মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফজিলত

ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহর দাসত্ব তথা তাঁর এবাদাত করার জন্য। আল্লাহ বলেন, “আর জিন এবং মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যেন তারা আমার এবাদত করে ( সূরা আয যারিয়াত : ৫৬)
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। রমযান মাসের সিয়াম পালন হচ্ছে ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আল্লাহ তায়ালা দি¦তীয় হিজরীতে রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে মুসলমানদের উপর রমযানের সিয়াম ফরজ করেছেন। তাই কেউ যদি রমযানের সিয়ামকে স্বজ্ঞানে অস্বীকার করে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। রমযানের সিয়ামকে প্রতিটি বালেগ মুসলিম নর-নারীর জন্য আবশ্যকীয় করা হয়েছে। আবার সিয়াম পালনকারীর জন্য অনেক বড় পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
সিয়াম আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা, পবিত্র রমযান মাসে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই হলো সওম। ফরজ এবাদতগুলোর মধ্যে সিয়াম হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণমূলক এবাদত। যা দীর্ঘ একমাসব্যাপী বিরতিহীনভাবে আদায় করতে হয়। রাসূল (সা.) বলেন; তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে, যা অন্য কোন এবাদতের মত নয়। (সুনানে নাসাঈ)।
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে ধৈর্য্যরে শিক্ষাদান এবং রিপুর কামনা বাসনা দমন করার জন্য রমযান মাসের সিয়ামকে ফরজ করেছেন। সিয়াম পালনের বিধান উম্মতে মুহাম্মদীর মত পূর্ববর্তী সকল জাতির উপর ফরজ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন; “হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রমযানের সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির লোকদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়ার গুণাবলী (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পারো।” সূরা আল বাকারাহ : ১৮৩। রমযানের সিয়াম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, “রমযান মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানবজাতির জন্য হেদায়েত বা পথপ্রদর্শক এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, তার জন্য এ সম্পূর্ণ মাসটিতে সিয়াম পালণ করা অপরিহার্য”। (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫)।
রমযান মাসেই মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে। নাযিল করা হয়েছে লাইলাতুল কদরের রজনীতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ; “ আমি এ কুরআন নাযিল করেছি কদরের রজনীতে। তুমি কি জান কদরের রজনী কী ? কদরের রাজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। ফেরেশতাগণ এবং রূহ তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়”। (সূরা আল কদর : ১-৪)।
সিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়। সম্পদশালীগণ গরীব ও অনাহারী মানুষের জীবন যাপনের কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ পায়। ফলে তারা দান সাদকা করতে উৎসাহিত হয় এবং অনাহারী-অভাবী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষ অন্যায়, পাপ কাজ হতে বিরত থাকার প্রয়াস পায়। হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা ও ধুমপানে আসক্তি ইত্যাদি বদ অভ্যাস পরিহার করতে পারে।
তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জনকে সিয়ামের মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। একজন মুমিনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে তাকওয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে বলা হয়, প্রতিটি এবাদাতের প্রাণ হলো তাকওয়া। প্রাণহীন দেহ যেমন মূল্যহীন, তেমনি তাকওয়া বিহীন এবাদাতও মূল্যহীন। তাকওয়ার মূল স্পীরিট হলো প্রতিটি মুসলমানকে সকল প্রকার অন্যায়, পাপাচার এবং নাফরমানিমূলক কাজ হতে বেঁচে থাকা। মূলত: আল্লাহ তায়ালার ভয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় দুনিয়ার সকল প্রকার অন্যায়. পাপাচার এবং নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার নামই হলো তাকওয়া। আর পবিত্র রমযান মাসের সিয়াম পালনের মাধ্যমে এই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি প্রতিটি মানুষ অর্জন করে থাকে। আর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমেই মুমিন জীবনে সফলতা লাভ করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জীবন চলার পথ বের করে দেন। আর ধারণার অতীত জায়গা থেকে রিজিকের ফয়সালা করে দেন”। (সূরা আত-তালাক : ২-৪)।
মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট বান্দার সম্মান ও মর্যাদার তারতম্য কেবলমাত্র তাকওয়ার মানদন্ডেই বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নিকট সেই ব্যক্তিই সম্মানিত যে অধিক তাকওয়াবান। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শুনেন এবং খবর রাখেন।” (সূরা আল হুজুরাত : ১৩)।
স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিটি মুসলিম নর নারীর উপর রমযানের সিয়াম ফরজ বা বাধ্যতামূলক। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন. “যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমযানের একটি সিয়াম ও ভঙ্গ করে সে আজীবন সিয়াম পালন করলেও এ সিয়ামের হক আদায় হবে না ”। (সহীহ আল বুখারী : ৪/১৬০)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) অনুরূপ সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হযরত আলী (রা:) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমযানের একটি সিয়াম ভঙ্গ করবে, সে আজীবন সেই সিয়ামের (ক্ষতিপূরণ) আদায় করতে পারবে না”। (মুসান্নাফে আাবি শাইবা : হাদিস : ৯৮৭৮)।
