মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
এম এ কবীর
সিয়াম সাধনার মাস রামাদান। এই মাসে বিশ^ব্যাপী মুসলিম নিজেকে শুদ্ধ চিন্তায় উন্নীত করেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। মানব মনের অবিচ্ছেদ্য রিপু ‘লোভ’ থেকে নিজবৃত্তিকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন- আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু তা হওয়ার নয়! বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও, কৃত্রিম সংকটের কারণে দেশের বর্তমান দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস মধ্যবিত্তের। এরপর আবারও রমযানের অজুহাতে ‘বাজার সিন্ডিকেট’ তৈরি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কয়েক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে, দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ভাঙা সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের প্রায় ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে বিভিন্ন পণ্যমূল্য। রমযানকে ঘিরে,তৎপর রয়েছে- বাজার সিন্ডিকেট। ইতোমধ্যে ছোলা, শসা, ডিম, ডালের দাম বেড়ে গেছে। এমনকি,মাছ এবং ব্রয়লার মুরগির দামও কল্পনাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যদিও ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন, তবু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কোনো দেশে, কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে সরকারকেই, জনগণের সেবায় এগিয়ে আসতে হয়। কঠোর নজরদারি এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, অনাচার ও দুর্ভোগ থেকে মানুষকে স্বস্তির পথ দেখায়। সংযমের এই মাসে, লোভাতুর কাবুলিওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল চ্যালেঞ্জ। রমযানে বাজার অস্থিতিশীল করলেই ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতা এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ব্যবসা করব সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে। অসাধু ব্যবসায়ীর তকমা নেব না। এই অপবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।
মানুষের সামনে দ্বীন ও তার সত্যতা তুলে ধরা দরকার। অনেক মানুষের সামনে সত্যের আলো অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়। বিশেষ করে যারা কোনো দল ও মতের অন্ধ অনুসারী, তারা হক ও সত্যের দেখা পায় না। নিজের মত ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো কিছু মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে না। দ্বীন প্রচারকদের পারস্পরিক সহযোগিতা করা দাওয়াতের একটি আবশ্যিক করণীয়। কোনো দ্বীন প্রচারক যেন ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন না করেন। শুধু তার কথাই লোকেরা মানবে, তার কথাই সবার আগে থাকবে, এমন চিন্তা যেন তাকে পেয়ে না বসে। এটা ঠিক যে মানুষ তার হাত দিয়ে কল্যাণ সাধনকে ভালোবাসে। কিন্তু অন্যের হাত দিয়ে কল্যাণ হওয়াকে অপছন্দ করা তার জন্য উচিত নয়। বরং তার জন্য আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত হওয়াই বড় কথা। দ্বিনের বৃহত্তর স্বার্থে দ্বীন প্রচারকরা সবাই মিলে একজোট হবেন এটা ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা। এটা সময়ের দাবি। তারা একে অন্যকে সাহায্য করবেন, সহযোগিতা করবেন, পরস্পরে শলাপরামর্শ করবেন এটা অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসনে সহায়ক। সবাই এক পথের পথিক হবেন। আল্লাহর পথে দুজন দুজন, তিনজন তিনজন এবং চারজন চারজন করে দাঁড়িয়ে যাবেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলো, আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি, তা এই যে তোমরা আল্লাহর জন্য দু-দুজন বা এক-একজন করে দাঁড়িয়ে যাও...।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ৪৬)
দেখা যায় অকল্যাণ ও খারাপ পথের সবাই একাট্টা, একজোট ও একমত। দাওয়াতের পথে কে কোথায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে ভুল করছেন, দাওয়াতের পদ্ধতিতে ত্রুটি করছেন, কেন তারা ভালোবেসে একে অপরকে বলবেন না? আল্লাহ তাআলা মুমিনদের এমন সব গুণ তুলে ধরেছেন, যাতে প্রতীয়মান হয় তারা একতাবদ্ধ এবং একে অন্যকে সাহায্যকারী। আল্লাহ বলেন, ‘আর মুমিন পুরুষ ও নারীরা পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা সালাত কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৭১) পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা আবশ্যক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। আসলে তারাই সফলকাম। তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৪-১০৫)
শয়তান চায় একজন দ্বীন প্রচারক তার মতো আরেকজন দ্বীন প্রচারককে দাওয়াতের ময়দানে সফল হতে দেখে হিংসাকাতর হোক। যারা মন্দ ও খারাপ কাজের দাওয়াত দেয় ওরা তো ভালো ও কল্যাণমুখী কাজের দাঈদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদই চায়। ওরা জানে, মঙ্গল পথের দাঈদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা তাদের জন্য সফলতা বয়ে আনবে। পক্ষান্তরে অনৈক্য ও অসহযোগিতা তাদের ব্যর্থতা ও অসফলতা নিশ্চিত করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো। আপোষে ঝগড়া করো না। তাহলে তোমরা শক্তিহীন হবে ও তোমাদের প্রতিপত্তি উবে যাবে। তোমরা ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৬) সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রতিটি মানুষের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি)
সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনেকে আগ্রহ দেখায় না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজারো অন্যায়কে ঠান্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদকে তারা অযথা ঝামেলায় জড়ানোই মনে করে। এতে মানুষ নিজেদের অজান্তেই গোটা জাতির ওপর আরো বড় বিপদ ডেকে আনে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ) সমাজে অপরাধ তখনই বেড়ে যায়, যখন অপরাধী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! ন্যায়বিচারে তোমরা অটল থেকো, আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকারীরূপে যদিও নিজেদের প্রতিকূলে যায় অথবা পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের, সে ধনী বা গরীব হোক, আল্লাহই উভয়ের জন্য উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে নিজ নিজ খেয়ালখুশির (পক্ষপাতিত্বের) বশীভূত হয়ো না।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ১৩৫)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দাদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি মানুষকে সৎকাজে আদেশ করার প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণে তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ থেকে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)
ইসলামে সব ধরনের জুলুম-অত্যাচার কঠোরভাবে হারাম করা হয়েছে। জুলুমকারী সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট। আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য জুলুমকে হারাম করে নিয়েছেন। এটি মানুষের জন্যও নিষিদ্ধ। এটি কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। হাদিসে কুদসিতে নবিজী ঘোষণা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের জন্যে জুলুম করা হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও জুলুম হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা একজন অন্যজনের উপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম, তিরমিজি)
অত্যাচারীরা মনে করে, কেউ তাদেরকে কখনো পাকড়াও করবে না। অথচ আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এভাবে- ‘আর অত্যাচারীরা অচিরেই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়?’ (সুরা আশ-শুআরা : আয়াত ২২৭) আয়াতে ‘তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়?’ এর মর্মার্থ হলো- জাহান্নাম। এখানে পাপীদের জন্য রয়েছে কঠিন সতর্কবাণী। হাদিসেও সতর্কবাণী এসেছে এভাবে- ‘অত্যাচার করা থেকে দূরে থাকো! কারণ অত্যাচার কেয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণ হবে।’ (মুসলিম)
‘(হে নবি!) তুমি কখনো মনে করো না যে, সীমালংঘনকারীরা (জালেমরা) যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন, যেদিন সব চোখ স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহব্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে। নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (জ্ঞান) শূন্য। (হে নবি!) সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক কর; যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যখন সীমালংঘনকারীরা (জালেমরা) বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে কিছু সময়ের জন্য অবকাশ দাও; আমরা তোমার আহবানে সাড়া দেব এবং রাসুলদের অনুসরণ করবো।’ (তখন তাদেরকে বলা হবে,) ‘তোমরা কি আগে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই?’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪২-৪৫)
জাহান্নামে জুলুম/জালেমদের অনেক ধরনের কঠোর শাস্তি রয়েছে। জুলুমের অপরাধী/জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে কম শাস্তি যাকে দেয়া হবে; তার বিবরণ থেকে বুঝা যায়; জাহান্নাম কত কঠিন জায়গা। আর জুলুমের শাস্তি কত মারাত্মক! হাদিসে এসেছে-
হজরত নুমান বিন বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘কেয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মাঝে সবচেয়ে সহজ ও হালকা শাস্তি দেয়া হবে যে ব্যক্তিকে; সে হলো তার পায়ের তলাতে দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার থাকবে, যার কারণে তার মাথার মগজ ছোট মুখ বিশিষ্ট হাড়ির ন্যায় উথলাতে থাকবে।’ (বুখারি, মুসলিম) জালেম ও জুলুমের শাস্তি হবে কঠিন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই এই বলে সতর্ক করেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা জালেম, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ২২)
মুমিন মুসলমানের উচিত, জুলুম থেকে বিরত থাকা। জুলুমের সহযোগিতা থেকে বিরত থাকা। নিজেদের জুলুম থেকে বিরত রাখা ঈমানের একান্ত দাবি।