স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা
ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে সার্বভৌম আত্মমর্যাদা নিয়ে দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে স্বাধীনতা বলা হয়। বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি বহু প্রতীক্ষিত একটি স্বপ্নের নাম। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’..... গানটি রূপক অর্থে লেখা হলেও আক্ষরিক অর্থেই কোন দেশের স্বাধীনতা আনতে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও অনেক সময়ই এ স্বাধীনতা হরণ করে নেয় কিছু অপশক্তি ও হানাদার বাহিনী। আমাদের এ প্রিয় জন্মভূমিও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতিকে ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষকদের বর্বরোচিত শোষণের নির্মম শিকার হতে হয়। পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় অর্জন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনা করতে হলে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করতে হবে, যখন বৃটিশ বাহিনী এ দেশ ত্যাগ করেছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি চলে যাবার পূর্বে এ উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’ দেশে বিভক্ত করে যায়। ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ইসলামী আইনানুযায়ী পরিচালিত না হয়ে এখানে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অনুসরণ অব্যাহত রাখা হয়। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্যনীতি কোনটিই সেখানে স্থান করতে পারেনি। অধিকন্তু তারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু রাখতে ব্যর্থ হয় এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারাই পাকিস্তান শাসন করতে থাকে। জমিদার ও ধনিক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলা যারা মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি তাদের অগণতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ফলে ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের উভয় প্রদেশের মুসলিমরা ইসলামের অনুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ভুলে গিয়ে ভাষার ভিত্তিতে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হতে শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ইসলামী মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে এ অঞ্চলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ চেতনার উন্মেষ ঘটে। জিন্নাহ-পরবর্তী সকল রাষ্ট্রপ্রধানের অরাজনৈতিক, অদূরদর্শী ও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আন্তঃকাঠামো বিনষ্ট করে এবং সকল ক্ষেত্রে দু’ অংশের মানুষের মধ্যে আস্থায় ফাটল ধরায়। জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর একগুয়েমি ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়। বাধ্য হয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত সামরিক শক্তি না থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন হওয়ার উন্মাদনা এ দেশের মানুষকে জীবন মরণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস যোগায়।
১৯৭১ সালের ০১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। এ দেশের মানুষ সেটি ভঙ্গ করলে পুলিশের গুলিতে অনেক বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এতে ক্ষোভের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে দলীয় নেতাদের নিয়ে সভা স্থগিত করে পল্টন ময়দানে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে হাজির হতে বাধ্য হন। ০২ মার্চ হরতালের ডাক দেন এবং ০৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার কথা ঘোষণা করেন। ০৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে কী ভাষণ দেবেন সে অপেক্ষায় থাকে পুরো পাকিস্তানবাসী। এ দিন সকালে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধু তার বাসায় মিলিত হয়ে বক্তৃতার চার দফা ঘোষণা স্থির করেন। সেগুলো হলো,
১. সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
২. ০১ মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করে সে ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
৩. সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং
৪. অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
০৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো তার সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে জাতিকে অন্ধকারে রেখে সামরিক শাসক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি সমাপ্ত করে। হাজার হাজার পাঞ্জাবী, পুস্তি, বেলুচ রেজিমেন্টের সদস্যদেরকে বিমান ও নৌপথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জমায়েত করে। পুস্তি ও বেলুচ রেজিমেন্টের সদস্যদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের ‘মালাউনদের’ মারার জন্য ভ্রান্ত তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অপারেশনে আনে। ‘মালাউন কেদার হায়’ অথবা কারো বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখে বলে ‘ইয়ে সাচ্চা মুসলিম হায়’ অথবা কবি নজরুল ইসলামের ছবি দেখে বলে ‘ইয়ে মালাউনকা আওলাদ হায়’- ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট চালানোর পর পুস্তি ও বেলুচ সৈন্যদের ইত্যাদি উচ্চারণ থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। কিন্তু গোলাম মোহাম্মদের প্রেতাত্মা পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছিল নির্দিষ্ট টার্গেট। ইয়াহিয়া ঘোষণা দিলেন, দকরষষ ঃযৎবব সরষষরড়হ ড়ভ ঃযবস ধহফ ঃযব ৎবংঃ রিষষ বধঃ ড়ঁঃ ড়ভ ড়ঁৎ যধহফং’- তাদের ধারণা ছিল যে, কিছু মানুষকে হত্যা করলেই সকল আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