সিয়ামের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য : মহান আল্লাহ তায়ালা রমযানের সিয়াম ফরজ করেছেন তাকওয়ার গুণাবলী অর্জনের জন্য। এটি এমন একটি এবাদাত যা দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণমূলক এবং কষ্টকর। তাই এর ফজিলত ও অন্যান্য এবাদাতের তুলনায় অনেক বেশী। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “মানুষের প্রত্যেকের আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়, একটি নেকীর সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আলœাহ তায়ালা এরশাদ করেন, কিন্তু সিয়াম আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দিব। কেননা সে আমার জন্যই কামনা বাসনা এবং পানাহার পরিহার করে।” (আল হাদিস)। মহানবী (সা:) আরও বলেন, “সিয়াম ঢালস্বরপ । তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে, সে যেন বলে আমি রোজাদার বা সিয়াম পালনকারী। যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর শপখ! অবশ্যই সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও বেশি প্রিয়। সিয়াম আদায়কারীর জন্য রয়েছে দুটি খুশি যা তাকে আনন্দিত করে। সে যখন ইফতার করে সে খুশি হয় এবং সে যখন তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন সিয়াম আদায়কারী আনন্দিত হবে ”। (সহিহ আল বুখারী : ১৯০৪)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত , রাসূল (সা.) বলেন, “সিয়াম হলো (জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার) জন্য ঢালস্বরূপ এবং সুরক্ষিত দুর্গ।” (মুসনাদে আহমাদ : ৩৫৭১)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত , রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তারা হলেন, পিতা-মাতা, সিয়াম পালনকারী এবং মুসাফিরের দোয়া।” (বায়হাকী)। রাসূল (সা.) আরও বলেন, “যখন রমযান আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়।” (মুসলিম)। সিয়াম পালনকারীর আরও সম্মান ও মর্যাদার বিষয় হলো তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের আলাদা দরজা থাকবে। তার মধ্যে একটি দরজার নাম হলো রাইয়্যান। সেই দরজা দিয়ে শুধুমাত্র সিয়াম পালনকারীগণই প্রবেশ করতে পারবে। (সহীহ আল বুখারী)।
হযরত হুজায়ফা (রা:) বলেন, “আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, মানুষের পরিবার, ধন - সম্পদ ও প্রতিবেশীর ব্যাপারঘটিত বিভিন্ন ফেৎনা ও গুনাহের কাফফারা হলো সালাত, সওম এবং সাদাকাহ”। (সহীহ আল বুখারী : ১৮৯৫)। কিয়ামতের ময়দানে সিয়াম বান্দার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশকারী হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন : “কিয়ামতের দিন সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত রেখেছ্,ি সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুরআন বলবে, হে আমার রব আমি রাতে তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। তখন তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে ”।
সিয়াম আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের এক অনুপম মাধ্যম। হযরত আবু উমামা (রা:) বর্ননা করেন, “আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল (সা:) আমাকে একটি আমলের আদেশ দিন, তিনি বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমতুল্য কোন কিছুই নাই। আমি পুনরায় বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা:) আমাকে একটি নেক আমলের আদেশ দিন, তিনি বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর কোন সমতুল্য এবাদাত নাই”। (মুসনাদে আহমাদ)।
তাই রমযানের সিয়াম পালন করার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম নর - নারীর উচিত সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার ও নাফরমানিমূলক কাজ পরিহার করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রয়াস চালানো। কারণ অন্যায় ও পাপাচার পরিহার করতে না পারলে পবিত্র মাহে রমযানের পূর্ণ ফজিলত অর্জন করা সম্ভব নর্য়। রাসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং মন্দ কাজ পরিহার করতে পারলো না তার জন্য খাবার - পানীয় ত্যাগ করার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রযোজন নেই ” । (সহীহ আল বুখারী)।
অতএব সিয়ামের গুরুত্ব অনুধাবন করে পূর্ণ ফজিলত তারাই লাভ করবে নিন্মোক্ত শর্তাবলী যারা সঠিকভাবে পরিপালন করবে।
১. সিয়াম হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। লোক দেখানোর জন্য বা দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য সিয়াম পালন না করা।
২. সিয়াম পালন করবে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে। অর্থাৎ যথাসময়ে ইফতার সেহরী করা।
৩. শুধুমাত্র পানাহার, যৌনাচার এবং অন্যায় অশ্লীলতা থাকলে হবে না বরং সিয়াম পালনকারী মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ধোঁকাবাজি এবং ঝগড়া বিবাদসহ সকল প্রকার অন্যায় ও অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকা। সিয়াম পালনের মহান উদ্দেশ্য হলো, সিয়াম পালনকারী ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত কাজ ও আচার আচরণ হতে নিজেকে হেফাজত কররে এবং অন্তরে আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়ার সুখময় জীবন এবং আখেরাতে চির সুখের জান্নাত অর্জনের পথ সুগম করবে। প্রকৃতপক্ষে রমযান মাস হলো খালিসভাবে এবাদাতের মৌসুম। এ মাসের সময়গুলো যতটা পারা যায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করা প্রতিটি মুমিনের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সিয়াম পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তৌফিক দান করুন।