ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। গতকাল ২৩ মে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। একযোগে বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত মানুষের সংখ্যাও। উল্লেখ্য, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসকে এডিস মশার প্রজনন কাল মনে করা হয়। কিন্তু আজকাল আর ওই সময়ের ওপর নির্ভর করা যাচ্ছে না। এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির কোনো সম্পর্ক নেই। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানি। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির জমে থাকা পানিতেও বিপুল পরিমাণে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২১ মে’র মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল একশ’জনÑ যদিও তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়নি। তবে পরের বছর, ২০২২ সালে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ২৪৩ জন। ওই সময়ে কারো মৃত্যু না হলেও চলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত রোগীদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৪৭ জনÑ যা গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। উল্লেখ্য, এই সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৪ গুণ বেশি। বড় কথা, মৃত্যুর ক্ষেত্রেও সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২১ মে পর্যন্ত ১৩ জন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে।
রিপোর্র্টে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। মৃত্যুও তাদেরই বেশি হচ্ছে। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, ২০০০ সালে প্রথমবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটবার পর ৯৩ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। এর বাইরে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। উদ্বেগের একটি বড় কারণ হলো, ওই বছর ডেঙ্গুর সঙ্গে সালমোনেলোসিস নামের বিরল ধরনের নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ঘটতে দেখা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমণের ১২ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রোগী জ্বর, পেটে খিঁচুনি এবং ডায়ারিয়ার শিকার হয়। রোগীর পেটে প্রচন্ড ব্যথা হয়। এই ব্যথা সাধারণত চার থেকে সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সংক্রমণ আরো গুরুতর হলে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হতে পারে এবং সংক্রমণও সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অমন ক্ষেত্রে সঠিক এবং তাৎক্ষণিক জীবাণুরোধক চিকিৎসা না দেয়া গেলে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ভীতিকর। কিন্তু অমন ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেও সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বললেই চলে। ফলে দেশের অন্য সকল এলাকার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায়ও দ্রুত বেড়ে চলা মশার উপদ্রব মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। রাতে তো বটেই, দিনের বেলায়ও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হচ্ছে রাজধানীবাসী। এসব মশার মধ্যেই রয়েছে ডেঙ্গু। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনের জন্য কোটি কোটি টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়ালেও তার সুফল ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না মানুষ। মশারি টানিয়ে শুধু নয়, নিজেদের অর্থে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল জ্বালিয়ে এবং ইলেকট্রিক ব্যাট ও মশানাশক ওষুধ স্প্রে করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় মশাবাহিত ভয়ংকর রোগ ডেঙ্গুও ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার শিশু এবং নারী-পুরুষ। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, করোনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ডেঙ্গু এবং সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় আক্রান্ত অনেকের মৃত্যুও ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশা নিধনের জন্য কোটি কোটি টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়ানো এবং স্প্রে করার জন্য ওষুধ কেনা হলেও তার সুফল ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না ট্যাক্সদাতা জনগণ। অভিযোগে বলা হচ্ছে, এমন কিছু স্থানেই শুধু মশার ওষুধ স্প্রে করা হয়, যেগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ মশা নিধনের ক্ষেত্রেও দলীয় রাজনীতি এবং স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পাচ্ছে!
অর্থাৎ সব মিলিয়েই রাজধানীর অধিবাসীরা ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের পর্যায়ে অভিযোগে বলা হচ্ছে, কিছু এলাকায় নামকাওয়াস্তে ছেটানো হলেও ওষুধগুলোর আসলে কার্যকারিতা নেই। এর কারণ, ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এমন সব কীটনাশকই কেনা হয়েছেÑ যেগুলো মশা নিধনে মোটেও সক্ষম নয়। একই কথা সত্য বাজারের বিভিন্ন ওষুধ ও কয়েল সম্পর্কেও। তাছাড়া গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের বাজারে যেসব মশার কয়েল বিক্রি হয় সেগুলোর বেশির ভাগের মধ্যেই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। ফলে মশা তাড়াতে গিয়েও মানুষ উল্টো ক্ষতিরই শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে বলেই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মশা নিধনের চেষ্টার সঙ্গে এখন মশার উৎপত্তিস্থলগুলোর ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। প্রসঙ্গক্রমে তারা পুকুর এবং খাল ও নালা-ডোবার মতো বিভিন্ন স্থানের কথা উল্লেখ করে এগুলোর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মশার উপদ্রবে রাজধানীবাসীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে বলেই মশা নিধনের অভিযান দ্রুত জোরদার করা দরকার। আমরা মনে করি, সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনের উচিত প্রথমে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া এবং মশা নিধনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া। এ উদ্দেশ্যে এমন কীটনাশকই কেনা এবং ছেটানো দরকার, যেগুলো মশার জন্ম ও বিস্তার রোধ করতে পারে। একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার দেশের বাকি সকল অঞ্চলেও।