রাজধানীতে আবারও আগুন
অনিয়ন্ত্রিত আগুন যেহেতু সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি বহু মানুষের জীবনও কেড়ে নেয়, সেহেতু আগুনের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। সম্প্রতি এই আহ্বান জানানো হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। পেছনে আশু এবং প্রধান কারণ সৃষ্টি করেছিল সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ড। এসব ঘটনায় সম্পদ যেমন ধ্বংস হয়েছে তেমনি প্রাণও হারিয়েছে অনেক মানুষ। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা আহ্বানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। আর সে কারণেই রাজধানী ঢাকায় আবারও অগ্নিকান্ড ঘটতে পেরেছে।
গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, গত ২৭ মার্চ একই দিনে রাজধানীর তিনটি পৃথক স্থানে অগ্নিকান্ড ঘটেছে। আগুন নেভানোর এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার ফলে এবারের অগ্নিকান্ডে মানুষের মৃত্যু না ঘটলেও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অগ্নিকান্ড শুধু ঘটেনি, তিন-তিনটি পৃথক স্থানে ঘটেছে। সম্পদও পুড়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। এসবের মধ্যে শুধু সাততলা বস্তিতেই পুড়ে গেছে শতাধিক ঘর। এই ঘরগুলোতে যারা বসবাস করতো তারা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের সব সম্পদ ভস্মিভূত হয়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধও হয়েছে অনেকে। একই যোগে আবারও প্রাধান্যে এসেছে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কিত আলোচনা। সাম্প্রতিক সময়ে কারণ সম্পর্কে বেশি আলোচনা হয়েছিল সিদ্দিকবাজারের ঘটনার পর। কারণ, এর মাত্র দু’দিন আগে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটি তিনতলা ভবনে প্রায় একই ধরনের বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু ঘটেছিল। সেখানে আহত হয়েছিল অন্তত ১৫ জন। ভীতি ও বিস্ময়ের কারণ হলো, কোথাও এধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে সাধারণত সকল এলাকাতেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। অন্যদিকে সায়েন্স ল্যাব থেকে সিদ্দিকবাজারের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের কম হলেও সেখানে ঘটেছে আরো ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকেই আসলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর সে কারণেই পরপর দু’দিনের মধ্যে এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে পেরেছিল।
উল্লেখ্য, বিস্ফোরণ, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে যাওয়ার পর অনেকেই অনেক কথা বলতে এবং যার-যার মতো ব্যাখ্যাসহ পান্ডিত্য দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কেউই ভবন নির্মাণকারীদের দোষত্রুটিকে সামনে আনেননি। অথচ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত নিয়ম হলো, একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি থেকে শিক্ষা নিতে হয়। ভুলত্রুটি চিহ্নিত করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারেও ব্যতিক্রমী অবস্থানে রয়েছে আর সে কারণেই একের পর এক ভয়াবহ সব বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ড ঘটে চলেছে!
এদিকে জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, এ ধরনের অগ্নিকান্ডকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। মূলত সে কারণেই অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্নসাপেক্ষ নীরবতা অবলম্বন করা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর অধিবাসীসহ সচেতন মানুষেরা বিশেষ গোষ্ঠীর দিকে আঙুল উঠিয়েছেন। তারা বলেছেন, এসব অগ্নিকান্ড মোটেও দুর্ঘটনা নয় বরং বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর লোকজন সুপরিকল্পিতভাবে মার্কেট ও বস্তিতে আগুন লাগিয়ে থাকে। বস্তির ক্ষেত্রে বস্তি উচ্ছেদ করে জায়গা দখলে নেয়া এবং সেখানে বহুতল কোনো স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা তাদের চালিত করে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু পরিকল্পনাও আলোচিত হয়েছে। এর কারণ, একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, যেখানে অগ্নিকান্ড ঘটেছে ঠিক তার পাশেই কোনো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ওই মন্ত্রণালয় সেখানে তার নিজস্ব সম্পত্তির ওপর নি¤œ ও নি¤œ মধ্যবিত্তদের পুনর্বাসনের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করবে। বলা হচ্ছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা সরাসরি জড়িত না থাকলেও যাদের ওপর ফ্ল্যাট নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাই ভাড়াটে লোকজন দিয়ে আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে, যাতে সহজেই বস্তি উচ্ছেদ করে জায়গাটুকু খালি করা এবং পরিকল্পিত ফ্ল্যাট নির্মাণ করা সম্ভব হয়।
প্রসঙ্গক্রমে অন্য দু-একটি জরুরি বিষয়েও বলা দরকার। সরু রাস্তাঘাট এবং পানির অভাব এরকম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিরপুরসহ বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, দমকল বাহিনীর ২৫টি ইউনিট তৎপরতা চালালেও প্রধানত সরু রাস্তা এবং সব রাস্তায় আসবাবপত্র পড়ে থাকার কারণে ওই এলাকায় সহজে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ছিল পানির জন্য প্রয়োজনীয় পুকুর না থাকার কারণ। এলাকায় পুকুর নেই বলেই দমকল বাহিনীকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে এবং সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে বহু কষ্টে প্রবেশ করতে হয়েছে। একই কারণে জনবল থাকা সত্ত্বেও কম সময়ে আগুন নেভানো এবং আগুনের বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। ২৭ মার্চ এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনার ক্ষেত্রেও মূলত পানির কারণেই দমকল বাহিনীর দশটি ইউনিটকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে এনে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে।
এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা মনে করি, মানুষের জীবন এবং অর্থ-সম্পদ রক্ষার স্বার্থে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে জরুরিভিত্তিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া। সরকারকে একই সঙ্গে আরো কিছু ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে এবং সে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অগ্নিকান্ড প্রতিহত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, পুরনো ঢাকা এবং মিরপুর ও রূপনগরসহ রাজধানীর কোনো এলাকায় তো বটেই, দেশের অন্য কোনো অঞ্চলেও যেন আর কোনো অগ্নিকান্ড ঘটতে না পারে। যাতে আগুনে পুড়ে মানুষকে অসহায়ভাবে প্রাণ হারাতে না হয়, যাতে গরীব মানুষের অর্থ-সম্পদ ধ্বংস না হয়।