কবিতা
অরণ্যে অরুণোদয়
হেলাল আনওয়ার
গভীর সুপ্তির মাঝে
অবচেতনে দুহাত প্রসারিত করতেই
মুঠো মুঠো অন্ধকার
যা আমাকে বিষন্ন করে প্রতিটা সময়।
জন্ম হতে জন্মান্তর
অবারিত বাতাসের মৌ মৌ গন্ধে ভরা
নবান্নের সবুজ উৎসব
না, কিছুই জোটেনি স্বপ্নাচ্ছন্ন সুকোমল রাত।
মায়ের বুকের ক্রন্দন দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা আমার
কুনো ব্যাঙের মতো ভয়ে জড়োসড়ো
সৌম্য মূর্তির দেহখানা
বিছানায় শুয়ে শুয়ে সাহসেরা
বিকলাঙ্গ নপুংসকের মতো কেবল
তাকাতে থাকে পুবের আকাশে।
আটপৌরে সূর্যটা
কতোদিন হলো লুকিয়ে আছে ঘনকালো মেঘের আড়ালে
তল্পিবাহকেরা লুটে নিয়েছে নির্মল জোছনা।
এখন বাতাসে কেবল দীর্ঘশ্বাস
ত্বড়িৎ নিঃশ্বাস আসে আর যায়।
ঝুলবারান্দার প্রভাতি চড়ুইগুলো
ওয়াজেদ আলী কোনো খবরই রাখে না।
ব্যথার টিলার উপর দাঁড়িয়ে নবাগতের পথ চেয়ে
আপাতত তারা রাত কাটান।
মাশুকেরা আসবে, নিশ্চয়ই আসবে
এই ঘনঘোর অন্ধকার বিদূরিত করে
ওরা জাগাবে স্বপ্ন, অরণ্যে অরুণোদয়।
মনুষ্য রূপ
তুহীন বিশ্বাস
হাঁটতে তো সবাই পারে পথ চিনে ক'জন?
সম্পর্কে খুঁজে দেখ কারা তোমার স্বজন!
উপদেশ দিতে জানি, নিতে জানি ক'জন?
চেনা মুখ অচেনা কথায় হয়ে যায় দুর্জন।
সবার দোষ খুঁজে নিই নিজের দোষ নাই!
সরলতার সুযোগে আমরা সাধু হয়ে যাই।
এই জগতে কষ্ট বেশি মানুষ চিনতে পারা
ভালো মানুষ খুঁজতে তাই হচ্ছি দিশেহারা।
তুমি মানুষ? সেটা তুমি চরিত্রে প্রমাণ কর
ভালো কাজ করে তবেই মনুষ্য রূপ ধরো।
বৃষ্টি
মান্নান নূর
বৃষ্টি পড়ছে একাকী, এ-শ্রাবণ সন্ধ্যা রাতে
এ-দিনের সকাল-বিকাল-দুপুরে, বৃষ্টি ঝরছে
একাকী একাকী বিরহ নিঃসঙ্গ-
তার সাথে কেউ নেই, ঝিঁঝিঁ পোকহীন, জোনাক বিহীন অন্ধকারে
বৃষ্টি এ-বর্ষণ তান্ডব কাকে দেখায়?
খ্যাপা ষাঁড়ের মতো প্রচন্ড হুংকারে দাপিয়ে তেড়ে আসা
প্রচন্ড এ-রাগ দেখায় কাকে? এ-তান্ডব দেখে না কেহই-
না ফুল, না গাছের পাতা, না কোনো কুমারী মেয়ে-
নাহ! পাখিরাও নেই, চোখ বন্ধ করে শুনছে বৃষ্টির রিমঝিম গান
দেখছে না পাতারাও এলিয়ে দিয়েছে দেহ-
জাবর কাটছে গরু, আধখোলা চোখে বিলেতি কুকুর,
বিড়াল, ছাগল তারাও দেখছে না, মানুষ জন!
বন্দি ঘরে, দরোজা জানলা খুলছে না-
বৃষ্টির এই বাহারি যৌবন ভরা টইটম্বুরে কারোরই মনোযোগ নেই-
বৃষ্টি খ্যাপে গিয়ে আরো বন্যা নামায়।
এই শহর
সিদ্দিক আবু বকর
এই শহরে অনেকেই কবি হতে আসে
কেউ কেউ বিলবোর্ড দেয়াল ডিজিটাল সাইন পোস্টারের
ছবি হতে আসে
কেউ কেউ নিজেকে চিনতে কেউ আবার চেনাতেও
কেউ নরম চাঁদ কেউ বা তেজদীপ্ত গরম সূর্য হতেও আসে।
এই শহর আমার প্রতিবেশি
পেটের দায়ে খুব ভোরে
বিষাক্ত শিশার প্রাচীর ঠেলে আমিও শহরে ঢুকি
সারাদিন নিদারুণ চাপে দেয়ালে মাথা ঠুকি
পাষুটে সন্ধ্যায় রাজ্যের ভিড় ঠেলে ক্লান্ত শরীরে আপন ডেরায় ফিরি।
আমি অবশ্য কবি হতে আসি না, ছবি হতেও না।
পেটের দায়ের চাইতে কবিতা অতো ভালোবাসি না।
এই শহর প্রকৃতির মাসি না
এই শহর ভালোবাসি না।
মানুষ ও প্রেম
রবিউল রতন
এই শহরের প্রতিটি ইট-পাথরে ঘৃণার অঘুম মন্ত্র
দীর্ঘশ্বাসে পুড়ে আগুন হাওয়া:
রাত্রিজাগা বৃক্ষের পাতায় বীভৎস চিৎকার,
প্রতিটি জানালায় ঘৃণার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে!
