শনিবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

রিজার্ভের ঘাটতি এবং জাতীয় অর্থনীতি 

আশিকুল হামিদ

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ তথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার আইন ও নিয়ম অনুযায়ী ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ রিজার্ভ থাকা দরকার বাংলাদেশের তা নেই। এটা শুধু কয়েকদিনের ঘাটতি নয়, বহুদিন ধরেই ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিছুদিন আগেÑ গত জুলাই এবং আগস্ট মাসে দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ৩০ জুন দেশের মোট বা গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে আইএমএফ-এর হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, বিপিএম নামের আরও একটি হিসাবের পদ্ধতিও রয়েছে, যা সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। এবারও করা হয়নি। 

অর্থাৎ দেশের প্রকৃত রিজার্ভ সম্পর্কে জানতে হলে তিনটি পদ্ধতির ভিত্তিতে হিসাব করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেটা করার মাধ্যমেই আইএমএফকে সন্তুষ্ট করে চলছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে বেশিদিন চালানো বা ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফকে একাধিক ধরনের হিসাব জানানো হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ এক হিসাবে জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের রিজার্ভ রয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি। এই পরিমাণ ডলার দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের মে মাসে দেশের আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬৪৬ কোটি ডলার। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তীব্র ডলার ঘাটতির মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব বিভিন্ন কারণেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন আইএমএফ-এর শর্ত ছিল, জুনে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। কিন্তু ছিল ২ হাজার ৩৭ কোটি ডলার। প্রকাশিত রিপোর্টে এর কারণ সম্পর্কে জানানো হয়েছে, প্রতিদিন ডলার বিক্রি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।

এ সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ডলারের অব্যাহত ঘাটতি ও সংকট  এবং যখন তখন অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে অন্য কিছু বিশেষ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের বিশেষ রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিও এই সংকট ও অনিশ্চয়তার বড় কারণ। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, কিছুদিন আগে উদযাপিত পবিত্র ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের আয় বেড়েছিল এবং সেই সাথে বিদেশি ঋণের ছাড় ও রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রিজার্ভের অংক বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে কারণে বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশ ডলার সংকটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম হয়েছে। 

একই কারণে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রাপ্য ঋণের বিল পরিশোধ করতেও বাংলাদেশ কোনো সমস্যায় পড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বরং শুনিয়ে এসেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ‘এখন পর্যন্ত ভালো’। কোনো কোনো দৈনিকের রিপোর্টে অবশ্য একথাও বলা হচ্ছিল যে, রিজার্ভ যেভাবে কমছে তা উদ্বেগজনক। 

এখানে বিশেজ্ঞদের বক্তব্য উল্লেখ করা দরকার। তারা বলে এসেছেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ও রফতানি আয় বাড়লে রিজার্ভও বাড়বে কথাটা সত্য হলেও ইউরোপের চলমান মন্দার কারণে এই রিজার্ভ কিভাবে ও কতটা বাড়ে সে বিষয়ে প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে।

সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণ জানাতে গিয়ে একটি দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ডলার সংকটের চাপে বিগত মাত্র কয়েক মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিক্রি করেছেÑ বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সমান। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছিল তিন হাজার ৬৪০ বা ৩৬ বিলিয়ন ডলার। তবে এই ৩৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পূর্ণটুকুই বাংলাদেশের জন্য ব্যবহারযোগ্য ছিল না। কারণ, বিভিন্ন খাতে আট বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে দেয়া আছে, যা চাইলে সহজে দেয়া যাবে না। সে কারণে দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে দুুই হাজার সাত-আটশ’ কোটি ডলারÑ যা কয়েক মাস আগেও ছিল পাঁচ হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি। 

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কারণও জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা। সংস্থাগুলো বলেছিল, গত জুলাই মাসে দেশের আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৩৩ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ঋণ পরিশোধ, প্রযুক্তি সেবা গ্রহণের মাশুল, শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং বিমান ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতের খরচÑ যেগুলোর সবই মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে। ওদিকে ইউরোপে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠা না গেলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় যেমন বাড়বে না তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। 

আমদানি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার অবশ্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। এসবের ফলে দেশকে বিশেষ করে ডলারের কারণে সংকটে পড়তে হবে না। তাছাড়া অর্থনীতির প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিন মাসের অমদানি ব্যয় মেটানোর যে তত্ত্ব রয়েছে সে বিচেনায়ও বাংলাদেশের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম বলা হয়েছিল। অবশ্য এটকুই সব নয়। সংকট কাটাতে ও বিপদ এড়াতে হলে সরকারকে অবশ্যই যখন-তখন রিজার্ভে হাত দেয়ার সহজ পন্থা পরিত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্যও জোর চেষ্টা চালাতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের এই অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, আতংকিত হওয়ার অথবা পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে সুচিন্তিত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট থেকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া। এভাবে পদক্ষেপ নেয়া হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন স্থিতিশীল হবে তেমনি দূর হয়ে যাবে সংকটের ভীতি ও সম্ভাবনাও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