নদী রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সুপারিশ

নেত্রকোনা সংবাদদাতা : ময়মনসিংহে বিভাগীয় নদী বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ময়মনসিংহের টাউনহলে গ্রীন পয়েন্ট পার্টি এন্ড ট্রেনিং সেন্টারে যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রির্ফমস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), পানি অধিকার ফোরাম ও অন্যচিত্র উন্নয়ন সংস্থা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক ফরিদ আহমেদ (যুগ্ম সচিব), মৎস্য অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শতাব্দী রায়, এলজিইডি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী অনিল চন্দ্র বর্ম্মন, জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আখলাক উল জামিল, কোতয়ালী সার্কেলর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: শাহীনুল ইসলাম ফকির। কর্মশালায় সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ও বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এর স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে “ময়মনসিংহ বিভাগের নদী বিষয়ক” প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খালিদ মাহমুদ।
এসময় ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদী নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ, এনজিও প্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, টাংগাইল ও জামালপুর জেলার নদী নিয়ে কর্মরত জনগণও অংশগ্রহণ করেন কর্মশালায়।
স্বাগত বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হলো ময়মনসিংহ বিভাগের নদীগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানা, নদী আন্দোলনের মূল্যবোধ সম্পর্কে অনুধাবন করা, নদী আন্দোলনের ম্যাপিং ও আন্দোলনকারীদের সংযোগ, নদী বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ (আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক), নদী থেকে বালু উত্তোলনের প্রভাব নিরূপন, নদী আন্দোলনের আইনগত চাহিদা নিরূপন করা, নদী আন্দোলনে এলাকাবাসী, জনগণ, প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা, নদী আন্দোলনকে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছানো।
পরে দলীয় আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা বলেন, আলোচনায় দেখা যায় কোন নদীই আর সুস্থ নেই। বাংলাদেশের প্রায় সব নদীই দখল-দূষণে জর্জরিত। গৃহস্থালীর ময়লা ফেলে, কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন করে, দখল করে, অপরিকল্পিতভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করে, অপরিকল্পিত ড্রেজিং, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করে নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে। জাতীয় নদী কমিশনের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত নদীর তালিকায় ময়মনসিংহ বিভাগের সকল নদীর নাম নেই। আলোচনায় ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাংগাইলের নদী হিসেবে ৪৪টি নদীকে চিহ্নিত করা হয়েছে যার মধ্যে সুতিখালী, খিরু, বানার, সোমেশ্বরী, সুতিয়া, মহাদেব এবং বেতাই নদীতে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আর মুক্তাগাছার আইমুন নদী হারিয়ে গেছে বলে বলা হয়েছে ।
ময়মনসিংহ বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, নদী খনন ও উদ্ধারের জন্য সরকার কাজ করছে। এই কর্মশালার সুপারিশ হাতে পেলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।
পরে উক্ত কর্মশালায় কিছু সুপারিশ পেশ করেন অংশীজনেরা। তারা জানান, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘœকারী সকল অবকাঠামো অপসারণ করে নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা, নদীর উৎসমুখ থেকে সব ধরনের বাঁধ এবং বাধা অপসারণ, সিএস ম্যাপ (১৯৫৪) অনুযায়ী দেশের সকল নদীর সীমানা নির্ধারণ, গণসচেতনতা সৃষ্টি, নদী সুরক্ষায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ করার মানসিকতা সৃষ্টি এবং তাদেরকে সম্পৃক্তকরণ, নদীর সুরক্ষায় এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন, অপরিকল্পিত ড্রেজিং-এর মাধ্যমে বালু, পাথর উত্তোলন বন্ধকরণ, অবৈধ দখল-দূষণসহ অবৈধ স্থাপনা তথা নদী বিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে, নদী দখলদারদের তালিকা সবার জন্য প্রকাশ করতে হবে, শোধন ছাড়া এই বিভাগের শহরগুলোর কোনো ধরণের বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না এবং শহরগুলোর ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করতে হবে, শিল্প-কারখানার তরল রাসায়নিক বর্জ্যসমূহ ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করে জিরো ওয়েস্ট ডিসচার্জ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, নদীর ওপর নির্মিত অপরিকল্পিত সকল ছোট ও নিচু ব্রিজ/কালভার্ট অপসারণ করে বড় ও উঁচু ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে; উজানে জাতীয় বাঁধগুলো অপসারণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়াও নদী রক্ষায় প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, ভিকটিমদের আইনী সহায়তা প্রদান করতে হবে, নদী ও এর পরিবেশ, প্রতিবেশ সুরক্ষায় প্রশাসনের মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আইনের যথাযথ প্রয়োগে বন্ধপরিকর হতে হবে, সকল মিডিয়াকে নদী বাঁচাও আন্দোলনসমূহের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে, স্থানীয় সুশীল সমাজ, সাংবাদিকদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম তৈরি, বিভাগের নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে এবং সকল নদীর একটি ডাটাবেইজ করতে হবে, সর্বোপরী, প্রত্যেকটি নদীর আইডি কার্ড প্রদান করতে হবে, নদীর হেলথ কার্ড দেওয়া, নদী দূষণকারী ও দখলদারদের নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়াসহ নানা সুপারিশ পেশ করেন তারা।