আইফোন

নুশরাত রুমু
সকালের ঘুমটা মাটি হলো জহিরের ফোন এসে, একটানা মোবাইলটা বেজেই চলেছে। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুলতে হলো।
হ্যালো...
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো চম্পা।
এখনো ঘুমোচ্ছিস্ত
পারছি কই! ফোন করেই চলেছিস।
হ্যাঁ, একটা কাজের খবর পেলাম। অন্যদের ভরসা নেই, তোকেই যেতে হবে। রিস্ক বেশি। বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে।
উঠতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ধরে আছে।
আরে বিয়েবাড়ি! মওকার অভাব হবে না।
তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলো চম্পা। ঘুম উধাও। পূর্ণ চোখে তাকিয়ে ঠিকানা চাইলো জহিরের কাছে।
আমি সহ যাবো তো, যেতে যেতে সব বলব। আসছি আমি, রেডি হয়ে নে..
ফোনের উলটো পিঠে তাকিয়ে অতীতে ফিরে গেল চম্পা।
জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
চম্পা তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। হঠাৎ করে আ্যাকসিডেন্টে মারা যায় তার বাবা। সেই শোক সংবাদ সামলাতে না পেরে চম্পার মা স্ট্রোক করে বসেন। শরীরের ডান অংশ অবশ হয়ে যায়। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে তাদের পরিবার। চম্পা কোনোমতে এসএসসি পাশ করেছিল।
তারপর পড়াশোনাটা আর এগোয়নি। সময়ের পারিপার্শিকতায় বদলে যায় সে। সমাজের কুটিল অভিজ্ঞতার দাপটে খুলে পড়ে তার বাবার দেয়া আদর্শের চাদর। মায়ের অথর্ব হয়ে পড়ে থাকা সহ্য হচ্ছিলো না চম্পার।
বয়সের দোলায় এর মাঝে জহির আসে ওর জীবনে। টাকার কষ্টে হুমড়ি খেয়ে পড়া চম্পাকে টেনে তুলল জহির। প্রথমে চাকরির অফার দিলেও পরে পারিবারিক অবস্থা জেনে টাকা ধার দেয় চম্পাকে। আস্তে আস্তে পারিবারিক যোগাযোগ বাড়ে। সম্বোধনটা প্রথম থেকেই তুই পর্যায়ে সম্পর্কটা হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। দুজনেই দুখী তাই আরও সহজেই ঘটলো ব্যাপারটা।
জহিরের বাবা- মা ছোটবেলায় মারা গেছে। মামার কাছে মানুষ, তারপর নিজের চালাকি খাটিয়ে ব্যবসা গড়ে তুলেছে। নানামুখী ব্যবসা জহিরের। একটা গ্যারেজে বেশকিছু ছেলে দিয়ে কাজ করায় সে। সহজ মনে কাজটা চম্পা প্রথমে ভালোই ভেবেছিল। ক্রমশ কাজে নেমে বুঝতে পারলো অধিকাংশ মালামাল চৌর্যবৃত্তি করে আনা। ততদিনে জহিরের কাছে দেনা হয়ে গেছে। তার মায়ের চিকিৎসা খরচ জহিরই চালায়। মনের ভেতর ওর জন্য সূক্ষ্ম টান তৈরি হয়ে গেছে, তাই আর সৎপথে ফিরে আসেনি চম্পা। বড় করে হাই তুলে ভাবনা বন্ধ করলো। আধঘন্টা পর দুজনে একসাথে বেরিয়ে পড়লো। ঠিকানামতো এসে দারোয়ানের চাচাত বোনের পরিচয়ে বিয়ে বাড়িতে এসে ঢুকে পড়ল চম্পা। বিয়ের ঝামেলায় কত কাজ। তাই কাজের লোক পেলে কারো আপত্তি থাকে না। জহিরের এ ব্যাপারে জুড়ি নেই। দ্রুত ভাব জমিয়ে নিজেও খাবার পরিবেশনের জায়গায় কাজ জুটিয়ে নিলো। গেটের কাছাকাছি তার কাজের জায়গা, সময়মত দ্রুত সটকে পড়া যাবে। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পর বর- কনেকে একসাথে বসানো হলো। এবার খাবার পরিবেশন হবে, সবাই হইচই করে খেতে গেল। চম্পা কিছুটা পেছনে রইলো কারণ একসাথে বসলে তাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
দেরিতে গিয়ে চম্পা শেষের টেবিল খালি পেল। সেই টেবিলে এক মোটা মহিলা একটি চেয়ারে বসা। কিছুটা বিরক্ত মনে পাশের চেয়ারে বসল চম্পা। চম্পার খাবারের প্রতি মন নেই। সে সুযোগ খুঁজছে, মোটা মহিলাটির ফোন এল, চম্পা দেখে চমকে গেল।
আরেব্বাস এ যে আইফোন!
আচ্ছা এখানেই কাজ শুরু করতে হবে।
ওদিকের অবস্থা বুঝতে জহিরকে ফোন দিল সে।
কি রে তোর মিশন কদ্দুর হল? একজনের থেকে খসিয়েছি, ব্যাটা খেয়ে বেরিয়ে গেছে।
আমিও পয়েন্টে, একটু সময় লাগবে। কখন কে টের পায়, বেশি সময় নিস না।
এদিকে আভিজাত্যহীন মোটা মহিলাটি উঠে পড়েছেন, বেশি খেয়ে হাঁটতে পারছেন না, চম্পা তার পিছু নিল ।
একটি চেয়ার এগিয়ে বলল আন্টি এখানে বসুন।
দাও বসি,
পান খাবেন আন্টি?
হ্যাঁ, আমিতো পানের টেবিলে যাবো ভাবছিলাম, হাঁটতে কষ্ট লাগছে, আচ্ছা, আপনি বসুন, আমি পান নিয়ে আসছি।
আন্টি পান নিন,
ও এনেছো! দাও দাও।
চম্পা অল্প সময়ে মহিলার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল। বর-বউয়ের ছবি তুলছে সবাই, মহিলাটি বলল, আমি একটা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম,
চম্পা শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল। আন্টি ছবি তুলবেন?
ঠিক আছে, আপনি স্টেজে উঠুন, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।
নিজেই নিয়ে মহিলাকে ধরে স্টেজে উঠিয়ে দিলো।
হাসিমুখে বউয়ের পাশে বসলেন তিনি। এরপর ছবি তোলা শুরু।
অনেকেই নতুন বউ বরের ছবি তুলছে, খুব ধাক্কাধাক্কি। সুযোগ বুঝে পিছিয়ে এল চম্পা। তারপর দ্রুত ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।
বেলা শেষ হয়ে এসেছে । বরপক্ষ দেরি করতে চাইছে না। এবার তারা নতুন বউ নিয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত, তাই বারবার তাড়া দিচ্ছে।
কনে বিদায় পর্বে সবাই কাঁদছে, সেই মহিলাটিও কাঁদছেন তবে চম্পাকে খুঁজে না পেয়ে, যে তার আইফোনটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।