বঙ্গবন্ধুর ০৭ মার্চের ভাষণে দু’ধরনের নির্দেশনা পরিলক্ষিত হয়,
১. ‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যার যা আছে সব কিছু.... আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, বন্ধ করে দেবে’। এবং ‘আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
২. ‘সামরিক আইন মার্শল ল’ উইদ্ড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভেতর ঢুকাতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না’।
প্রথম নির্দেশনা বিবেচনায় এনে ০৯ মার্চ জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ পড়াতে হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী অস্বীকার করেন। এ দিনই পল্টন ময়দানে মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘সাত কোটি বাঙ্গালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না’। দ্বিতীয় নির্দেশনায় পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করার আভাস থাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টোসহ অনেক নেতৃবৃন্দই ঢাকা আসেন। পিপিপি বাদে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শেখ মুজিবুর রহমান বরাবর হস্তান্তর করার অনুরোধ করেন।
১৬ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার পরিবেশ সৌহার্দপূর্ণ রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৫ মার্চে অধিবেশন বসার পূর্বেই ১৯ মার্চ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। ২১ মার্চ ভূট্টো ঢাকা এলে ২২ তারিখে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভূট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক চলাকালে তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করার সুবিধার জন্য ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। কিন্তু আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে সরকার বা শেখ মুজিব কেউ মুখ খোলেননি। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এদিনে সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড়ার কথা। কিন্তু সামরিক সদর দপ্তর, গভর্নর হাউজ ও রাষ্ট্রপতির ভবন ছাড়া কোথাও সে পতাকা উড়েনি, উড়েছে বাংলাদেশের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেও ‘জয়বাংলা পতাকা’ উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনে সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের উপর হলুদ রং এর মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে করা হয় পাকিস্তানের যবানিকাপাত। ২৩ ও ২৪ তারিখে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোন বৈঠক হয়নি, তবে ২৪ তারিখ উভয় পক্ষের উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক হয়। ভূট্টোর একগুয়েমিতে পরিস্থিতির কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা না যাওয়াতে এবং ২৫ মার্চের আহূত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার কারণে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ভূট্টো বাদে সকল নেতাই ফেরত যান। ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের উপদেষ্টারা যে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিলেন ২৫ তারিখ সকাল ৯ টায় ভূট্টো তাতে চূড়ান্তভাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।
এরপর সামরিক সরকার সেনা অভিযানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিষয়টি রাত ১১:৩০ টা পর্যন্ত কারোরই জানা ছিল না। ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘রাত সাড়ে এগারটার দিকে নীচ থেকে কাজের লোকদের একজন উপরে এসে জানান যে, ঝন্টু নামক এক যুবক বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ওর কথাই তো আমি ভাবছি। ওয়াজেদ তুমি ওকে উপরে নিয়ে এসো। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে ঝন্টু তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, মুজিব ভাই! পাকিস্তান আর্মিরা আপনাকে মারতে আসছে, আপনি এখনই বাসা থেকে চলে যান। তারা ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইতিপূর্বে ঢাকা শহরে প্রবেশ করার জন্য তৈরি হয়েছে’। ওয়াজেদ মিয়া আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ সন্ধ্যা সাতটার আগেই একে একে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য অঙ্গদলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁর নির্দেশ নিয়ে চলে যান। সন্ধ্যায় আসে ছাত্র নেতৃবৃন্দ। রাত আটটায় এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পুনরায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন’।
মূলত ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এর পরই সেনাবাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়াকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ব্যবহার করে। এরপর মূল ক্ষমতা চলে যায় সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের হাতে। পাকিস্তান ভাঙার মূল নায়ক হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট আইউব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারকানার জমিদার পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো। ’৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৭ টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের বৃহত্তর দল হলেও এ দল পশ্চিমাংশে কোন আসন পায়নি। অনুরূপভাবে পশ্চিমাংশে ৮৮ টি আসন পেলেও পিপিপি পূর্র্বাংশে কোন আসন পায়নি। গণতান্ত্রিক পার্টির নেতার মত কোন আচরণ না করে ভূট্টো একজন সামরিক জান্তার মত একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘পিপিপি জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় আসনে বসতে রাজি নয়’। তিনি আরও বলেন, ‘শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আর আমি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে তার ফর্মুলা হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান কোন সমস্যাই নয়। বিশ হাজারের মত লোক মারতে হবে, সব ঠিক হয়ে যাবে’।
