মালদ্বীপে নির্বাচন গড়ালো রান অফে

আহমদ মতিউর রহমান
মালদ্বীপ সার্কভুক্ত একটি মুসলিম-প্রধান দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে এখন টালমাটাল। দেশটি কখনো ভারতের পক্ষপুটে আবার কখনোবা চীনের পক্ষপুটে ছিল। এ নিয়ে দেশের নেতাদের ও প্রেসিডেন্টদের মধ্যে টানাপড়েন আছে। এক প্রেসিডেন্ট নিকট প্রতিবেশী ভারতের পক্ষপুটে থাকে তো পরের বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে চলে যান এ অঞ্চলের পরাশক্তি কমিউনিস্ট চীনের পক্ষপুটে। গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেই রকমের একটা সুইচ ওভার হতে যাচ্ছিল। কিন্তু ৮ প্রার্থীর কেউই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট অর্জন করতে না পারায় ভোট গড়াচ্ছে রান অফ বা দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে। মালদ্বীপের সংবিধান অনুযায়ী কোনো প্রার্থী ৫০ ভাগের বেশি ভোট না পেলে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হবে। শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে ওই নির্বাচনও হবে চলতি মাসেই।
আগে মালদ্বীপের রাজনৈতিক চিত্রটা তুলে ধরি, তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে। দেশটি ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘদিন শাসক করেছেন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইউম। মালদ্বীপ বলতে তাকেই চিনেছে বিশ^, চিনেছি আমরা। পরে আরেকটি দলের জন্ম হলে মোহম্মদ নাশিদের এই দলটি চ্যালেঞ্জার হয়ে দেখা দেয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে দায়িত্বও পান। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে চলেনি। উৎখাত হতে হয় তাকেও। তিনি গ্রেফতার হন। নানা জটিলতা কাটিয়ে এখন দেশটি একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এসেছে। নাশিদ এখন দেশটির পার্লামেন্টের স্পীকার। মামুন গাইউম অনেক আগেই দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছেন। এরপর মোহাম্মদ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হন। তার বিদায়ে প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহিম মুহাম্মদ সলিহ। নানা দুর্নীতির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনের ১১ বছরের কারাদ- হয়। ইয়ামিনের দল ও জোটের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মুহাম্মদ মুইজ। এই জোট ক্ষমতায় আসতে পারে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। এর মানে দাঁড়াচ্ছে দেশটিতে ভারতের প্রাধান্য আর থাকছে না। এর স্থলে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চীনের প্রাধান্য। আর জনগণের তাতে সায় আছে বলে ভোটের প্যাটার্নে মনে হচ্ছে। দেশে সৃষ্ট নানা সংকট ভোটারদের মনোভাব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এবার দেশটির কিছু ফ্যাক্টস। দেশটি মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক অফ মালদ্বীপ নামে পরিচিত। তবে আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ‘ধিবেহী রাজ্যে জুমহূরিয়া’ আর কথাগুলো লেখা আববির প্রভাবযুক্ত মালদিভিয়ান ভাষায়। এটা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। রাজধানীর নাম মালে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক জোট সার্ক এর সদস্য, আগেই বলেছি আর জোটটি এখন কার্যত অকার্যকর। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ দেশ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত, এটা আয়েরও প্রধান খাত। এ দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার। ভবিষ্যতে পুরো দেশ তলিয়ে যাওয়ার শংকায় আছে দেশটি। এক হাজার দুই শ’রও বেশি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। দেশটিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সরকারপ্রধান। প্রেসিডেন্টই মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। দেশটিতে অমুসলিমদের ভোটাধিকার নেই। ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে শূরা আছে। মেয়াদ পাঁচ বছর। এই ৫০ সদস্যের আটজন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত হন। এই একটি উপায়েই মহিলারা সংসদে প্রবেশের সুযোগ পান। দেশটিতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইউম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ দলের নাম ‘দ্য মালদ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’। একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয় ‘মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ হিসেবে। এভাবেই দেশটিতে বহুদলীয় রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। সংস্কৃতে মালদ্বীপকে লক্ষদ্বীপও বলা হয়েছে। এর অর্থ লক্ষ দ্বীপের সমাহার। মালদ্বীপ নামটি সম্ভবত “মালে দিভেহী রাজ্য” হতে উদ্ভূত যার অর্থ হল মালে অধিকৃত দ্বীপরাষ্ট্র। কারো কারো মতে সংস্কৃত ‘মালা দ্বীপ’ অর্থ দ্বীপ-মাল্য বা ‘মহিলা দ্বীপ’ অর্থ নারীদের দ্বীপ হতে মালদ্বীপ নামটি উদ্ভূত। আসলে মালদ্বীপ লক্ষ দ্বীপের সমাহার নয়; রয়েছে ২৬টি অ্যাটোল (লেগুন ঘেরা প্রবালদ্বীপ) ও ১১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ। কেবল ২০০টি বাসযোগ্য। সম্রাট অশোকের সময়ে খ্রিস্টীয় ৩য় শতকেই কতিপয় বৌদ্ধ ভিক্ষু নাকি গিয়েছিল লক্ষদ্বীপে। এরপর দ্রাবিড় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ওই দ্বীপে গিয়ে বাস করতে থাকে। দ্রাবিড় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সম্ভবত ওখানে গিয়েছিল দক্ষিণ ভারত থেকে। এরপর সিংহলীরা মালদ্বীপ যায়। এরা ছিল বৌদ্ধ। এরপর মুসলিমরা ঐ দ্বীপে মুসলিম সংস্কৃতি প্রোথিত করে। সময়টা দ্বাদশ শতক। ১১৫৩ থেকে ১৯৫৩ অবধি -এই ৮০০ বছর ৯২ জন সুলতান নিরবিচ্ছিন্নভাবে শাসন করেন দ্বীপটি। মালদ্বীপের জনসংখ্যা ২০২২ আদম শুমারি মতে ৫ লাখ ৩০ হাজারের মতো। আয়ের বড় উৎস পর্যটন ও মাছ শিকার। এই হলো সাধারণ কিছু তথ্য।
