‘অধিকার’-এর আদিলুর ও এলানের দু’বছর করে কারাদণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছর করে কারাদ- দিয়েছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। একই সাথে তাদেরকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরো এক মাসের সাজার আদেশ দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশা করেছি তার সর্বোচ্চ সাজা হোক। কিন্তু আদালত দুই বছরের সাজা শুনিয়েছে। এতে আমরা রাষ্ট্রপক্ষে যথেষ্টভাবে সন্তুষ্ট হতে পারি নাই।” কারাগারে নেয়ার আগে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় আদিলুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।’
এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, বিতর্কিত ৫৭ ধারায় আজ এক স্বনামধন্য অধিকারকর্মীকে সাজা দেওয়া হলো, যেটা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে পুলিশী অভিযানের পর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছিল যে পুলিশের অভিযানে ‘বহু মাদরাসার ছাত্র নিহত’ হয়েছে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রচারণাও চালিয়েছিল সরকার বিরোধীরা।
তখন মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১জন নিহত হয়েছে। এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের তরফ থেকে। এরপর মামলা দায়ের করা হয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, "৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করে তিনি শুধু বাংলাদেশ না বরং সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন। এটা অত্যন্ত জঘন্যতম একটা অপরাধ করেছেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে।" তারা শাস্তি বাড়ানোর জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন বলে জানান।
এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন আদিলুর রহমানের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মামলা হয়েছে ২০১৩ সালে এবং এর নথি দেখানো হচ্ছে ২০২৩ সালে। মামলা কিভাবে প্রমাণিত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে অভিযান চালায়, সে ঘটনার প্রায় এক দশক পর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এই রায় ঘোষণা করা হলো। রায় ঘোষণার সময় আদালতে বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার পর্যবেক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তবে তারা এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। এর আগে গত ২৪ আগস্ট রাষ্ট্র ও আসামীপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ৭ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ধার্য করা হয়। তবে ওই দিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় সেটি ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে গতকাল ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয়।
২০১৩ সালের ৫ এবং ৬ মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে অসত্য তথ্য প্রচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয় মানবাধিকার সংগঠন, অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। এর জের ধরে একই বছরের ১১ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়েছিল তাকে। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
সেসময় পুলিশ জানায়, মানবাধিকার সংস্থা অধিকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা অসত্য এবং বিকৃত। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতের সংখ্যা ১৩ বলে জানানো হয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে তারা অধিকারের কাছে ‘নিহত’ ৬১ জনের নাম পরিচয় চেয়ে চিঠি দিলেও অধিকার তথ্য দিতে অস্বীকার করে।
আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা তার পাশে ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
২০১৩ সালের অগাস্টে আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতারের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা ঢাকায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের কার্যালয় পরিদর্শন করেন। সেসময় তার সাথে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, কানাডাসহ আরো কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরাও ছিলেন।
সেসময় অধিকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা ওই সংগঠনের সার্বিক অবস্থা এবং আদিলুর রহমান খানের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। একই সময়ে জাতিসংঘও এক বিবৃতিতে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। এছাড়া মামলা চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের মে মাস পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন আদিলুর। মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে ফ্রাঙ্কো-জার্মান মানবাধিকার পুরষ্কার পান তিনি। এছাড়া ২০১৪ সালে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য মার্টিন এনালস অ্যাওয়ার্ড পান আদিলুর রহমান খান।
২০২২ সালের জুনে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করলে তা নাকচ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। এর ফলে নিবন্ধন হারায় অধিকার সংস্থাটি। এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।