চলনবিলের দোতলা মাটির ঘর

শাহজাহান, তাড়াশ সিরাজগঞ্জ: মাটির ঘরের ইতিহাস বলতে গেলে বলা যায়- আদিম যুগের কথা, যখন মানুষ পাহাড়ে, মাটির গুহায় বসবাস করতেন। তারপর মানুষ ক্রমান্বয়ে নিজেদের পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেই মানুষ গর্তে-গুহায় বাস ছেড়ে মাটির ঘর তৈরি করতে শেখেন।
চলনবিল অঞ্চলের মাটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- ভিজলে নরম আঠার মতো, তেমনি আবার শুকালে পাথরের মতো শক্ত হয়। এ জন্য ঘর তৈরিতে ওই অঞ্চলের মাটি উপযুক্ত। চলনবিলের মানুষজন বহুকাল ধরেই মাটির ঘরে বসবাস করছেন। তবে চলনবিলাঞ্চলে মাটি দিয়ে তৈরি মাটির দোতলা ঘর এখন হারিয়ে যাচ্ছে। শতবর্ষী দৃষ্টিনন্দন নানা আল্পনায় আঁকা শক্ত ও মজবুত নিরাপদ আরামদায়ক কিছু মাটির ঘর এখনও চলনবিলের গ্রামে-গ্রামে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া; নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, সিংড়া ও নওগাঁর আত্রাই এলাকায় শত শত গ্রামে এক সময় মানুষ নিরাপদ ও আরামদায়ক বসবাসের জন্য মাটির ঘর নির্মাণ করতেন। শুধু তা-ই নয়, বনেদি ও ধনাঢ্য কৃষক পরিবার তাদের উৎপাদিত হাজার হাজার মণ ধান, গম, সরিষা রাখার জন্য দোতলা ঘরের ওপর তলা বা স্থানীয়ভাবে চাতাল নামে পরিচিত স্থানেই সংরক্ষণ করে রাখত।
চলনবিলের মাধাইনগর ইউনিয়নের গুড়মা গ্রামের সেরাত আলী (৬০) বলেন, তাদের পরিবারে বড় দোতলা মাটির ঘর এখনও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি আরও বলেন, তাদের মাটির ঘরের দোতলায় খোলামেলা বাতাস পাওয়ার জন্য তাঁর বাবা ও তাঁরা ঘুমাতেন। আবার ৩০-৪০ বছর আগে যখন তাঁদের পরিবারে প্রচুর শস্য উৎপাদন হতো তার সবটুকুই চাতালে সংরক্ষণ করে রাখতেন। এ ছাড়া সেই সময় কিছু কিছু লোকের খাট বা চৌকি কেনার সামর্থ্য না থাকায় বাড়িতে থাকা মাটির ঘরের মেঝেতে মাটি দিয়ে কিয়দংশ উঁচু করা হতো, যা খাটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো পরিবারের বেশি সদস্যের একই জায়গায় ঘুমানোর জন্য।
কৃষক পরিবারগুলোতে নতুন মাটির ঘর নির্মাণে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে মাটির ঘর তৈরির কারিগর, স্থানীয়ভাবে যারা ঘরামি নামে পরিচিত, সেই লোকজনও আর মিলছে না বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাড়াশের কাস্তা গ্রামের রাজু সরকার জানান, তার দাদা তাঁদের বাড়িতে বেঁকি বা বর্তমানে যা 'এল' প্যাটার্ন বা 'ইউ' প্যাটার্ন বলা হয়, সে রকম বড় বড় আট কক্ষবিশিষ্ট মাটির ঘর নির্মাণ করেন। মূলত দোতলায় পাকা বাঁশ, তাল গাছের তৈরি তীর দিয়ে তালাই বিছিয়ে শক্ত মজবুত করে তার ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে তা থেকে ৪-৬ ফুট উঁচু করে টিনের চালা দিয়ে বড় বড় বাড়ি-ঘর নির্মাণ করছেন। এসব মাটির দোতলায় ২-৩ হাজার মণ ধান সংরক্ষণ করা যেত।
মাটির ঘর নিয়ে কথা হয় গুরুদাসপুর উপজেলার রুহাই গ্রামের রাশিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, অল্প খরচে নিরাপদ বসবাসের জন্য মাটির ঘর অতুলনীয়। মূলত গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমে মাটির ঘর শীতল থাকে আবার শীতকালে প্রচন্ড শীতে ঘরের ভেতরে গরম অনুভূত হয়। এ কারণেই বিলপাড়ের লোকজন এক সময় বাড়ির সব ঘরই মাটি দিয়ে তৈরি করতেন। দোতলা মাটির ঘর নির্মাণের মধ্য দিয়ে এলাকার মানুষের নজরকাড়ার একটা কৌশলও ছিল অনেকের।
সিংড়া উপজেলা বেড়াবাড়ী গ্রামের জালাল খন্দকার (৫৫) জানান, বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামাঞ্চলের ঘরামিরা বায়না করে মাটির ঘর নির্মাণের চুক্তি করতেন চলনবিলের কৃষক পরিবারগুলোর সঙ্গে। সে অনুযায়ী মাটির ঘর তৈরি ৪-৫ মাস সময় নিতেন। তারা বর্ষাকাল আসার আগেই ঘর তৈরির কাজ শেষ করতেন।