মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান

সাকী মাহবুব
মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের একজন বড় কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় লিখেছেন-
ও আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা
খোদার সেরা দান
বিশ্বভাষার সভায় তোমার
রূপ যে অনির্বাণ।
কবির এ পঙক্তিগুলো থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায় মাতৃভাষা মহান রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। মহান আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকে। তার কোনো নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য আল্লাহ যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভুক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ আকৃতিকে প্রচার করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। আর শিশুর মুখের বুলি ফোটে যে ভাষায়, নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে, যে ভাষা মিশে থাকে তাই মাতৃভাষা। অন্যভাবে -শিশু যখন মায়ের মুখাশ্রিত ধ্বনি শুনে কিছু বলতে শেখে তাই মাতৃভাষা। ভাষাকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভাষা ছাড়া মানব সভ্যতার চাকা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখন্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ তা বুঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানব সভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত।
সব প্রাণীরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের মতো বাকশক্তির বহি:প্রকাশ অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্য। প্রথম মানব হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে - দয়াময় আল্লাহ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা আর রহমান ১-৪)
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে এই পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। সবার ভাষা এক নয়। জাতি ও মানচিত্রভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। বিচিত্র এসব ভাষায় বিভিন্ন জাতি ধর্ম বর্ণের মান্ষু কথা বলে। এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। আল্লাহ তায়ালা বলেন আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে আরেকটি হলো আসমান জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরা রুম -২২)। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৎপথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল (আ:) পাঠিয়েছেন। তাঁদের ওপর যেসব আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছিল সেগুলোর ভাষা ছিল ওই নবী রাসূলদের স্বজাতির ভাষা। নবী রাসূলদের কাছে পাঠানো আসমানি কিতাবসমূহ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হলে সেগুলো তাঁদের জাতি ও সম্প্রদায় বুঝতে পারত না। ফলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত। মাতৃভাষার সঙ্গে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত। আল্লাহ তায়ালা বলেন - আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদেঁর কাছে (আমার বিধানাবলি) পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। (সূরা ইবরাহীম-৪)
হযরত ঈসা (আ:)এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সুরিয়ানি, তাই সুরিয়ানি ভাষায় তাঁর প্রতি ইনজিল অবতীর্ণ হয়। হযরত মুসা (আ:)এর জাতির ভাষা ছিল ইবরানি, তাই ইবরানি ভাষায় তাওরাত অবতীর্ণ হয়। হযরত দাউদ (আ:)এর জাতির ভাষা ছিল ইউনানি, তাই ইউনানি ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ হয়। আর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা:)এবং তাঁর আগমন অঞ্চলের ভাষা ছিল আরবি, তাই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কুরআনুল কারীম আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। আসমানি কিতাবসমূহ যদি নবী -রাসূলদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় না হয়ে ভিন্ন ভাষায় নাযিল হতো, তাহলে নিজেদের উম্মতদেরকে দ্বীনের আলোর দিকে আহ্বান করা নবী রাসূলদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যেত।
বিশ্বনবী (সা:) মাতৃভাষাতেই কোরআনের বাণী প্রচার করে পৃথিবীকে আলোকিত করে তুলেছেন। বিশ্বনবী (সা:) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনো দিন একটি অশুদ্ধ শব্দ ও বাক্যও উচ্চারণ করেননি। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। যেহেতু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। সেহেতু মহানবী (সা:) এর আদর্শ অনুসারে আমাদেরও উচিৎ বিশিদ্ধ মাতৃভাষা ব্যবহার করা। পরিবারে বা সমাজে সুন্দর ও সফল জীবন যাপন করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই। কবি আবদুল হাকীম তাই লিখেছেন - যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গ বাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় জানি।”
