শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘিরে বাড়ছে শংকা-সংশয়

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই শংকা, সংশয় বাড়ছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে এবার ‘ডু অর ডাই’। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরে যাবে না। দেশের চলমান এই রাজনীতিক পরিস্থিতি ঘিরে বাড়ছে জল্পনা-কল্পনা। এটি শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাইরেও আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে তাতে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞ মহল। তারা ঘোষণা দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাদের ভিসা দেয়া হবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুই কি ভিসাই এর আওতায় থাকবে নাকি অন্য আরও কিছু যোগ হবে। অনেকেই বলছেন, মার্কিন এ নীতির কারণে ব্যক্তির চেয়েও দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

সূত্রমতে, দেশের প্রধান দল বিএনপিসহ সরকার বিরোধী দলগুলো বলছে, দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। এর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনেই অংশগ্রহণ করেছিল। তখন সরকারের তরফ থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। সেটা কতখানি হয়েছে-শুধু বিরোধী দল নয়, সরকারি দলের নেতাকর্মী আর সমর্থকরাও তা কমবেশি জানে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলে বিবেচিত একটি দেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে খোলামেলা মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় ২০১৮-এর নির্বাচনের মান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলেও স্বস্তি নেই এবং এটি তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যেও টের পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনের আগে একটি বড় সমঝোতা হয়েছিল বলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কথা চালু আছে। তখন কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় ফিরে আসার নিশ্চয়তার পাশাপাশি বিএনপি জোটের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সম্মানজনক আসন রাখার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রের খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। নির্বাচনের ফলে তার কোনো প্রতিফলন অবশ্য দেখা যায়নি। এমনকি ২০১৪ সালে যে মানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তারও পুনরাবৃত্তি হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে এখন কথা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে যারা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ দেখতে চায়, সেই আন্তর্জাতিক আর আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও দেওয়া হচ্ছে একই প্রতিশ্রুতি। কিন্তু মাঠের যে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে এসব করা হচ্ছে, তারা কোনোভাবেই আর দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছে না। যার অংশ হিসেবে দেশের পাঁচ সিটিতে যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছে, তাতেও বিএনপি বা বিরোধীরা অংশগ্রহণ করছে না। সবশেষে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সিলেট সিটি মেয়রও জানিয়ে দিলেন, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। তার মতে, দেশের কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। ভোটারদের মধ্যেও কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮-এর পর অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ধারার প্রথম নির্বাচনটি সরকারকে করতে হয় বিরোধী পক্ষের তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে। রাজধানীর বাইরে নজিরবিহীন আন্দোলন হয়েছিল তখন এবং সে কারণে সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোটই হতে পারেনি। এ ধরনের নির্বাচন আর কখনো অনুষ্ঠিত হতেও দেখা যায়নি দেশে। তা সত্ত্বেও এর ভেতর দিয়েই সরকার গঠিত হয় এবং সেটি পুনঃনির্বাচিত হয় ২০১৮-এর নির্বাচনে, যাতে বিএনপি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়ে অংশ নিয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকে অবশ্য বলা হয়ে থাকে, জোরালোভাবে অংশগ্রহণের বদলে বিএনপি এমনভাবে অংশ নিয়েছিল-যাতে নির্বাচনটি বিতর্কিত হয়। বিএনপি অবশ্য বলে থাকে, সরকার পক্ষের আগ্রাসী আচরণের কারণেই ওই নির্বাচন বিতর্কিত হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আজ এমন এক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগ দায় নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে। তাদের আন্দোলনে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ‘সংবিধানের অঙ্গীভূত’ হয়েছিল, সেটি আবার তাদেরই হাতে বাতিল হওয়ার ঘটনা তো ব্যাপক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। 

জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক হাসান মামুন বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের উপায় বের করা গেলে হয়তো ভিন্ন হতো পরিস্থিতি। সেটি হয়নি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের সদিচ্ছা ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা দু’য়েরই অবনতি লক্ষ করা গেছে ক্রমে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও আগেকার মান ধরে রাখা যায়নি। সেগুলো ঘিরে বরং আরও বেশি সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি নিজ দলে এবং তা বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন দল তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারলেও এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো কিছুটা এড়ানো যেত। এখন পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, উভয় পক্ষের জন্যই তা ‘ডু অর ডাই’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিএনপির ভালোই জনসমর্থন রয়েছে কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তার নেই। এদিকে সরকার পক্ষ মনে হয় নির্ভর করে আছে এক কাতারে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ এবং একাধিক আঞ্চলিক শক্তির ওপর। এ অবস্থায় কোনো দৃশ্যমান সমাধান-সূত্রের বদলে বেশি করেই যেন ছড়াচ্ছে জল্পনা-কল্পনা ও গুজবের ডালপালা। একটি সম্ভাবনাময় দেশ ও জনগোষ্ঠীর জন্য এ পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে দুর্ভাগ্যজনক।

এদিকে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি করা হলে বাংলাদেশিদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন ২৪ মে এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দেন। ব্লিংকেনের টুইট বার্তা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও বাংলাদেশবিষয়ক ভিসানীতি বা ঘোষণাপত্রটি প্রচারিত হয়। বিবৃতিতে ব্লিংকেন জানান, সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এ ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হবেন। ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। নতুন এ নীতিমালার আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী যে কোনো ব্যক্তির ওপর মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা সম্ভব। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে-ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এবারের মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বিপুলসংখ্যক লোককে টার্গেট করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের পরিবারের সদস্য ও বিচার বিভাগও রয়েছে এর আওতায়। সরকার নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব না দিলেও এর রয়েছে নানা ক্ষতিকর দিক। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। ৯০’র দশকে ইরাকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। শুরুতে সরকার গুরুত্ব না দিলেও ইরাকের অর্থনীতি এক প্রকার ধসে পড়ে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে খনিজসম্পদে ভরপুর দেশটিও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে। সরকার চায় বর্তমান কাঠামোর মাধ্যমেই নির্বাচন পরিচালনা করতে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে এলো নতুন করে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাপত্র।

২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক আলোচনায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন ধৃষ্টতার কথা শুনিনি। ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে দেশে-বিদেশে। ওই নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের ১৫৪টিতেই শাসক দল আওয়ামী লীগ ও জোটভুক্ত অন্যান্য দলের ১৫৪ প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় সেজন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক চাপ রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলকভাবে করতে পারবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