গণতন্ত্র ভালো, না সেনা শাসন!
মানুষ ভাবনা-বান্ধব প্রাণী। মানুষ ভাবতে ভালোবাসে, ভাবনাকে প্রশ্রয়ও দেয়। কিন্তু মানুষের ভাবনা তো একরকম নয়। ভাবনায় কত রকম, কত রঙ। ভাবনায় ভালো মন্দও আছে। ভাবনার পরিসর বা ব্যাপকতায়ও আছে পার্থক্য। কিছু মানুষ শুধু নিজকে নিয়ে ভাবে। কেউভাবে পরিবার ও সমাজকে নিয়ে। আবার দেশ ও বিশ্বকে নিয়ে ভাবার মতো মানুষও আছে এই গ্রহে। কালে-কালে, যুগে-যুগে মানুষের ভাবনার জগতে পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। আবার একই যুগে জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে মতপার্থক্য, মতবৈচিত্র্য। এ নিয়ে প্রবাদও আছে। যেমন- ‘নানা মুনীর নানা মত’। মানবজাতি এই পৃথিবীতে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছে। প্রস্তর যুগের কথা এখনো মনে পড়ে, লৌহ যুগের কথা মানুষ ভুলবে কেমন করে? আর এখন তো আমরা বসবাস করছি পারমাণবিক যুগে। এ যুগের ক্যারিশমা আছে, সবকিছুই দ্রুত করা যায়। দ্রুত গড়া যায়, দ্রুত ধ্বংসও করা যায়। এই যুগের বৈশিষ্ট্য হলো, লাভালাভের অঙ্কটা মানুষ খুব দ্রুত করে ফেলতে চায়। মস্তিষ্কটা খুব দ্রুত খেলে যায় এবং অন্তরের উপলব্ধিটা তেমন গুরুত্ব পায় না। মানুষ যে শরীর, মন ও আত্মার একটি সুসমঞ্জস অস্তিত্ব- শাশ্বত এই সত্যটি এখন মানুষ ভুলে গেছে। যে মানুষরা এখন সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব পরিচালনা করছেন, এখানে সেই মানুষদের কথা বলা হচ্ছে। যে মানুষরা নিজেদের খন্ডিত করে ফেলেছেন, শুধু মস্তিষ্কের কসরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা আত্মার আওয়াজ শুনবেন কেমন করে? তাঁরা তো চাতুর্যের চর্চায় ব্যস্ত, লাভের লালসায় তাঁরা এখন উন্মত্ত! বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বিশ্ব ব্যবস্থার লাগাম ধরে দাম্ভিক নেতারা এখন ভূ-রাজনীতি এবং মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ন্যায়-অন্যায় তাঁদের কাছে গৌন, মানব এবং মানবিকতা তাঁদের কাছে করুণার বিষয়। এমন সভ্যতায় মানুষ করে শান্তির সমাজ পাবে, পাবে কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র বা বিশ্ব। সবকিছুই তো আধিপত্য, আগ্রাসন ও বলয়ে বিভক্ত। কোনো কিছু কি স্বাধীন আছে? কোথায় ব্যক্তি স্বাধীনতা, কোথায় রাষ্ট্র বা জাতির স্বাধীনতা? তবে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে স্বাধীনতা ও মানবিকতার কথা যে উচ্চারিত হয় না, তা কিন্তু নয়। বহুলভাবেই উচ্চারিত হয়, তবে তা নাটক বা প্রহসনের মতো মনে হয়।
স্বাধীনতা শুধু বড় বিষয় নয়, মৌলিক বিষয়ও বটে। স্বাধীনতা ছাড়া যেমন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত বিকাশও সম্ভব নয় স্বাধীনতা ছাড়া। একারণেই হয়তো নবী-রাসূলদের বক্তব্যে স্বাধীনতার বিষয়টি এতো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ইসলামের নবীর মূলমন্ত্রই ছিল মানুষের স্বাধীনতা- ‘নেই কোনো প্রভু, এক আল্লাহ ছাড়া।’ বর্তমান সভ্যতায় তো মানুষের অনেক প্রভু। কোথাও পার্টিপ্রধান প্রভু, কোথাও অর্থ প্রভু, কোথাও মাদক ও সুন্দরী নারী প্রভু, কোথাও মারণাস্ত্র ও ভয়ভীতি প্রভু, কোথাও ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার প্রভু। কত রঙের, কত লেবাসের প্রভু এখন শাসন করছে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা ও সভ্যতাকে। শুধু সুবচনে বহুপ্রভুর এমন রাহুগ্রাস থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। তবে কাক্সিক্ষত মুক্তির সেই পথ প্রদর্শন করেছেন নবী-রাসূলরা। গভীর প্রত্যয়ে এক আল্লাহকে প্রভু মেনে অন্যসব ভুয়া প্রভুকে অস্বীকার করলে মুক্তিপথের অভিযাত্রী হওয়া সম্ভব। তবে বস্তুবাদী বর্তমান সেক্যুলার তথা ইহলৌকিকবাদী সভ্যতায় বিষয়টি বোঝা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন হবে নিজের সাথে কথা বলা এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।