একমাত্র মাতৃভাষা দ্বারাই সম্ভব মনের ভাব, ইচ্ছা,আকাঙ্খা, মিনতি বা আবদার নিখুঁতভাবে প্রকাশ করা। তাই প্রত্যেকে ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সাথে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো।তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে এবং স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষ ভাবে মূল্যায়িত হব। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান আধুনিক সাহিত্য জগতে অতি উচ্চে। এ ভাষায় প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে। জনসংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম অবস্থানে আর মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম। বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশের কোটি মানুষের মাতৃভাষাই নয়, ভারতের কলকাতা, চব্বিশ পরগনা, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা,আসাম, বার্মার আরাকান প্রভৃতি অঞ্চলে বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের ঐতিহ্য। এ ভাষার প্রতিটি বর্ণেই ভেসে উঠে বায়ান্নর শহীদ রফিক, বরকত, আবদুল জব্বারের জমাট রক্তের চিহ্ন। এই ভাষার প্রতিটি বর্ণে মিশে আছে মায়ের কান্না। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, যে লক্ষ্য, চেতনা ও আবেগ নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনের এতো পরও এই সময়ে সে চেতনার প্রতিফলন তথা মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি।
যে প্রেরণা নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার প্রতি নব প্রজন্মের সেই ভালোবাসা নেই বলে মনে হচ্ছে। তারা বিদেশী ভাষা নিয়ে অত্যন্ত উল্লসিত। তাদের কথায় কথায় ইংরেজী শব্দের অনুপ্রবেশ অত্যন্ত পীড়াদায়ক দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালীর জন্য। ভারতীয় হিন্দী সিনেমা ও সিরিয়াল দেখে দেখে শিশুরা এখন হিন্দি কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক উচ্চবিত্তরা তাদের সন্তানদের ইংরেজী মাধ্যমে পড়ানোর প্রতি দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এটিকে অনেকে এক ধরনের আভিজাত্য বলে মনে করে থাকেন। বিদেশী ভাষার আধিপত্য কখনো কোন দেশের অনুকূল বলে বিবেচিত হতে পারে না। ইংরেজ শাসনামলের দুইশ বছরের ইতিহাস এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। ইংরেজী মাধ্যমে পড়তে গিয়ে এ শ্রেণির লোকেরা দেশের প্রতি অবজ্ঞা ও শ্রদ্ধাহীনতার মনোভাব তৈরি করছে। তারা নিজেদের সন্তানদের ইংরেজী মিডিয়ামে শিক্ষিত করতে পেরে গর্বে ফেটে পড়ছে। পক্ষান্তরে, যাদের সন্তানেরা বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করছে,তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখছে। ভিনদেশী ভাষার প্রতি তাদের এই লাগামহীন বিচরণ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সচেতন কোনো নাগরিকই তা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন হয় বাংলা মায়ের প্রতি অবমাননা, তেমনি ভাষার জন্য জীবনোৎসর্গকারী বাংলা মায়ের সন্তানদের প্রতিও হয় অবিচার। ভিনদেশী ভাষার প্রতি আমাদের অধিক আগ্রহ আর চর্চা দেখে লজ্জিত হয় প্রতিটি বিবেকবান মান্ষু। আবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। সরকারি বিভিন্ন পদ ও বিচারিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার প্রতি এ রকম উদাসীনতা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করার শামিল নয় কী? দেশের প্রতি ভালোবাসা যেমন ঈমানের অঙ্গ, ঠিক তেমনি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতাও ঈমানের অপরিহার্য বিষয়। তাই দেশের সকল ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীসহ সকল নাগরিকের উচিত, ব্যক্তি, জাতি ও দেশমাতৃকার জন্য, ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে সবাইকে এক ও অভিন্ন থাকা। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ভাষায় বলতে চাই
“কত ভাষা আছে সারা দুনিয়ায়
কত পরিভাষা তাতে
বাংলা ভাষার হয় কি তুলনা
সেসব ভাষার সাথে।
তথ্যসূত্র :
১.বিষয়ভিত্তিক সমকালীন বক্তৃতা
মাও মুহাম্মদ আবদুল্লাহ খান
২.নির্বাচিত গানের সংকলন
তাওহিদুল ইসলাম
৩.উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা
অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী ও অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ
৪.প্রভাত ভেরী ১৮ , ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
৫.দৈনিক কালের কন্ঠ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
৬.সময়ের আলো ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১