বাংলার মুসলমান-বাংলা ভাষা ও বখতিয়ার খলজি
মুহাম্মদ নূরে আলম
অত্যাচারী বর্বর হিন্দু ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের হাত থেকে বাংলার মুসলমান, নি¤œবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের রক্ষা করেছিলেন মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী। তার মহান বিজয়কে বিতর্কিত করতে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচার করছে তথাকথিত সেক্যুলার এবং বর্ণ হিন্দু উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণরা। আর বাংলাদেশের কথিত সেক্যুলাররাও ব্রাহ্মণদের সেবাদাস হিসেবে এই মিথ্যাচারের পালে হাওয়া দিচ্ছে। বঙ্গ বিজয়ী বখতিয়ার খলজি ইতিহাস সৃষ্টিকারী একজন মহানায়ক। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি স্বাধীন অ্যাডভেঞ্চার এবং দুঃসাহসিক অভিযানকারী। এই মহাবীরের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ইনসাফভিত্তিক সমাজ কায়েমেও তিনি অদ্বিতীয়। মাত্র ১৭ জন মুজাহিদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র বিজয় ইতিহাসে এই প্রথম। অদ্যাবধি তাঁর রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। অসাধারণ সমরকৌশল, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা এবং কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় এ অসাধ্য সাধিত হয়েছিল। চৌকস গোয়েন্দা বাহিনী এ অভিযানে মূল ভূমিকা রাখে। ১২০৫ সালের ১০ মে (১৯ শে রমযান ৬০১ হিজরি) সংঘটিত হয়েছিল এই মহাবিপ্লব। সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবাধিকার পরিস্থিতি না জানলে বখতিয়ার খলজির নদিয়া ও লাখনৌতি বিজয় অভিযান সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির তৈরি হতে পারে। ইতিহাসে আর কোনো সেনাপতি মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে কোনো রাষ্ট্র জয় করেছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। বখতিয়ার খলজি যদি বাংলায় না আসতেন তাহলে বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালীর রাষ্ট্রিক ও জাতিগত পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটতো না! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. রিচার্ড বি. ইটন বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়েছেন এভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘এই ঘটনা স্বতন্ত্রভাবে ব্যতিক্রম কিছু নয়, কারণ প্রায় একই সময় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত সার্বভৌম মুসলিম শাসকরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই শাসন করতেন। অবশ্য, ব্যতিক্রম হলো ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রদেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাতেই অঞ্চলটি মোটামুটিভাবে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মোট আয়তনের সমান। স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশ সদস্য শাসকশ্রেণীর ধর্ম ইসলামকে গ্রহণ করেছিলো। এটা ছিলো চরম পরিণতিসূচক ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত; কারণ মুসলমান জনসংখ্যর উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করে। বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অধীনে থাকে।............বাঙালিরা বর্তমানে আরবদের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠী। (রিচার্ড বি. ইটন: ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, প...