মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সময় শেষ হবে; সম্পদ শেষ হবে না

ইবনে শাহ

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি (আল্লাহ) সকল সম্পদের চূড়ান্ত উত্তরাধিকারী’। এ কথাটি আমাদের জীবনে বহুবার ঘটে যায়, মিলে যায় বহুবার। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে আমি ঢাকা মহানগরীর যে এলাকায় থাকতাম সেই এলাকার এক হাজী সাহেব পাঁচটি বাড়ির মালিক ছিলেন। হাজী সাহেবের একদিন হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হলো, ছেলেরা কেউ বাসায় নেই। বড় পুত্রবধূ উনাকে নিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে এসে বেবি ট্যাক্সি ডাকতেছে। হাজী সাহেব একহাতে বুক চেপে ধরে অন্য হাতে বৌমাকে বেবি ট্যাক্সি ডাকতে নিষেধ করে বললেন, বৌমা বেবি ট্যাক্সি ডেকো না, অনেক টাকা ভাড়া লাগবে। তারচেয়ে রিক্সা ডাকো পাঁচ টাকা ভাড়া নিবে। হাজী সাহেব আজ নেই। তার পুরাতন বাড়ির জায়গায় বিশাল বিশাল পাঁচটি অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু হাজী সাহেব হৃদরোগ আক্রান্ত হয়েও বেশি টাকা ভাড়া নেবে তাই বেবি ট্যাক্সিতে না উঠে, রিক্সায় চড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে গেলেন। আজ ২৫ বছর পর সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভাসে আর ভাবি আল্লাহ তায়ালা সঠিক বলেছেন সম্পদ যতই উপার্জন করা হোক না কেন, সম্পদের চূড়ান্ত উত্তরাধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

আমার আরেকজন নিকটতম প্রতিবেশী ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন তিন মেয়ের পিতা। ছেলে সন্তান নেই। জীবনে প্রচুর টাকা আয় করেছেন। জেলা শহরে বিশাল বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট, ব্যাংকে অনেক টাকা জমা, সরকারি চাকরি, বেতন বোনাসের টাকা প্রতিমাসে খরচ করে শেষ হয় না। গ্রামের বাড়িতে অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল। যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ছেলে সন্তান নেই, তাই তার ভাইয়েরা পৈত্রিক সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জন্য পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ রাখে না, যেহেতু তার ছেলে নেই, শহরের বিশাল বাড়ি, ব্যাংকে প্রচুর টাকা, ওগুলো তার তিন মেয়ে জন্য যথেষ্ট। ছেলে না থাকার কারণে ভাইয়েরাও তো তার সম্পদের ভাগ পাবে, এজন্যই মনে হয় পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগের সময় ছোট ভাইয়েরা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবদের জন্য ভাগ রাখেনি। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব করলেন কি ভাইদের সাথে বিবাদ করে মামলা-মোকদ্দমায় জিতে নিজের অংশের পৈত্রিক সম্পত্তি সব বিক্রি করে, স্ত্রী এবং মেয়েদের নামে ব্যাংকে জমা করলেন। এর কিছু দিনের পর হঠাৎ করে তিনি মারা গেলেন। বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংকে জমা টাকা ছাড়াও চাকরির পেনশন-গ্রাচুইটি মিলে কোটি টাকা পাওয়া যায়। স্ত্রীর জন্য আজীবন পেনশন তো আছেই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শূন্য হাতেই চলে গেলেন, ভাইয়েরা মনের দুঃখে দাফন কাফনে আসলো না।

এরই নাম সকল সম্পদের চূড়ান্ত উত্তরাধিকারী একমাত্র আল্লাহ। বাংলা একটি প্রবাদ আছে. ‘বিশে বিদ্যা, ত্রিশে ধন, তারপরে ঠনঠন’। প্রবাদ বাক্যটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত বিদ্যা ২০ বছরের মধ্যেই অর্জন হয়, আর ধনসম্পদ ৩০ বছরের মধ্যে যেটুকু অর্জন হয় সেটুকুই প্রকৃতপক্ষে ভোগ করা যায়। কারণ সম্পদ উপভোগ করার জন্য যৌবন ও শক্তি-সামর্থ্যের  প্রয়োজন। যৌবন ও শক্তি সামর্থ্য না থাকলে সম্পদ থাকলেও সেই সম্পদ উপভোগ করা যায় না। সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু সম্পদ থেকে যায় উত্তরাধিকার বদল হয়, চূড়ান্তভাবে সকল সম্পদ  এক সত্তার অধীনে পুুঞ্জিভূত হয়।

