দায়িত্বের খেয়ানত করা যাবে না
সৃষ্টিজগতের নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে চলবে সেআইন বা সূত্র অনুসারে। সূর্যে হাইড্রোজেন দহন হয়ে হিলিয়ামে পরিবর্তিত হবার মাধ্যমে যে আলো ও উত্তাপ তৈরি হয়, তারও সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সে নিয়মের জন্যই সূর্যের সব হাইড্রোজেন একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয় না। একইভাবে মানবসভ্যতাও ক্রমশ পরিপূর্ণতা লাভ করছে সুনির্দিষ্ট আইনের বিধান ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে। বৃটানিকার তথ্যানুযায়ী খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গ্রিক আইনপ্রণেতা সোলন প্রথম এথেন্সকে আইনের আওতায় আনতে পরিকল্পনা করেন। একইভাবে, খৃস্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকে একটি রোমান কমিশন এবং চতুর্থ শতকে এরিস্টটল আইনের একটি মডেল সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করেন। সুতরাং প্রাচীনকাল থেকেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। এক্ষেত্রে বলতেই হয় ইংল্যান্ডের কথা। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস-এর আইনি ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। অতীতের কিছু কিছু আইনি ব্যবস্থা ছিল বিস্ময়কর। যেমন দ্বাদশ শতকের শেষপর্যন্ত ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা দিতে হতো। অভিযুক্তকে একটি তপ্ত লোহার পাত হাতে তুলে নিতে অথবা ফুটন্ত পানির কড়াই থেকে একটি পাথর তুলে নিতে হতো। এতে অভিযুক্তের হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হতো। যদি তার হাতের ক্ষত তিন দিন পর নিরাময় হতে শুরু করতো, তবে মনে করা হতো ভগবান তার পাশে আছে। তার মানে অভিযুক্ত নিরপরাধ। এভাবে অভিযুক্তকে তার অপরাধহীনতা প্রমাণ করতে হতো। পরবর্তীতে এ ধরনের অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে বিচার নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ কথিত আছে, হরিণ হত্যার জন্য অভিযুক্ত ৫০ জন অপরাধী এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং ১২১৬ সালে এ ধরনের বিচারের নিন্দা শুরু হয়। আরও পরে ইংল্যান্ডে বিচারকরা ধীরে ধীরে রাজা এবং সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। আর এভাবে সকলের জন্য সমান আইন ক্রমশ তখনকার ইংল্যান্ডে চালু হয়।
আধুনিক রাষ্ট্র মনে করে, আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্রের সুনীতি। তবে সমস্যা হলো, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এখনও আধাসামন্তবাদী মানসিকতা দূর হয়নি। এ সব বিষয় নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা মনে করেন, বহু যুগ ধরে উন্নয়নশীল বিশ্বের সমাজ গড়ে উঠেছে অরাজকতা ও নৈরাজ্যের ভেতর দিয়ে। এ জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একটি জাতির নিয়মতান্ত্রিক সুষ্ঠু বিকাশধারার জন্য তৈরিকৃত প্রতিষ্ঠান যতই বলা হোক তা নিয়মের মধ্যে চলবে, তা আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। আরেকটি সমস্যা হলো, উন্নয়নশীল বিশ্বে শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতরাও মনে করেন, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা করতে পারেন না, এমন কোনও কাজ নেই। কোথাও যদি আইন বা নিয়মকানুনকে যখনতখন পাস কাটানো হয় অথবা তার অপব্যবহার করা হয়, তাহলে তা হয়ে উঠতে পারে একটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর এবং আধুনিক হবার পথের সবচাইতে বড় বাধা। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন, আল্লাহ তার কোনও বান্দাকে যদি মানুষের জন্য দায়িত্বশীল হিসেবে নিযুক্ত করেন, অতঃপর সেব্যক্তি যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব খেয়ানত করে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন। তার মানে জানতে হবে নিজেকে। জানতে হবে নিজের সীমাবদ্ধতাকেও। অন্যথায় সমাজশৃঙ্খলা বিঘিœত হবে। মানুষ হয়ে উঠবে বেপরোয়া এবং অবাধ্য। ঘটবে যুদ্ধবিগ্রহ আর বইবে রক্তগঙ্গা।