১৬-১৭) বাংলাদেশের মুসলিম অধিবাসীরাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলো। পাকিস্তান ভেঙে তারাই আবার বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। এই কৃতিত্ব বখতিয়ার খলজিরই প্রাপ্য। সেন শাসক ও ব্রাহ্মণদের হাতে ধ্বংস হতে যাওয়া বাংলা ভাষার মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে যেতো। অথচ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান দাবির তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। একটি উপন্যাস, একটি কাব্যগ্রন্থ, দু-একটি নাটক এবং কিছু বিচ্ছিন্ন ছড়া কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিগত ৮০০ বছরে বখতিয়ারের মহাবিজয় নিয়ে মহাকাব্য, কাব্য, ছড়া, পদ্য, গদ্য, গল্প, উপন্যাস, আখ্যান, উপখ্যান, থ্রিলার, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র নাটক, নাটিকা ইত্যাদি আশানুরূপ কেন রচিত হয়নি? অথচ বখতিয়ারের জয়যাত্রা নিয়ে রচিত হতে পারত মহাকাব্য। চিত্রায়িত হতে পারত কালজয়ী সব চলচ্চিত্র। জাতি হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। কবি আল মাহমুদ বলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের জুলুম নিপীড়নে বাংলার সকল শ্রেণি, সকল ধর্মের ও সকল সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তখন ইমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয় বাংলার মানুষকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়েরই ফসল। বখতিয়ার খলজি আক্রমণকারী নয়, তিনি নাযাতকারী। (প্রথম প্রভাত, বঙ্গবিজয়ের ৭৯৩ তম স্মারক, প...১০৪)। বখতিয়ার আগমনের পূর্বে বাংলাদেশের সার্বিক পরিবেশ ছিলো খুবই নাজুক। বর্বরতা, পৈশাচিকতা আর নোংরামির দাপট সর্বত্র। বাংলাভাষা নির্বাসনে, সাধারণ নাগরিকরা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। নারী নিগ্রহ অতীতের পরিসংখ্যান ভেঙে দেয়। রামপালে বল্লালসেন কর্তৃক আদম শাহ ও তার সাত হাজার মুজাহিদকে হত্যার রেশ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত। উচ্চবিত্তদের আধিপত্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব জায়গায় সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলার রাজত্ব। ফলে মানবতার পক্ষে একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেই রেনেসাঁ বহন করে নিয়ে আসেন বাঙালির মুক্তির দূত, ইতিহাসের কান্ডারি, সিপাহসালার বখতিয়ার খলজি। কিন্তু কেন বাহির থেকে আসা একজন সেনাধ্যক্ষ ইতিহাসের কিংবদন্তি নায়ক হয়ে রইলেন সে বিষয়টি জানতে তৎকালীন মানবীয় সংকট ও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। গৌড়রাজ্যের শাসক শশাঙ্ক তার পুরো শাসনামলে বৌদ্ধ নিধনে নিযুক্ত ছিলেন। নামজাদা ভাষাবিজ্ঞানী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর জানান: কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছিলো- সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তাদেরকে হত্যা করবে, যে না করবে তার মৃত্যুদ- হবে। (শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পলাশ প্রকাশনী, ১০ কবি জসিমউদদীন রোড, ঢাকা ১২১৭, প্রথম পলাশ প্রকাশনী সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২ইং, পৃষ্ঠা ১২)।
