। রাষ্ট্র এবং সরকার সম্পর্কিত এই ভ্রান্ত ধারণার কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা ভুলবশত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করি। আসলে এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বলে কোনো কিছু নেই। সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আমানতদার মাত্র। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। রাষ্ট্র নিজে তার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। রাষ্ট্র তার প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে থাকে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিধির মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাই সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে খুবই কম। দুর্নীতি এবং অসৎ উপায়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাটাই এক শ্রেণির কর্মকর্তার মূল উদ্দেশ্য থাকে। পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি মালিকের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। ফলে সেখানে দুর্নীতি আর অস্বচ্ছতার সুযোগ থাকে ন্যূনতম পর্যায়ে। মূলত এ কারণেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যে কোনো পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা চাইলেই কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারেন না। উন্নয়ন কার্যক্রম সাধিত হয় দু’টি সেক্টরের মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পাবলিক সেক্টর আর অন্যটি হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টর। অনেকেই ভুলবশত বলে থাকেন সরকারি খাত ও বেসরকারি খাত। এটা মোটেও ঠিক নয়। বর্ণিত দু’টি খাতের মধ্যে পাবলিক সেক্টরের কাজ হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা। যেমন, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, ব্রিজ-কার্লভার্ট তৈরি করা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদি আবশ্যিক উপকরণের যোগান নিশ্চিত করা। আর প্রাইভেট সেক্টর রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট অবকাঠামোগত সুবিধা ব্যবহার করে উৎপাদন নিশ্চিত করা। পাবলিক সেক্টর সব সময়ই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রচুর সংখ্যক রাস্তা-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সবই কি গুণগত মানসম্পন্ন হয়েছে? লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের কথা শোনা যায়। রাস্তা নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই তাতে ভাঙন ধরে অথবা ভবনের প্লাস্টার উঠে যায়। যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়েছে তার মধ্যে কতটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে? কতগুলো প্রকল্প প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে? কোনো প্রকল্পের নির্মাণকালীন সময় বৃদ্ধি পেলে সেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়বেই। কিন্তু নির্মাণকালীন সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কি কাউকে সে জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে?

একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নকালে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। যারা একটি প্রকল্পের ব্যয় এবং নির্মাণকালীন সময় প্রাক্কলন করেন তা যদি সঠিক সময়ে সম্পন্ন করা না যায় তাহলে যারা প্রস্তাবনা প্রণয়ন করেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কারণ তাদের কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বেতন-ভাতা দেয়া হয়। তারা যদি প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় এবং নির্মাণকালীন সময় সঠিকভাবে প্রাক্কলন করতে না পারেন তাহলে সেই ব্যর্থতার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে উপার্জিত অর্থ যে কোনোভাবে ব্যয় করতে পারি তাতে কেউ কিছু বলার নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, দেশের  স্বার্থেই উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে টেকসই এবং সুষম। উন্নয়নের সুফল যদি সামান্য কিছু মানুষের নিকট কুক্ষিগত হয় তাহলে তাকে কোনোভাবেই সঠিক উন্নয়ন কৌশল বলা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন গাড়ি চালক হাজার কোটি টাকার মালিক হলে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না।              

আমাদের দেশের একটি জটিল এবং নিরাময় অযোগ্য সমস্যা হচ্ছে সর্বস্তরে বিস্তৃত ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলা হলেও এই শব্দটি এখন একটি উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে এক নাম্বার দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। পরবর্তীতে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে আমাদের দেশে দুর্নীতি কমেছে। দুর্নীতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কোনো কোনো দেশের দুর্নীতির মাত্রা বাংলাদেশের চেয়েও বেড়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারনা সূচকে পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেেশর নব নিযুক্ত ২৪ তম প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি বলেছেন, শুধু বিচার বিভাগই দুর্নীতি সর্বস্তরে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। তার এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিচার বিভাগ হচ্ছে মানুষের আশ্রয় পাবার শেষ ঠিকানা। একজন বিচারক হচ্ছেন ধরাধামে আল্লাহ্র প্রতিনিধি। সেই বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিয়ে যদি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

আমরা উন্নয়ন চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নতো বটেই। দেশে একজন নাগরিকও পাওয়া যাবে না যিনি উন্নয়ন চান না। একজন নাগরিক তার ব্যক্তিগত উন্নয়ন চান, পারিবারিক উন্নয়ন চান, সামাজিক উন্নয়ন চান সর্বোপরী রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন চান। কিন্তু আমরা কি সেই প্রত্যাশিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পেরেছি? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন গাড়ি চালক হাজার কোটি টাকার মালিক হলে তাকে উন্নয়ন বলে না। একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে মসজিদ নির্মাণ করলে তাকে উন্নয়ন বলে না। কারণ তাদের ব্যয়িত অর্থের কোনো বৈধ সূত্র তারা প্রদর্শন করতে পারবেন না। আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু তা হতে হবে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং ন্যায়ানুগ। কোনোভাবেই দুর্নীতি বা অসৎ উপায়ে অর্জিত উন্নয়ন আমাদের কাম্য হতে পারে না। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