লোভের পরিণতি

রুহুল আমিন রাকিব
টাপুর টুপুর শব্দে বৃষ্টি পড়ছে; আষাঢ় মাস বলে কথা! রহিম মিয়ার চোখ আষাঢ়ের নতুন পানির মতো চক চক করে উঠে। দুই'চালা টিনের ঘরে বসে, জালনা খুলে বাড়ির উত্তরে তাকায়। আহা! দু'দিনের টানা বৃষ্টিতে ভেলা খোওয়ার মাঠ এখন চকচক করছে।
মা জুড়ে পানি আর পানি! রহিম মিয়া মনে মনে ফন্দি আটে, নতুন পানিতে এবার অনেক মাছ ধরবে। মাছ ধরা'টা যদিও পেশা নয়, তবে ছোট্ট বেলা থেকে এক রকম নেশায় পরিণত হইছে। মিনা বেগম গরম ভাতের প্লেট হাতে নিয়া ডাক দেয়, বাজানের বাপ অনেক বেলা হইছে তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়া লন।
দু'দিন ধরে সাদেক মিয়া বলে আসছে ওনার গাছের ডালগুলো কেটে দিতে। তবে বৃষ্টির কারণে ঘর থেকে বাহির হওয়া দায়, কাজকাম'ত অনেক পরের কথা। তবে আজ বৃষ্টি একটু কম, রহিম মিয়া মুঠো ভরে ভাত মুখে তুলে আর মনে মনে ভাবে! আজ কাজ করে নগদ নগদ টাকা নিয়া বন্দর থেকে আরো কিছু নতুন কারেন্ট জাল কিনে আনবে। রহিম মিয়া সহজ সরল মানুষ। এমন কোন কাজ বাদ নেই যা করতে পারে না। আশেপাশের ক'য়েক গ্রাম জুড়েও বেশ সুনাম আছে।
খুব কর্মঠ মানুষ, সহজে বসে থাকে না। একটাই মাত্র ছেলে আর ছেলের মা। এই তিন জন নিয়ে ওনার সংসার। ছেলেটা এবার সবে মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। যদিও ছেলের নাম রাখছে রাছেল,তবে বাজান বলেই ডাকে সবাই। রহিম মিয়ার জমিজমা কিছু নেই, এমন কি নিজের একটু ভিটেমাটিও নেই ঠাঁই নেয়ার মতো।
যে'তিন শতাংশ ভিটেমাটি বাবার কাছ থেকে ভাগে পাইছে। রাছেল জন্ম নেয়ার কালে, মিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করছে। তাড়াতাড়ি করে ভাত খাওয়া শেষ করে সাদেক মিয়ার বাড়ি যায় রহিম মিয়া। সারাদিন কাজ করে বিকেল বেলা কাজের টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে। মিনা বেগমের কাছে লুঙ্গি চায়, পুকুর ভরা পানিতে মনের সুখে ডুব দিয়ে গোসল করে। পিঠ কালো শরীর জুড়ে সরিষার তেল মাখে আর মিনা বেগম'কে ডাক দেয়।
আজ বন্দর থাইকা কোন প্রকার বাজার খরচ আনবে না এই কথা বইলা দেয়। রহিম মিয়ার মুখের কথা কাইড়া নিয়া মিনা বেগম বলে। চারদিন ধরে ঘরে কোন কাঁচা বাজার নাই। কুপি জ্বালার মতো তেলও নাই। বাজানে রাত করে পড়ায় বসতে পারে না। স্কুলের স্যারে না কি বাজানরে বলছে ওর আরো দু'টা অঙ্ক খাতা লাগবে।
আর আপনি কি না বলছেন বন্দর থাইকা বাজার সদাই কিছুই আনবেন না! আপনি যে আজ কাজ করলেন এই টাকা দিয়ে কি করবেন? কথা শুনে রহিম মিয়া সব বুঝিয়ে বলে। নতুন কারেন্ট জালে অনেক বেশি মাছ ধরা পড়বে। একদিন মাছ বিক্রি করলে বাজানের খাতা কেনার টাকা হয়ে যাবে। তুমি কোন চিন্তা করো না বাজানের মা! নতুন জাল কিনে আনলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। মাছ খাওয়াও হবে আবার বাকি মাছ বিক্রি করে টাকাও আয় করা হবে। বিকেল থেকে আকাশ ফকফকা বৃষ্টিও নেই। রহিম মিয়া পায়ে হেঁটে উলিপুর বন্দরে যায়। কারেন্ট জাল কিনে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরে। মনে মনে কল্পনা করে মজনু মিয়ার দিঘির উত্তর পাড় ঘেঁষে জাল পাতবে। দিঘিতে অনেক বড় বড় মাছ আছে। নতুন পানি পেয়ে কিছু মাছ না কি লাফিয়ে লাফিয়ে পুকুর থেকে মাঠের পানিতে চলে আসছে! তাছাড়া আজ রাতেও না কি প্রচ- বৃষ্টি হবে! বৃষ্টি এলে মাছেরা মনের আনন্দে দৌড়া দৌড়ি করে পুরো পুকুরজুড়ে।
তবে জাল পাততে হবে সাবধানে, কোনভাবেই যেন কেউ জানতে না পারে। কারণ নতুন জাল বলে কথা, কে না কে আবার চুরি করে নিয়ে যাবে। রহিম মিয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রাত একটু বাড়লে তবেই জাল পাততে যাবে। রাত একটু গভীর হলে রহিম মিয়া টর্চ লাইট আর কারেন্ট জাল সাথে নিয়ে আস্তে আস্তে মজনু মিয়ার পুকুরের উত্তর পাড়ে যায়। হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে গাছের সাথে ঝুলে রাখে। পরনের লুঙ্গি কমরের উপরে গুছিয়ে বাঁধে। কারেন্ট জাল হাতে নিয়ে হাট পানিতে নামে। মনের আনন্দে জালের এক মাথা খুঁটির সাথে বাঁধে। আপন মনে জাল ছেড়ে দিতে দিতে এগিয়ে চলে।
হঠাৎ করে বাম হাতের আঙ্গুলে কি'সের যেন একটা কামড় অনুভব করে! প্রচ- রকম সে'কামড়ের ব্যথা!
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নতুন পানির বুকে সাঁই সাঁই শব্দে এগিয়ে চলছে বিশাল বড় লম্বা একটা সাপ। রহিম মিয়ার বুঝতে বাকি থাকে না এই সাপে-ই ওনার হাতে কামড় বসিয়ে'ছে। হাতের জাল ফেলে দিয়ে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে দৌড়ে আপন বাড়িতে চলে। কামড়ের ক্ষত জায়গা দেখিয়ে ধপাত করে মাটিতে পড়ে যায়। মিনা বেগমের কান্নার আওয়াজ শুনে আশে পাশের মানুষ ছুটে আসে। তাড়াতাড়ি করে,কাপড় দিয়ে হাতের কব্জির উপরে বেঁধে দেয়। সেদিন রাতেই রহিম মিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে হাসপাতালে নেয়ার অনেক আগেই মারা যায় রহিম মিয়া।
গাঁয়ের সবাই বলা বলি করে রহিম মিয়া অতি লোভ করতে গিয়ে আজ এই পরিণতির শিকার হলো।
আবার কেউ কেউ বলে রাতের আঁধারে চুরি করে মাছ ধরতে গিয়ে আজ এই পরিণতি।