নির্বাচনী ফল কী হতে পারে তা রিপোর্ট করেছে আল জাজিরা টিভি। তারা বলেছে, দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে যাচ্ছে দেশটি তবে চীনপন্থী বিরোধী দলীয় প্রার্থী ভোটে এগিয়ে। ৯ সেপ্টেম্বর জাহিনা রশীদের করা আলজাজিরার প্রতিবেদনের শিনোনাম ছিল- Maldives election goes to run-off, with pro-China opposition leading. রয়টার্সের বরাত দিয়ে জাহিনা জানান, The Maldives appears headed for a run-off vote after the opposition candidate took a surprise lead over President Ibrahim Mohamed Solih, but fell short of an outright majority in a hotly contested presidential election. The vote on Saturday is being closely watched by India and China, both of whom are vying for influence in the Indian Ocean tourist destination.
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীই প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশের ভোট না পাওয়ায় নির্বাচন গড়িয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ফলে নিয়ম অনুযায়ী আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরে রানঅফ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। ৯ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণ শেষে প্রাথমিক ফলাফলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন এমডিপির প্রেসিডেন্ট মো. সলিহর থেকে প্রধান বিরোধী দল পিপিএম-পিএনসি জোটের প্রার্থী মুহাম্মদ মুইজ ৭ শতাংশ ভোটে এগিয়ে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরও আট প্রার্থীর মধ্যে কেউই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। আর এতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গড়িয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরে একটি রানঅফ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। দেশটির নির্বাচন কমিশন সরকারের পক্ষে কাজ করছে বলে অভিযোগ তোলে বিরোধী দলগুলো। তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন।
নেপথ্যে চীন-ভারত লড়াই : আল জাজিরা ও রয়টার্স বলেছিলÑ চীন ও ভারতের লড়াইয়ের আবহে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনে মোট আটজন প্রার্থী থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ এবং রাজধানী মালের মেয়র মোহাম্মদ ম্ইুজের মধ্যে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহ ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। আর মুইজ চীনপন্থী হিসেবে নজর কেড়েছেন। মালদ্বীপের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বানি সেন্টারের জরিপে সলিহকে সামান্য এগিয়ে থাকতে দেখা গেলেও প্রায় ৫৩ ভাগ ভোটার মুখ বুজে ছিলেন। তাদের ভোটের ওপরই নির্ভর করছিল ফলাফল। দেখা গেল এই ভোটিং এ চীনÑভারত লড়াই ছিল মূল ফ্যাক্টর। এতে আগামীতে মালদ্বীপে ভারতীয় আধিপত্য হ্রাস পেতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে। আর পরিস্থিতির উপর নজর রেখে চলেছে ভারত ও চীন দু’দেশই।
পাঁচ বছর আগে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন সলিহ। তিনি ছিলেন মহাজোটের প্রার্থী। কিন্তু নির্বাচনের পর ওই জোট ভেঙে গেছে। ওই সময় সলিহকে যারা জয়ী হতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিলেন তাদের অনেকে এখন তার তীব্র বিরোধিতায় নেমেছেন। ‘ইন্ডিয়া-ফার্স্ট’ নীতির অনুসারী সলিহ ভারতের কাছ থেকে বিপুল সহায়তা পেয়েছেন। তিনি পাশ্চাত্যের সাথেও সম্পর্ক নবায়ন করেছেন। কিন্তু অনেকেই অভিযোগ করছেন, তার আমলে দেশে দুর্নীতি নজিরবিহীন পর্যায়ে বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট মামলাও বেড়েছে। অন্যদিকে মুইজ ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনে দুর্দান্তভাবে জয়ী হয়েছেন। রাজধানী মালে সলিহর মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সেখানেই তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। এদিকে মুইজ ইতোমধ্যেই ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা চালিয়েছেন। চীনা-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মুইজ তার দেশ থেকে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি, ভারতীয় নজরদারি বিমান অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বিজয়ী হলে কতখানি করতে পারবেন, বিশ্লেষকরা সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। ৩০ সেপ্টেম্বরের রান অফ ভোটে সেটাই নির্ধারিত হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।