১৯৭১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদর দফতরে বসে সামরিক জান্তার একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল হামিদ, লে. জে. টিক্কা খান, মে. জে. ওমর, মে. জে. আকবর ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার উপ-প্রধান এস এ সউদ। এ বৈঠকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনা করেন। সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ (Operation Searchlight) গঠন করে এ পরিকল্পিত গণহত্যা পরিচালনা করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ (Operation Searchlight) ছিল মূলত ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত ‘অপারেশন ব্লিটজ’ (Operation Blitz) এর পরবর্তী অনুষঙ্গ। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে সকল বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের একমাসের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। পরবর্তীতে তাদের শক্তিমত্তা বিবেচনা করে Operation এর সময়সীমা ২৫ মার্চ ১৯৭১ শেষ প্রহর (২৬ মার্চ জিরো আওয়ার) থেকে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত মোট ১৫ দিন নির্ধারণ করা হয়। Operation এর মূল বিষয়গুলো ছিল,
১. সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে একসাথে অপারেশন চালানো হবে।
২. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক সংজ্ঞান ও শিক্ষকদের আটক করতে হবে।
৩. ঢাকার আশেপাশে একশতভাগ সফলতা অর্জন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
৪. সেনানিবাস দখলের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার করা যাবে।
৫. টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ যন্ত্রসহ সকল ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
৬. সকল পূর্ব পাকিস্তানী (বাঙালি) সামরিক সদস্যের নিকট হতে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করার মাধ্যমে তাদেরকে অকার্যকর করতে হবে।
৭. আওয়ামী লীগকে ভুল পথে পথে পরিচালনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপের অভিনয় করবেন। এতে প্রয়োজনে ভূট্টোর অসম্মতিতেও আওয়ামী লীগের দাবীর সাথে একমত হতে হবে।
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে,
১. ভোররাত ১ টা ১০ মিনিটে কারফিউ জারি করতে হবে এবং টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ যন্ত্রসহ সকল সংবাদ মাধ্যমকে বন্ধ করে দিতে হবে।
২. রেল, নৌ ও সড়ক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঢাকা শহর সীল করে দিতে হবে এবং নৌপথে পেট্রল ডিউটি দিতে হবে।
৩. অপারেশনের সময় শেখ মুজিবসহ ১৫ জন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
৪. হিন্দু অধ্যুষিত ও ধানম-ি এলাকায় বাড়ি বাড়ি অনুসন্ধান করতে হবে।
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস হেডকোয়ার্টার এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে অকার্যকর করতে হবে। দ্বিতীয় ও দশম ইষ্ট বেংগল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে হবে।
৬. গাজীপুরের গোলাবারুদ কারখানা ও রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্র গুদাম রক্ষাকল্পে এদের দখল নিতে হবে।
সেনাবাহিনী ২৫ মার্চের শেষ প্রহরে তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তথা ই.পি.আর, সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেডিও স্টেশন, শাখারীবাজারসহ অন্যান্য স্থান বশে আনতে গিয়ে হিংসাত্মক আক্রমণ চালায় এবং নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করে। বিশেষ করে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমতাবস্থায় আপামর বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ দিনকে বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস বেশ বর্ণাঢ্যভাবে উদযাপন করা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে উদযাপন শুরু হয়। ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের শুভ সূচনা করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন রঙের পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়। জাতীয় স্টেডিয়ামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ, কুচকাওয়াজ, ডিসপ্লে ও শরীরচর্চা প্রদর্শন করা হয়। দিনটিতে সরকারি ছুটি থাকে, পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে এবং বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে ১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক হিসেবে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে এ পদক প্রদান করা হয়। এ পুরস্কার জাতীয় জীবনে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে প্রদান করা হয়ে থাকে।
স্বাধীনতা কোন জাতির পরম চাওয়া ও পাওয়া। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক দিনে দানা বাঁধেনি। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণ হয়নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। সামগ্রিকভাবে জনজীবনে বিরাজ করছে হতাশা ও নৈরাজ্য। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের জনগণ ও সরকার সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সমুন্নত রাখতে হবে। তাই আমরা সবাই যদি দেশকে ভালোবেসে দুর্নীতিমুক্ত এ দেশ গড়ার শপথ নেই তাহলেই স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে এবং সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারবো। ফলে অতি দ্রুতই আমাদের দেশ বিশ্বমানচিত্রে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে ইনশাআল্লাহ।