এই সহজ হিসেবটি আমরা কেউ চিন্তা করি না। সম্পদের মোহে দিনরাত এত পাগল পারা যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্পদের লোভনীয় আকর্ষণে ন্যায় অন্যায় বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। একটি হিসেব করে দেখা গিয়েছে জীবনের তিন চতুর্থাংশ কিংবা খুব জোর দুই-তৃতীয়াংশ পার করার পর কাক্সিক্ষত সচ্ছলতা আসে। জায়গা-জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ শুরু হলো, বাড়ি নির্মাণ শেষ জীবনের বাকী সময় ফুরিয়ে এল। শখের বাড়িতে বেশি দিন বসবাস করার সময় পাওয়া যায় না। এমনই তো হচ্ছে আমাদের দেশে। এই কালচার চালু হয়ে গেছে সম্পদের পাহাড় গড়তে গিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের কোন বাছ বিচার নেই, শরীরের যত্ন নেই, আরাম-আয়েশ নেই। জীবনের চিত্তবিনোদন নেই, দান খয়রাত নেই, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় নেই, এমনকি নিজের উপর যে সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে, মহান আল্লাহ আপনাকে তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন এর সব কিছুই সম্পদের মোহে ভুলে যাই। মনেই হতে চায় না যে, সময় ফুরিয়ে যাবে অর্জিত সম্পদ উপভোগ করার সুযোগ থাকবে না। আমাদের দেশে এমনও দেখা যায় মৃত্যু ভিখারীর বিছানার নিচে লক্ষ লক্ষ টাকা। ভিক্ষা করে না খেয়ে টাকা জমিয়েছে কিন্তু উপভোগ করার সুযোগ পেল না।

এই যে অবস্থা এর প্রকৃত কারণ হলো জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। জীবনের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী সেটা যখন নির্ধারণ করা হয় না, তখনই সম্পদের মোহ পেয়ে বসে। কোন কিছুতেই আত্মতৃপ্তি হয় না। একটার পর একটা আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হতে থাকে। এক সময় চার-পাঁচটি বাড়ির মালিক হয়েও বলে ‘আপনি কি জানেন আমার যাকাত হয় না’। আমিও বলে ফেললাম আপনার যখন যাকাত হয় না, তাহলে যার যাকাত দেওয়ার মতো সম্পদ নেই, সে যাকাত খেতে পারে, তাহলে আপনার লাগলে যাকাতের কিছু টাকা আপনাকে দিই, কি বলেন। মুখ বেজার করে চলে গেল। আবারও আমার মনে হলো সম্পদে চূড়ান্ত উত্তরাধিকার আল্লাহর।

জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্থির করতে পারলেই সময় ও সম্পদের যেমন মোহ থাকবে না, তেমনি সময় ও সম্পদও কোন দিন ফুরাবে না। দ্বীনকে যদি জীবনোদ্দেশ্য বানানো যায়, জীবনের সকল কাজকর্ম যদি দ্বীনকে কেন্দ্র করে পরিচালিত করা যায় তাহলেই সেই জীবন সার্থক হবে। সফল জীবন লাভের জন্য দ্বীনের কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে। যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া যায় যে, আমার জীবনের কোনো কাজেই দ্বীনের কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে না, এই সংকল্পের সাথে যদি বাস্তবের মিল পাওয়া যায়, তাহলেই সৃষ্টিকর্তার সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সহজ হবে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, যে একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করে পৃথিবীর সব কিছু তাকেই ভয় করে। আর যে আল্লাহকে ভয় পায় না, পৃথিবীর সবকিছুই তাকে ভয় দেখায়।

আল্লাহর সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জীবনের মৃত্যু নেই, স্থানান্তর হবে মাত্র। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে করতে আপনি যখন দুনিয়ার জীবন সমাপ্ত করে পরপরে যাত্রা করবেন তখন আপনার জীবনের সময় আর ফুরাবে না। আপনি দ্বীনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে সম্পদ অর্জন করেছিলেন সেই সম্পদে আল্লাহ এত বরকত দিবেন যে সেই অর্জিত সম্পদ আর ফুরাবেনা, অফুরন্ত হয়ে যাবে। অফুরন্ত সময়, অফুরন্ত সম্পদের মালিক সকলেই হতে পারে না, তারাই হয় আল্লাহ যাদেরকে বাছাই করেন। আর বাকিদের সময় ফুরিয়ে যাবে; সম্পদ রয়ে যাবে, সৃষ্টি হবে নতুন উত্তরাধিকার।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