বর্তমান সভ্যতার ভুলত্রুটি নিয়ে বহু উদাহরণ পেশ করা যায়। তবে ছোট্ট এই নিবন্ধে আজ শুধু আফ্রিকার উদাহরণ টেনে কথা বলতে চাই। বর্তমান সভ্যতায় গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এই ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত মুক্তি দিতে পারেনি মানুষকে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপতো একরকম ছিল না বিশে^, বরং এখানে লক্ষ্য করা গেছে নানা রকমফের। এ কারণে দুর্ভোগের ক্ষেত্রে মাত্রার তারতম্য ছিল। বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যুত্থানে জনসমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলে কি গণতন্ত্রের বদলে সেনাদের স্বৈরশাসন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে? মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলী বঙ্গো। গত ৩০ আগস্ট বুধবার সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, এখন গৃহবন্দী। বঙ্গো তার পক্ষে আওয়াজ তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি জনগণ। বরং রাজধানী লিব্রেভিলসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করেছে সাধারণ জনগণ। কারণও স্পষ্ট। আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ এ দেশটি এক যুগের বেশি শাসন করেছেন বঙ্গো। বিপুল বৈভব আর ঐশ^র্যে দিন কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নজর দেননি। ফলে জনগণও তার ডাকে সাড়া দেয়নি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আফ্রিকার দেশগুলোতে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটছে? আর উত্থান ঘটছে নতুন নতুন সেনা শাসকের। ২০২০ সাল থেকে আফ্রিকায় ১০টি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং তাদের পক্ষে উল্লাস করেছে ওইসব দেশের মানুষ। গ্যাবনের আগে গত ২৬ জুলাই নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। সেখানেও জেনারেলদের সমর্থনে রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। এর আগে ২০২১ সালে অভ্যুত্থান হয় গিনিতে। সেখানেও সাধারণ মানুষ সেনাদের ক্ষমতা দখল উদযাপন করে। ফলে প্রশ্ন জাগে, মানুষ কি সামরিক শাসন পছন্দ করছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি আসলে এরকম নয়। বরং আফ্রিকায় গণতন্ত্রের নামে যে বেসামরিক শাসন চলছে, তাতে সাধারণ মানুষ হতাশ। ফলে সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে তাদের যে আশাবাদ, তা আসলে হতাশারই প্রতিফলন। লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচীর ফেলো লিনা কোফি হফম্যান বলেন, সাধারণ মানুষ যে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে, ব্যাপারটি সে রকম নয়। তারা মূলত অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিদের ক্ষমতার পালাবদলে খুশি হচ্ছে। আফ্রিকায় তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। আসলে কথা-কাজে মিল না থাকলে আস্থা অর্জন করা যায় না। এই প্রসঙ্গে আমরা ইতিহাসের উদাহরণ টেনে কথা বলতে পারি। ‘মদীনা সনদ’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এই সনদের নেতার কথা-কাজে মিল ছিল। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য শান্তি, নিরঙ্কুশ ন্যায় এবং উন্নয়নের আশ^াস দিয়েছিলেন। কথা অনুযায়ী কাজ হওয়ায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত একটি জনপদ পরিণত হয়েছিল শান্তি ও উন্নয়নের এক আবাসভূমিতে। এমন সফলতার নায়ক ছিলেন মানুষের নেতা হযরত মোহাম্মদ (স.)। বহু প্রভুর বদলে তিনি ছিলেন এক প্রভুতে বিশ^াস। এই প্রভুর কাছে জবাবদিহিতার চেতনাই ছিল তার সাফল্যের চাবিকাঠি।