সেন আমলে বাংলা চর্চা নিষিদ্ধ: দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলায় আগত ব্রাক্ষণ্যবাদী সেন রাজারা বাংলা লৌকিক ভাষা হওয়ায় রাজদরবারে বাংলা ভাষার স্থান দেননি। শুধু তাই নয় বাংলা ভাষা যাতে সাহিত্যের লিখিত মাধ্যম না হয়, সেজন্য ধর্মীয় নীতিবোধ প্রচারের মাধ্যমে বাংলা প্রচলনে বাধা সৃষ্টি করে। ধর্মীয় অনুশাসনের ভয় দেখিয়ে সেন রাজারা বাংলা ভাষার চর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। তারা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের দ্বারা প্রচার করেছিলেন যে, অষ্টাদশ পুরান ও রামচরিত, মুখের ভাষা বাংলায় অনুবাদ করলে বৌরব (ভীষণ পাপীদের জন্য নির্দিষ্ট নরক) নামক নরকে যেতে হবে। চর্যাপদের ভাষা বাংলা হলেও পড়তে এমন কঠিন লাগে কেন? তার বড় কারণ অত্যাচারী সেন রাজাদের হাত থেকে বাংলা ভাষার বর্ণমালা রক্ষার জন্য এমন কঠিন ভাষায় চর্যাপদ রচনা করেন যাতে সেন রাজারা প্রমাণ না করতে পারে এটা বাংলাভাষা। চর্যাপদের কবিরা রাজরোষের শিকার হয়েছিল। কেননা তখন বঙ্গদেশের সামন্তরাজারা সংস্কৃতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তারা স্থানীয় অনার্য ভাষা পছন্দ করত না। এ ভাষায় ঈশ্বরের বন্দনা করা নিষেধ ছিল। রাজমহিমা প্রকাশ করা যেত না এ ভাষায়। তবুও চুপি-চুপি, আড়ালে-আবডালে বঙ্গকবিরা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতেন। এক সময় তাদের ওপর নেমে এসেছিল রাজরোষ। তাদের রক্তে গৌড়ের, বঙ্গের, রাঢ়ের রাজপথ রঙিত হয়েছিল। তারা বাংলা ভাষার পান্ডুলিপি নিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ দিয়ে নেপালে পালিয়ে গিয়েছিল। এজন্য চর্যাপদের পান্ডুলিপি ১৯০৭ সালে ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থশালা থেকে উদ্ধার করেন। চর্যাপদের কবি কাহ্নপা একবার রাজদরবারে গিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় কবিতা পড়তে। কিন্তু তাকে রাজদরবারে তো প্রবেশ করতে দেয়াই হয়নি, বরং রাজা সামন্ত কবি কাহ্নপার হাত কেটে দিয়েছিল। যাতে সে আর কখনও অপবিত্র ভাষায় কবিতা না লিখতে পারে। বাংলার ইতিহাসে সুলতানী আমলে বাংলা ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মধ্যযুগীয় কবি কৃত্তিবাস ওজা ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় অনুশাসনকে ভয় না করে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বাল্মীকির রামায়ণ। মালধর বসুও ছিলেন কায়স্থ। তিনিও ধর্মীয় নীতিবোধকে প্রশ্রয় না দিয়ে জয়দেবের গীত গোবিন্দের বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ নামে। হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মকিতাব ঐতরেয় আরণ্যকে বাঙালিরা পিশাচ, ইতর, দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর, ম্লেচ্ছ হিসেবে আখ্যায়িত। বাংলাবুলিকে আর্যঋষিরা পক্ষীভাষা হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। সেন আমলে বাংলা জবানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে সংস্কৃত বুলি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে তদানীন্তন হিন্দু শাসকগোষ্ঠী। গৃহকোণে বন্দি হয়ে পড়ে বাংলাভাষা। জানিনা কতদিন বঙ্গবাণী জন্মিয়া ঘরের কোণে লাজুক বধূটির মত নিরিবিলি বাস করিতেছিল। সেদিন বাঙ্গালার অতি স্মরণীয় সুপ্রভাত, যে দিন সে সাহিত্যের বিস্তীর্ণ আসরে দেখা দিল। বাস্তবিক সেদিন বাঙ্গালীর এক নবযুগের পূণ্যাহ। ...যাঁহারা বলিয়াছিলেন- অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি। ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। নিশ্চয় তাহারা বাংলা ভাষাকে আবাহন করে আনেন নাই। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিপক্ষেরাই সনাতনপন্থিগণকে বিমোহিত করে বেদমার্গ হইতে ভ্রষ্ট করিবার জন্যই এই মোহিনী বঙ্গবাণীর সাধনা করিয়াছিল। পরে স্বার্থের খাতিরে লৌকিক দেবতার পূজকরাও তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছিল। (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খণ্ড প্রাচীন যুগ, মাওলা ব্রাদার্স, ৩৯ বাংলাবাজার ঢাকা ১২১৫, তৃতীয় মুদ্রণ: আগস্ট ২০০৬, ISBN: ৯৮৪ ৪১০-১০৬ ৯, পৃষ্ঠা ১৪)।
