অবক্ষয়ের ব্যাপ্তি
দেশে এখন অবক্ষয়ের জয়জয়কার চলছে। এমনকি অবক্ষয় এখন আমাদের জাতিসত্ত্বাকেই অক্টোপাশের মতো চেয়ে ধরেছে। রাষ্ট্রের এমন বিভাগ বা সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাট স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। বস্তুত, অনিয়মই এখন রীতিমত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে সুকৃতির পরিবর্তে দুর্নীতি বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। আর তা প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ফলে জাতি আমাদের গন্তব্যই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কোন জাতিরাষ্ট্রে যখন দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তখন সে সমাজে সুন্দর ও সুকুমার বৃত্তির চর্চা অবশিষ্ট থাকে না। থাকে না নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা। সবকিছু চলে যায় নষ্টের দখলে। সর্বসাম্প্রতিক কিছু ঘটনার দিকে তাকালে সার্বিক পরিস্থিতি সেদিকেই অঙ্গলি নির্দেশ করে। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা স্থায়ী রূপ নেইনি। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয়টি ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত হওয়ায় এই স্পর্শকাতর ইস্যুতে সংশ্লিষ্টরা বেশ স্বচ্ছ ও সহনশীল থাকারই চেষ্টা করতে নিকট অতীতেও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু হালে সে অবস্থারও বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল ইস্যুতেও দুর্নীতিবাজরা আত্মসংবরণ করতে পারেন নি বরং অবৈধ অর্থলিপ্সা তাদেকে একেবারে প্রান্তিকতায় নামিয়ে দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় নির্মাণাধীন উপজেলা মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ কাজে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, মূল ভবনের পিলারগুলো আঁকা-বাঁকা ও ছাদ ঢালাইয়ের আগেই সকল পিলার হেলে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের কারণে সম্প্রতি ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক। যা আমাদের অবক্ষয়ের ব্যাপ্তীই কথায় স্মরণ করে দেয়। এ বিষয়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন শেষে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রায় ১১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট এসএস কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড কার্যাদেশ পায়। কাজ শুরু হওয়ার ৩ বছরে ভিত্তি ঢালাই দিয়ে মাত্র অর্ধেক পিলার নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, নিম্নমানের কাজ গোপন করতে দ্রুত বালুমাটি দিয়ে পিলারগুলো ভরাট করার চেষ্টা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে মসজিদের চারপাশে ভিত্তি ঢালাই ও পিলার করার জন্য গর্ত করে। কিন্তু বৃষ্টিতে মাটি সরে গিয়ে আঁকা-বাঁকা ও হেলে পড়া পিলার দৃশ্যমান হয়। স্থানীয় জনগণ মোবাইল ফোনে ছবি তুলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়েছেন। পরে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এত কোন ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত হতে পারছেন স্থানীয়রা। কারণ, এসব বিষয়ে অতীত রেকর্ড মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।
কোন বিষয়ে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করা আমাদের রীতিমত ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার রেওয়াজও রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, প্রায় ক্ষেত্রে কোন প্রতিবেদন দাখিল করা হয় না বা দাখিল করা হলেও তা জনসমক্ষে প্রকাশও করা হয় না। আর এই উদাসীনতার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার সুযোগে দুর্নীতি ও অনিয়মের বরপুত্ররা পার পেয়ে যান। ফলে দুর্নীতি ও অনিয়ম এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। এমতাবস্থায় দেশকে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বাঁচাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেবে।