মৃত্যু ৩০০ ছাড়ালো, হাসপাতালে ভর্তি ২৪৯৫
তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : রাজধানী ঢাকা থেকে যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনপদ-কোনটাই এবার বাদ নেই, বাদ পড়েনি। সর্বত্র ডেঙ্গুর প্রকোপে কাঁপছে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু এতোটাই বেসামাল হয়ে পড়েছে যে, মৃত্যু ও আক্রান্তের হার বাড়ছেতো বাড়ছেই। এই বাড়ার কারনে নিকট অতীত ইতিহাস‘র রেকর্ড ছাড়িয়েছে কয়েকদিন আগেই। এখনও পিক সিজন শেষ হয়নি, সবে মাত্র শুরু। পিক সিজনের আগেই মরার সংখ্যা আক্রান্তের সংখ্যা পুরনো রেকর্ড ছাড়িয়ে। চলতি আগস্ট মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গুর এই পিক সিজনে কোন ধরনের রেকর্ড গড়বে, তা কল্পনাতীত। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের সর্বত্রই স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা প্রচেষ্টা চালালেও কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি দৃশ্যত সিটি কর্পোরেশনের আয়ত্তে নেই। দেশজুড়ে ডেঙ্গুর এই বেসামাল বিস্তারের কারণে জনজীবনে আর্থিক টান পড়ছে, হিমশিম অবস্থায় পড়ে জীবনযাত্রা জেরবার।
মৃত্যু ৩০০ ছাড়ালো, হাসপাতালে ভর্তি ২৪৯৫
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০৩ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৯৫ জন। এর আগে গত ৩০ জুলাই একদিনে দুই হাজার ৭৩১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন, যা একদিনে এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, শুক্রবার (৪ আগস্ট) সকাল ৮টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৪৯৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক হাজার ৬৯ জন ও ঢাকার বাইরের এক হাজার ৪২৬ জন। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১০ জনের মধ্যে সাতজন ঢাকার বাসিন্দা। তিনজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ৯৬৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৪ হাজার ৫২৩ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৩৩১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৯ হাজার ৬০২ জন এবং ঢাকার বাইরের ২৪ হাজার ৭২৯ জন।
এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
নানা উদ্যোগেও বাগে আসছে না মশা : দেশে দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে নিয়মিত অভিযান, ফগিংসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালালেও ফলাফল শূন্য। কোটি কোটি টাকা খরচ করে মশা নিধনে ব্যর্থ হয়ে এবার ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) নামে কীটনাশক ব্যবহারের উদ্যাগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু রোগী কাগজে কলমে পাওয়া গেলেও পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে মে মাসের শেষ দিকে। রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে জুলাই মাসজুড়ে। চলতি মাসেও ঊর্ধ্বমুখী আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার।
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও দুই সিটির নানা উদ্যোগ বাস্তবে তেমন একটা কাজে আসছে না। শুধু এবারই নয়, প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে নানা কর্মসূচি নেয় দুই সিটি। বাড়ানো হয় বাজেটও। তারপরও সংস্থা দুটি মশা মারার ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা পায়নি। গত অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সংস্থা দুটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মশা নিয়ন্ত্রণে ১৬৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে ডিএনসিসি। উত্তরের তুলনায় এবারের বাজেটে ঢাকা দক্ষিণে মশা নিধনে বরাদ্দ কম। দক্ষিণ সিটিতে চলতি অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা।
মশা নিধনে শত কোটি টাকা ব্যয় করার পরও আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নাগরিকরা। তাদের অভিযোগ, মশা নিধনের নামে প্রতিবছর শত কোটি টাকা খরচের কথা বলছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। তারা সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না অথবা তারা মশা মারার নামে টাকা নয়ছয় করছেন। নিয়মিত মশা মারার বিভিন্ন কর্মসূচির কথা জানাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। এত কর্মকা-, এত চেষ্টার পরও মশা মরছে না কেন? নাগরিকদের এই প্রশ্নের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তার উত্তর খুঁজছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম নিজেও। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের দাবি, তারা মশা নিধন কার্যক্রমে পুরোপুরি সফল।
ঢাকার দুই মেয়রের এমন বক্তব্য ভিন্ন বার্তা দেয় বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অধিকাংশ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। অনেক হাসপাতালে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন পদ্ধতিতে ত্রুটি আছে। মশার ধরন বুঝে জায়গামতো ওষুধ প্রয়োগ না করায় সুফল মিলছে না। এজন্য মশা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। যদিও এখন এ বিষয়ে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা অনেক তৎপর।’ তিনি বলেন, ‘আগে ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ এডিস মশা জন্মাতো নির্মাণাধীন ভবনে। সিটি করপোরেশনের অভিযানে সেটি এখন ১৯ ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু, এবার গবেষণায় আমরা ৪৩ ভাগ মশা পেয়েছি বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনে। আমরা দেখেছি, মাল্টিপারপাস ভবনের যেসব জায়গায় পানি জমে এডিস মশা জন্মায়, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন ও সংশ্লিষ্টরা যায় না। ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে।’
চলতি বছর থেমে থেমে বৃষ্টিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন কবিরুল বাশার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। লাগাতার ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা বংশবিস্তার করত। এখন সারাবছরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা আছে। নাগরিকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।’