বখতিয়ারের বাংলা বিজয় না হলে আজ দেশের রাষ্ট্রভাষা থাকত সংস্কৃত। মুসলিম মুলুক কায়েম হওয়ায় স্বাতন্ত্র্য ফিরে পায় বাংলাভাষা। আচার্য শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনের ব্যক্ত বাণী: মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করতেছিল। ...হীরা কয়লা খনির মধ্যে থেকে যেমন জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকিয়ে থেকে যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করে থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। ...বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালা মুসলমানদের মাতৃভাষা। (শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন: বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব (প্রবন্ধে), উদ্ধৃত: মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৮-২৯)। এটাই চিরন্তন সত্য। মুসলিম শাসনের প্রভাবে বাংলা বুলি ও সাহিত্যে পয়দা হয় রেনেসাঁ। এই নবজাগরণে সৃজিত হয় কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। সুলতানি ও মুঘল আমলে ৪০ জন মুসলিম কবি ও ৩০ জন হিন্দু কবি ধর্মীয় কাব্য, রসপ্রধান কাব্য, বীরগাঁথা, রম্যকাব্য ও মর্সিয়া কাব্য রচনা করেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম-হিন্দুতে কোনো তফাৎ ছিলো না। মুসলিম বিজয় ছিলো বাংলার প্রতি বিরাট আশীর্বাদস্বরূপ। এটা বাংলাভাষী লোকদেরকে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ করে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। কেবল এই বিরাট সংহতি এবং মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার গুণেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি উৎসাহিত হয়। যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় তরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আরও কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকত। তাহলে বাংলাভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো। (ড. এম. এ. রহিম: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রথম খ-, ভূমিকা, (তরজমা- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) বাংলা একাডেমি ঢাকা, দ্বিতীয় পুনঃমুদ্রণ: জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ৮)।
বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে বখতিয়ার খলজি ও বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান খর্ব: বখতিয়ার খলজি বাংলা জয়ের পর খুব বেশিদিন এর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন নি। কিছুদিনের মধ্যেই তিব্বত অভিযানে বের হন। তিনি তাঁর অধীনস্থদের হুকুম দেন, আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে। অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে মনোযোগ দেন তারা। মোটকথা একটি স্বাধীন স্বপ্নভূমি, আজাদ আবাসভূমি সৃষ্টিতে যা যা করা দরকার সকলক্ষেত্রেই তাঁদের দৃষ্টি পড়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত লিখেছেন, বখতিয়ার খলজি দিল্লি সুলতানের অধীন একটি প্রাদেশিক সরকার লাখনৌতিতে গঠন করেন এবং ক্রমে ক্রমে রাঢ়, গৌঢ় ও বরেন্দ্র এলাকা দখল করেন। তিনি মগধ ও মিথিলা বিজয় করে বঙ্গে আসেন এবং কামরূপ ও তিব্বতের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তিনি বিহার রাজ্যের নামকরণ করেন। তিনি বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। (আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশ: জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০০, ৫১ পুরানা পল্টন ঢাকা-১০০০, ISBN ৯৮৪-৪৬৫-২১৯-১৭, পৃষ্ঠা ২৫০।