এখানে কারো জন্য- কেউ নয়!
তবুও চিৎকার করে বলেছি- দেখ
জীবনের সব সঞ্চিত অর্থ ফুরিয়ে
ধূলির পল্লী পেরিয়ে;
তোমাদের শহরে হতভাগা- এই আমি।
আজ আমি বড্ড ক্লান্ত- ভীষণ ক্ষুধার্ত
আমাকে আশ্রয় দাও- দু'মুঠো অন্ন দাও,
তারপর ক্রমাগত সব জানালা বন্ধ!
আড়াল থেকে আসে থু-ছিঃ! চোখে অদ্ভুত আঁধার
রাত্রির কোটি কোটি আলোর থলে ছিঁড়ে আসে;
হিংস্র জানোয়ারের থাবা,
লালচোখ-জলাতঙ্ক দাঁত নখ, কুকুরের ঘেউঘেউ!
হে শহর- তোমার প্রেমকে মাটিচাপা দিয়ে,
আমি আবার ফিরে যাচ্ছি পল্লীর সরল সবুজে।
ভ্রম-অনল
নন্দিনী আরজু রুবী
মায়া কাটাবো বলে ক্লান্তির পাহাড় মুছে,
উপসংহারে জমিয়ে রাখি ---
নুনের ভিতর নিখুঁত রক্তপাত!
যত দূর দেখে চোখ, সইয়ে নিয়েছি
শোক আর ইতস্তত নখের বিস্তার...
ক্ষুব্ধ আগুনের বুকে বরফ গলিয়ে
নিংড়ে নিই দহন,
রোজকার উষ্ণ শ্বাস জিইয়ে ---
এই ক্ষীণ-আয়ু বসবাস।
অনাড়ম্বর সংসার চরিতকথা,
মেপে নিই অস্থির কাঁটায়।
পাঁজর হাতড়ে সস্তায় স্বস্তির খোঁজ তবু---
মোহ ছেনে তুলে নিই শুধু
আলোর গায়ে বিচিত্র গন্ধ আর
শ্যাওলার ধূসর পিপাসা...।
বর্ষাপ্রেম
সাগর আহমেদ
প্রতি বর্ষায় আমি প্রেমে পড়ি, প্রেমে পড়ি
বৃষ্টির রূপালি জলে ভেজা কদম-কেয়ার।
আমি প্রেমে পড়ি ভরাট নদীর বুকে
ভেসে যাওয়া ভিঙি নৌকার ছেড়া পালের।
প্রেমে পড়ি প্রশান্ত মহাসাগরের মতো
স্বচ্ছ ঢেউ খেলানো জল জলাশয়ের।
প্রেমে পড়ি ঝুম বৃষ্টিতে নুয়ে পড়া তরুলতার
প্রেমে পড়ি ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে বেড়ানো
কচুরিপানা আর কলমিলতার।
আমি প্রেমে পড়ি ফুটন্ত মায়াবী পদ্মের
প্রেমে পড়ি জ্যোৎস্নালোকিত রাত প্রহরে
বিলের জলে ফোটা শুভ্র শাপলা কিংবা
আমনের ধান ক্ষেতে ডাকা বুনোহাঁসের।
প্রেমে পড়ি বৃষ্টিস্নাত নিষ্পাপ লাজুক চোখের
গ্রাম শহরের ধূলিকণায় মাখা কাঁদা জলের।
প্রতি বর্ষায় গভীর মমতায় আমি কবিতা সাজাই
বিল জলাশয় জলে জলাময়ের।
মনখারাপের খোলা চিঠি
মমিনুল ইসলাম মমিন
জানালায় এখনো লেগে আছে তোমার -
আঙুলের স্পর্শ,
অনিন্দ্য নির্মল হাসি
আবেগী চোখের খুনসুটি
মনখারাপের খোলা চিঠি।
চোখের কার্নিশে শ্রাবণের বৃষ্টি
স্বপ্নগুলো সঙ্গিহীন
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ভিজে সারারাত
কষ্টগুলো হিমায়িত বরফের আদিম পাথর।
তুমি কার চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখেছো রঙিন
আঁচলে রোদ মেখে করেছো বসন্ত যাপন
অশুভ জ্যোৎস্নায় মাখছো শরীর
ডানামেলে উড়ছো অন্য আকাশে।
আমার একতারাতে এখন আর সুর ওঠে না
ছন্দহীন আঁধারে ডুবে দেখি তোমার কোলাহল।
সরিষা ফুল
বিচিত্র কুমার
হলুদ বর্ণের ঘোমটা পড়া কী অপরূপ মেয়ে
মিঠারৌদ্রের উষ্ণ ছোয়ায় থাকে আমার দিকে চেয়ে,
ইচ্ছে করে মনের কথা খুলে তাকে কই
মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে বলে ও আমার সই।
কি যে জ্বালা গেল বেলা একটু দূরে রই-
খিলখিলিয়ে হাসে পাখি তোমারটা কই?
লজ্জায় মুখ লাল টুকটুক বুকের মধ্যে ভীষণ অসুখ
সুদূরেতে লুকিয়ে রাখি মুখ।
হে আমার জন্মভূমি
ইয়াছিন আরাফাত
ভালো লাগা, ভালো লাগাই,শুধুই তাকে,
ভালো লেগে, ভালো লাগাই, যেই সবাইকে।
স্নিগ্ধ বাষ্পে ভরা হেই জন্মভূমি,
আমি তোমার কাছে আসি আবার ফিরি।
আমি তোমাকে আসিনি ছেড়ে।
হে আমার জন্মভূমি,
পারি না থাকতে কোথাও তোমায় ছাড়ি।