শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

মার্কিন ডলারের সংকট এবং পণ্যের মূল্য

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ক্রমাগত আরো তীব্র হচ্ছে। মানুষের আয় না বাড়লেও বাড়ছে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। এমন অবস্থার মধ্যে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যেখানে সরকারের দায়িত্ব সেখানে মূল্য নির্ধারণের নামে সরকার নিজেই মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের কথা উল্লেখ করা যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় এভাবে এবং এত বেশি পরিমাণ বৃদ্ধির কথা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে বাংলাদেশে সেটাই ঘটে চলেছে এবং মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার  কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। 

ওদিকে আলু, পেঁয়াজ আর ডিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অন্য সব পণ্যের মূল্যও। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে এসেছে মার্কিন ডলারের প্রসঙ্গ। কারণ, ডলারের মাধ্যমেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন করা হয়। ডলারের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কিছুদিন আগে সরকার ভারতের রুপিকে বিনিময় মুদ্রায় পরিণত করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন ডলারের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে ডলারের সংকট উল্টো আরও গভীর হয়েছে। 

উদ্বেগের কারণ হলো, অর্থনীতির ভাষায় ‘বিনিময় মুদ্রা’ হিসেবে চিহ্নিত এই ডলারের দাম কিছুদিন আগেও খোলা বাজারে ছিল কমবেশি ৮৪ টাকা। কিন্তু কয়েক মাস ধরে একই ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ৯২-৯৫, এমনকি ১০২-১০৩ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ এক খবরে জানানো হয়েছে, দুই সপ্তাহ আগে ১০৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ডলারের বেচাকেনা হয়েছে থেকে ১০৯ টাকা ৪৬ পয়সার মধ্যে। 

জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতি ডলারের দাম বা বিনিময় মূল্য যেখানে ছিল ৮৪ দশমিক ৯০ পয়সা, সেখানে ২০২২ সালের ১৬ মে সে একই ডলার বেচাকেনা হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ পয়সায়। এভাবেই লাফিয়ে বেড়েছে ডলারের মূল্য। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও সে মূল্য অনুযায়ী লেনদেন হতে পারেনি। খবরে জানানো হয়েছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতি ডলারের দাম বা বিনিময় মূল্য যেখানে ছিল ৮৪ দশমিক ৯০ পয়সা, ২০২২ সালের ১৬ মে সে একই ডলার বেচাকেনা হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ পয়সায়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও সে মূল্যে লেনদেন হতে দেয়া হয়নি। খুচরা বাজারে প্রতি ডলার এমনকি ৯২ থেকে ৯৩ টাকা পর্যন্ত দরেও লেনদেন হয়েছে। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসেও প্রতি মার্কিন ডলারের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার খুচরা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কেউ মেনে চলেনি। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সোনার ব্যবসায়ীসহ চোরাচালানীরা। সবার মিলিত কর্মকা-ের পরিণতিতে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ডলারের বাজার অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে এবং বিদেশীসহ প্রায় সব ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে। তারা যার যেমন খুশি তেমন মূল্যে ডলার কেনা-বেচা করেছে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অবৈধ ‘প্লেয়ার’ হিসেবে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে এবং সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নির্ধারিত কম মূল্যে মার্কিন ডলার কিনে একই ডলার অনেক বেশি দামে বাইরে বিক্রি করেছে। 

এমন অবস্থারই পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল এই ব্যবসায় জড়িত অন্য সকল প্রতিষ্ঠানও। তারাও যে যেমন পেরেছে তেমন হারে টাকা আদায় করেছে। এর ফলে খোলা বাজারে প্রতি মার্কিন ডলার এমনকি ১০৫ টাকা পর্যন্ত দরেও বিক্রি হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মার্কিন ডলার যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান বিনিময় মাধ্যম সেহেতু ডলারের দাম এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমে যেতে পারে। বাস্তবে কমে গেছেও। একই কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেও এসেছে। অথচ ২০২১ সালের আগস্টেও এই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চাহিদা মেটানোর জন্য বিগত মাত্র দু’-তিন মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। একই কারণে ডলারের দামও বেড়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি এবং অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়তে থাকলে আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না এবং প্রচ- চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। বাস্তবে অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছেও। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিই শুধু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে না, বাড়ছে চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দামও। পরিণামে স্বল্পসময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক সংকটে পড়েছে এবং নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।

তথ্যাভিজ্ঞদের পাশাপাশি আমরাও মনে করি, এমন অবস্থায় সরকারের উচিত নজরদারি বাড়ানো এবং বিশেষ করে ডলারের ব্যাপারে সরাসরি ভূমিকা রাখা। প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করা। সংকটের আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হচ্ছে কি না সে ব্যাপারেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমদানির সময়ও এমন কিছু আমদানির সুযোগ দেয়া যাবে না, যার অজুহাত দেখিয়ে চিহ্নিত গোষ্ঠীগুলো অর্থ পাচার করতে পারবে। আমরা আশা করতে চাই, মার্কিন ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ সকল বিষয়েই সরকার জনগণের স্বার্থে কঠোর ভূমিকা পালন করবে। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