ঘাসফড়িঙের দূরদর্শিতা

হাফিজুর রহমান
ঘাসফড়িং এসেছিল শালবনের রাজা বাঘ, ওরফে শালপতির বাড়িতে বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে।
বিশাল আয়োজন, শালপতির একমাত্র মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে না হলে, কী করে হয়।
শালবনসহ আশপাশের ছোট বড়ো বনের সকল বন্যপ্রাণীকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল, রাজা শালপতির পক্ষ থেকে।
কাছের ও দূরের বন্যপ্রাণীগুলো দলেদলে এসে জড়ো হচ্ছে, রাজা শালপতির নির্দেশিত ফাঁকা মাঠে। সকলকে একসাথে পরিবেশন করা হবে, যে প্রাণীর যা পছন্দ সেই অনুযায়ী খাবার। শিয়ালের জন্য মুরগী, বানরের জন্য ফল, বনবিড়ালের জন্য কবুতর ইত্যাদি - ইত্যাদি।
দাওয়াত খেতে এসে ঘাসফড়িংগুলো দেখল, তাদের পছন্দের খাবার আয়োজনের কোন ব্যবস্থা এখানে নেই। এরকমটা দেখে ওরা মনঃক্ষুণœ হলো, হতাশও হলো বটে, অপমানের পাকাপোক্ত ব্যবস্থাপনা বুঝতে পেরে।
ঘাসফড়িংদের মধ্য থেকে একজন রাজামশাই, অর্থাৎ শালপতির কাছে গিয়ে বলল, "মহাশয় মেয়ের বিয়ের জন্য খুব উন্নতমানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, দাওয়াত খেতেও এসেছে সকলে, পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা দেখে আমরা সত্যিই আবিভূত! মজার বিষয় হলো, জাতি ভেদে পছন্দের খাবারের ব্যবস্থাও রেখেছেন, কিন্তু আমাদের পছন্দের কোন খাবারের ব্যবস্থা এখানে নেই, তাহলে আমরা কী খেয়ে, আপনার দেয়া নেমন্তন্ন পালন করব?"
তাচ্ছিল্যের সুরে শালপতি বলল, "তোমরা অতিশয় ক্ষুদ্র প্রাণী, তোমাদের জন্য আর কী আয়োজন করব! এর থেকে তোমরা একটা কাজ কর, আমার আমন্ত্রিত অন্য অতিথিরা তোমাদের থেকে আকারে অনেক বড়, ওদের গায়ে দেখবে অসংখ্য ছোট ছোট পোকামাকড় আছে, ওগুলোই ধরে ধরে তোমারা খাও, অনেক মজা পাবে, আর আমার অতিথিরাও বেশ আরাম পাবে। ধরে নাও এটাই তোমাদের জন্য চমৎকার আয়োজন।"
শালপতির কথা শুনে ঘাসফড়িংগুলো খুব ক্ষুব্ধ হলো, কেউই খুশি হতে পারল না। ওরা দলবদ্ধ হয়ে অন্য প্রাণীগুলোর সামনে জড়ো হলো। ঘাসফড়িংগুলোর মধ্য থেকে একটি বয়স্ক ঘাসফড়িং সকলের উদ্দেশে গলা উঁচু করে উচ্চস্বরে বলল, "সুপ্রিয় বন্ধুগণ, আমরা আপনাদের থেকে আকারে অনেক ছোট্ট প্রাণী। ছোট্ট হলেও একটি বড়ো ও অতি মূল্যবান কথা আপনাদেরকে বলতে চাই, অবশ্য যদি আপনাদের শোনার আগ্রহ না থাকে, তাহলে আমি বলব না।
অতিথি প্রাণীগুলোর মধ্যে কিছুটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ হাসি-ঠাট্টায়ও মেতে উঠল কিছুটা, এরপরেও ওদের মধ্য থেকে শিয়াল প-িত বলল, " বলো বলো কী তোমার মূল্যবান কথা? আমরা সকলেই শুনি।
ঘাসফড়িং নেতা সবথেকে উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, "তবে শুনুন বন্ধুগণ, আমাদের রাজা শালপতির মেয়ের বিয়ে কোথায় ঠিকঠাক হয়েছে, আপনারা কি কেউ জানেন?"
সকলে না সূচক জবাব দিল, ঘাসফড়িং নেতা পুনরায় বলতে শুরু করল, "শালপতির মেয়ের বিয়ে হবে, সেগুনবনের রাজা বাঘ, অর্থাৎ সেগুনপতির একমাত্র ছেলের সাথে। বিয়ের আলোচনায় সেগুনপতির ছেলের সাথে শালপতির মেয়ের বিয়েতে রাজি হয়েছেন একটি বিশেষ শর্তে। শর্তটি হলো শালপতি যদি সকল বন্যপ্রাণীকে তৃপ্তি সহকারে কোন ধরনের উপঢৌকন না নিয়ে খাওয়াতে সক্ষম হয়, তাবেই তার ছেলের সাথে শালপতির মেয়ের বিয়ে হবে। বন্ধুগণ, সেই কারণেই আমাদের রাজা শালপতি আমাদেরকে নেমন্তন্ন করেছেন।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সেগুনবনের রাজা সেগুনপতি খুবই খারাপ প্রকৃতির, ঐ বনের বাঘ ছাড়া অন্য সকল বন্যপ্রাণী খুব খারাপ অবস্থায় আছে, ভীষণ অত্যাচারের শিকার ওরা, বেঁচে থাকাটা ওদের জন্য খুবই কষ্টকর। বাঘের সামনে পড়লেই রক্ষে নেই, ধরে ঘাড় মটকায় আর, হাড় মাংস ছিড়ে ছিঁড়ে খায়।
শালপতির একমাত্র মেয়ের সাথে সেগুনপতির ছেলের বিয়ে হলে, সেগুনপতি আমাদের বনেও আধিপত্য বিস্তার করবে। তখন আপনাদের অবস্থা, ভেবে দেখুন তো কেমন হবে?
আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম, এখন আপনারাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবেন। এই বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়া ঠিক হবে কি না? ঘাসফড়িং এর কথা শুনে সকলের চোখ কপালে উঠলো, বুঝতে পারল সকলে, ঠিক কথাই তো বলেছে ঘাসফড়িং, আকারে ছোট্ট হলেও অনেক বেশি মূল্যবান কথা। আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে, যে যার মতো চলে গেল সবাই, না খেয়েই!
শালপতির মেয়ের সাথে সেগুনপতির ছেলের বিয়ে ভেঙে গেল। শালপতি বুঝতে পারল, কাউকে ছোট ভাবাটা মস্তবড়ো ভুল। ঘাসফড়িংদের সাথে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা না বললে, হয়তো এতটা ক্ষতি হত না - বাঘ পরিবারের, এভাবে কখনও হতো না শোচনীয় পরাজয়।