গুলশানের নগর ভবনে গত ২৪ জুলাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা নিধনের জন্য ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ডিএনসিসির হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি বছর তথা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে বরাদ্দের হার ৬১ শতাংশ বেশি। এছাড়া, মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে চলতি অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তা আগের চেয়ে ১০০ শতাংশ বেশি। এর বাইরে চলতি অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারে আরও ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, গত ৩১ জুলাই ডিএসসিসির নগর ভবনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সংস্থাটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বাজেটে মশক নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কিনতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার/ হুইল/স্প্রে-মেশিন পরিবহনে ৩ কোটি ৭৫ কোটি টাকা ও মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।
সিটি করপোরেশনের আয়ত্তে নেই : মশা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি এখন আর সিটি কর্পোরেশনের একার আয়ত্তে নেই বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। এক্ষেত্রে মশার বিস্তার ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সেইসাথে সিটি কর্পোরেশনকে সারা বছর মশা নিধন অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, “ডেঙ্গু সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে না। কোন দেশ পারেনি। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যেটা সিটি কর্পোরেশন একা পারবে না।” এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে তিনি প্রত্যেকটি বাসাবাড়ির ছাদে, আঙিনায় কিংবা অন্য কোনো খানে যাতে এডিস মশা জন্মাতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন।
গত ১৮ই জুন থেকে ২৭শে জুন পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে এক জরিপ পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ৫৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানানো হয়। ডিএনসিসির ৪০টি ওয়ার্ড ও ডিএসসিসির ৫৮টি ওয়ার্ডের ৩,১৪৯টি বাড়িতে জরিপ চালিয়ে সেখানকার ৫৪৯টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে, এই মুহূর্তে ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে এডিস মশা দূর করতে ফগিং ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা বের করে, ওই ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশে ফগিং করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ এই উড়ন্ত মশাগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেন এতো মারাত্মক হয়ে উঠলো?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, “আসলে গত বছরের সঙ্গে এই বছরের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আসার ক্ষেত্রে কোন বিরতি ছিল না। শীতকালেও আমরা রোগী পেয়েছি। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার এক দেড় মাস আগে থেকেই আমরা অনেক বেশি রোগী পাচ্ছি।”
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। “আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। ২০০০ সালের আগে আগে আমরা দেখেছি, মানুষজন একটা ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো। ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতো। কিন্তু যখন মানুষ চারটা ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন কাজ করে না। তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেড়ে যায়,’’ তিনি বলছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা বলেছেন, দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। তবে প্রতিটি হাসপাতালেই এখন ডেঙ্গু কর্নার আছে। প্রতিটি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও আমরা চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত আছি।
গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর এরকম সংক্রমণ চলার পরেও সেটা ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোন ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, ‘’ডেঙ্গু মোকাবেলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ, কিছুদিন পরেই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোন ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু রোগটা একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। এটা যে একটা মহামারি, সেরকম করে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।‘’
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগটি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা, নজরদারি নেই। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে আসছে। কিন্তু এর বাইরেও যে বিপুল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য কোথাও নেই। মশা দমনেও দেশ জুড়ে বড় ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা আছে কিনা, তাও কারও জানা নেই। তিনি বলছেন, ‘’সেই সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। শহরে গ্রামে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া পানি জমে যাওয়া, নগরায়নের ফলে পানি আটকে থাকার কারণে ডেঙ্গু মশা বেড়েছে, ফলে রোগীও বেড়ে গেছে।‘’
ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে ভাবছে সরকার : ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে দেশে গবেষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি সরকারের বিবেচনাধীন বিষয়। গতকাল শনিবার বিএসএমএমইউর কনফারেন্স রুমে ‘ডেঙ্গু বিরোধী সামাজিক আন্দোলন চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এটি স্ট্রেইন নির্ভর। যেহেতু ডেঙ্গুর একাধিক স্ট্রেইন একটিভ রয়েছে। ফলে কোনটা কার্যকর হবে সেটি গবেষণা প্রয়োজন। বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ব্যাপারে গবেষণা করে তৈরি করার ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেবো। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগকে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্যও বলেন তিনি।