ইসলামী চেতনা বিনাশের উপকরণ বাংলা সাহিত্যে বহু। সাহিত্য কাউকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে না। বরং ধীরে ধীরে হত্যা করে তার চেতনাকে। আর বাংলায় নিহত হচ্ছে বাঙালী মুসলমানের ইসলামী চেতনা। এবং সেটি চলছে বহু শত বছর ধরে। সে চেতনা বিনাশী প্রকল্পের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মোহম্মদ কবিরউদ্দীন সরকার বহু বছর আগে বাংলার পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তৎকালীন ‘বাসনা’ পত্রিকায় (২য় সংখ্যা, জৈষ্ঠ, ১৩১৬) লিখেছিলেন, “আজকাল বিদ্যালয়াদিতে যে সকল সাহিত্য ও ঐতিহাসিক পুস্তকাদি পঠিত হইতেছে, তাহা হিন্দু দেবদেবী, মুণি-ঋষি, সাধু-সন্নাসী, রাজা-মহারাজা, বীর-বীরাঙ্গনা ইত্যাদির উপাখ্যান ও জীবনচরিত আদিতেই পরিপূর্ণ হিন্দুর ধর্ম-কর্ম, ব্রত-অর্চনা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদির মাহাত্ম্য বর্ণনাতেই সেই সব পাঠ্যগ্রন্থ অলংকৃত। মুসলমানদের পীর-অলি-দরবেশ, নবাব-বাদশাহ, পন্ডিত-ব্যবস্থাপক. বীর-বীরাঙ্গনাদির উপাখ্যান বা জীবন-বৃত্তান্ত অথবা ইসলামের নিত্য-কর্তব্য ধর্মাধর্ম্ম ব্রত উপাসনা, খয়রাত-যাকাত ইত্যাদির মাহাত্ম্যরাজীর নামগন্ধও ঐ সকল পুস্তকে নাই, বরঞ্চ মুসলমান ধর্মের ধার্মিকদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষের এইসব বই বর্ণিভাবই বর্ণিত আছে। প্রথম বর্ণ পরিচয়কাল হইতেই আমাদের বালকগণ রামের গল্প, শ্যামের কথা, হরির কাহিনী, কৃষ্ণের চরিত্র ইত্যাদি পড়িতে থাকে। যদু-মধু, শিব-ব্রহ্মা, রাম-হরি ইত্যাদি নামেই পাঠ আরম্ভ করিতে হয়। কাজেই আমাদের সরলমতি কোমল প্রকৃতি শিশুগণ বিদ্যালয় পঠিত হিন্দুগণের উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং আমাদের জাতীয় পবিত্র শাস্ত্র ও ইতিহাস উপাখ্যান ধর্ম-কর্মাদির বিষয় অপরিজ্ঞাত হইয়া থাকে।” (সূত্রঃ মুস্তফা নুরউল ইসলামঃ সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, বাংলা একাডেমী ঢাকা। পৃঃ ৩০-৩১)।
বখতিয়ারের উপর বাংলাভাষায় একমাত্র উপন্যাস ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’। এটা রচনা করেন ইতিহাস ও শেকড় সন্ধানী কথাসাহিত্যিক শফিউদ্দীন সরদার। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। আসকার ইবনে শাইখ বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয় নিয়ে নাটক লিখেন অশ্বারোহী। এটি তার রাজ্য রাজা রাজধানী নাট্যসিরিজের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বখতিয়ার খলজির স্মরণে বাংলাভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবি আল মাহমুদের একটি শ্রেষ্ঠকীর্তি। এছাড়া কবিতা লিখেন গোলাম মোস্তফা ‘বঙ্গ বিজয়’ (কাব্য কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত), মুফাখখারুল ইসলাম ‘বখতীয়ার খিলজী’। দ্বীজেন্দ্র লাল রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় যা রচনা করেছেন সেগুলো নিতান্তই সাম্প্রদায়িকতা ও মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। বখতিয়ার খলজি ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসনে নিপীড়িত বাঙালি মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু বৌদ্ধদের মহা মুক্তির মহানায়ক। কিন্তু ইংরেজ ও তার পোষ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখক ও ঐতিহাসিকরা তার যথার্থ মূল্যায়ন দূরে থাক, তার চরিত্র হনন করে ছেড়েছে। তারা তার চরিত্র অঙ্কনের বেলায় তাকে দস্যু/লুন্ঠনকারী হিসেবে দেখিয়েছে। যারা নিজেদের প্রগতিশীল ও আধুনিক বলে দাবি করে, সেই বামপন্থীরাও বখতিয়ার খলজির প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, মুসলমানরা আসার আগে এদেশের মানুষ সেলাই করা পোশাক পরতে জানতো না। মুসলমানরাই এদেশে কাটা কাপড় ও দর্জি শিল্পের প্রচলন করে। পাকপ্রণালী যে রীতিমত একটা শৈল্পিক ব্যাপার এ ধারণা মুসলমানরাই এদেশে প্রথম নিয়ে আসে। আধুনিককালের কোন অনুষ্ঠানই পোলাও অথবা বিরিয়ানী ব্যতীত চিন্তা করা যায় না। মিষ্টি খাদ্যদ্রব্য ও তরকারীতে সুগন্ধী ও মশলার ব্যবহারও মুসলমানদের হাত দিয়ে এ দেশে এসেছে। এলাচী, দারুচিনি, কিসমিস থেকে শুরু করে পিয়াজ, রসুন, আদার ব্যবহারও মুসলমানদের অভিনব রন্ধন প্রকৌশলের ফল। সেনদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়া পরবর্তী সাধারণ জনতা মুসলমানদের দুই ঈদ, রাসূলের সা. জন্মবার্ষিকী, শবই বরাত, শবই মেরাজ, বেড়া উৎসব ও মহররম পালনের পালনের মতো সুস্থ সংস্কৃতির সাথে পরিচয় লাভ করে। মুসলিম সভ্যতার অংশ হিসেবে বাংলায় নতুন সভ্যতার আবির্ভাব ঘটে। নতুন নতুন স্থাপত্য, নকশা ও মুসলিম বসবাসের ফলে ইসলামি নন্দনতত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। মুসলিম বিশ্ব ও পৃথিবী জুড়ে বাংলার সাথে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করে। বাংলায় মুসলিম আগমনের ভিতর দিয়ে এখানকার মাটি ও মানুষ পেয়েছিল নতুন এক বিশ্ব পরিচয় যার সম্মিলিত নাম হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ। বখতিয়ার খলজির নামে এখানে অনেক কিছুরই নামকরণ করা দরকার ছিল। কিন্তু কে করবে? ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় খলজি রোড ছাড়া আর কোনো নামকরণের কথা আমার জানা নেই। জাতির শেকড়কে ভুলে কেউ বড় হতে পারে না। বখতিয়ার খলজিই বাংলাদেশি নাগরিকদের শেকড়। এ উপলব্ধি থেকে একাডেমিক পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম, সাহিত্যকর্মে বখতিয়ারের বিজয় গাঁথাকে মহিয়ান করে তুলতে হবে। হায়! বাঙালী মুসলিম!!
তথ্যসূত্র:
১. প্রথম প্রভাত, বঙ্গবিজয়ের ৭৯৩ তম স্মারক, ধানমন্ডি ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯৭
২. শফীউদ্দিন সরদারঃ বখতিয়ারের তলোয়ার, মদীনা পাবলিকেশানস, বাংলাবাজার ঢাকা, সপ্তম সংস্করণ, মার্চ ২০১১
৩. ড. আসকার ইবনে শাইখ: রাজ্য রাজা রাজধানী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ এপ্রিল ২০০৫
৪. আল মাহমুদের কবিতা, হরফ সংস্করণ, ২৫ মে ১৯৮৪, কলকাতা ৭০০০১৯
৫. রিচার্ড বি. ইটন: ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, হাসান শরীফ অনূদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৮
৬. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন: বৃহৎবঙ্গ প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৮-৩০; উদ্ধৃত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃষ্ঠা ৭৫
৭. ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খণ্ড প্রাচীন যুগ, মাওলা ব্রাদার্স, ৩৯ বাংলাবাজার ঢাকা ১২১৫, তৃতীয় মুদ্রণ: আগস্ট ২০০৬, ওঝইঘ: ৯৮৪ ৪১০-১০৬ ৯, পৃষ্ঠা ১৪
৮. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন: বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব (প্রবন্ধে), উদ্ধৃত: মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৮-২৯
৯. ড. এম. এ. রহিম: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাস প্রথম খণ্ড, ভূমিকা, (তরজমা- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) বাংলা একাডেমি ঢাকা, দ্বিতীয় পুনঃমুদ্রণ: জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ৮।