বৃহস্পতিবার ৩০ নবেম্বর ২০২৩
Online Edition

সংবাদপত্র জাতির কন্ঠস্বর

অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন

ইংরেজি Journal এবং lism এই দু’টো শব্দ সমন্বয়ে Journalism শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। জার্নালিজমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সাবাদিকতা। গণমাধ্যমে সংবাদ এবং মন্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করাই হচ্ছে সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি বিশাল কর্ম। এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ নিপুণভাবে সম্পাদন করে থাকেন সাংবাদিক। সংবাদপত্র, সংবাদ এবং সাংবাদিক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি থেকে অপরটি পৃথক করার কোন সুযোগ নাই। মানব জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহের বিচিত্র তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে যেসব প্রকাশনা রূপ লাভ করে সেগুলোকে সংবাদপত্র বলে অভিহিত করা হয়। মানুষের অজানাকে জানার আগ্রহ থেকে সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশ। মানব জীবনের সাথে সংবাদপত্রের এত বেশি সম্পর্ক যে, সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক মানব জীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। সংবাদপত্র মানুষের নিত্য সঙ্গী। জাতীয় ও বিশ্বের অগ্রগতির বাণী বহন করে নিয়ে আসে সংবাদপত্র।

প্রখ্যাত লেখক আবুল ফজল বলেছেন, “জাতীয় সংবাদপত্র, জাতীয় গণমাধ্যম জাতির বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। সে কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়া মানে জাতিকে বোকা বানিয়ে দেয়া। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখের প্রতিফলন ঘটে একমাত্র সংবাদপত্রেই। সংবাদপত্র সাধারণ মানুষের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকে। গণতন্ত্রের লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের চতুর্থ স্তম্ভ খ্যাত সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সংবাদপত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে আইভান তুর্গীনিভ বলেছেন, “একটি বইয়ের একশত পৃষ্ঠা পাঠ করে যে ধারণা লাভ করা যায় একটি মাত্র ছবিতে একবার চোখ বুলালে সেই ধারণা লাভ করা সম্ভব। সংবাদপত্রের নান্দনিক শিল্পী ও কারিগর হচ্ছেন-জাতীয় ও স্থানীয় সাংবাদিক। সাংবাদিকরা হচ্ছেন জাতির বিবেক। একজন সৎ সাংবাদিকের কোন বন্ধু নেই। সৎ, মেধাবী ও নির্ভীক সাংবাদিক জাতির পথ প্রদর্শক এবং মুকুটহীন সম্রাট।

সাংবাদিকের গুরুত্ব সম্পর্কে অস্কার ওয়াইল্ড এর বিখ্যাত উক্তিটি হচ্ছে-“আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী রাজ্য শাসন করেন, কিন্তু একজন সাংবাদিক তার সমস্ত জীবনব্যাপী রাজ্য শাসন করে থাকেন। উইকহ্যামস্টিডের মতে, “সাংবাদিকতা হচ্ছে সমাজ সেবার একটি আধুনিক রূপ। সাংবাদিকতা চলমান জীবনের শব্দময় প্রতিচ্ছবি। সাংবাদিকতা এই প্রতিচ্ছবিকে আপন হৃদয়ে ধারণ করে তাকে আবার জনসাধারণের কাছে ফিরিয়ে দেবার এক জটিল পদ্ধতি। সাংবাদিকতা পৃথিবীর বস্তুনিষ্ঠ দ্রুততম সাহিত্য। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সাংবাদিকগণ জনগণের আগ্রহ সৃষ্টিকারী ঘটনাবলী জনসাধারণের সামনে প্রতিনিয়ত উপস্থাপন করে থাকেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই একজন সাংবাদিক মানবতার সেবা করে থাকেন।

প্রতিদিন সকালবেলায় সংবাদপত্রটি হাতে না এলে পাঠকের দিনের শুভ সূচনা হয় না। একটা অপূর্ণতার তৃপ্তি মনে যেন অনুভূত হয়। দিনের শুরুতে একটি টাটকা সংবাদপত্র হাতে নিয়ে অনেক পাঠকই পড়তে বসেন, চায়ের টেবিলে। পাঠক চায়ের কাপে চুমুক দেন আর তরতাজা মুদ্রিত ভাঁজ করা সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো পড়ে ফেলেন একের পর এক। কোনটা পড়ে আবেগাপ্লুত হন, কোনটায় হন বিস্মিত। আবার কোন কোন সংবাদ, পাঠক হৃদয়ে বেদনার সুর বাজিয়ে দিয়ে যায়। কোনটা পড়ে পাঠকের হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, যে খবরটি মানুষের মনে নাড়া দেয় না, কোনরকম কৌতূহল, আবেগ, বিস্ময় অর্থাৎ কোনরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনা, সেটি আর যাই হোক সংবাদের মর্যাদা পেতে পারে না। খুঁটিনাটি অনেক কিছুই মানুষ জানতে চায়। অনেক সময় কোন কোন ঘটনা সম্পর্কে পাঠকের জানার অতিরিক্ত আগ্রহও থাকে। একজন নিবেদিত সংবাদকর্মী পাঠকের এসব বিচিত্র জানার চাহিদা পূরণ করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন-রাত খবরের পেছনের খবর, ঘটনার অন্তরালের ঘটনা খুঁজে বের করে আনার এবং তা প্রকাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। পাঠকের সামনে সত্য তুলে ধরতে গিয়ে অনেক সাংবাদিককে জীবন দিতে হয়। ভোগ করতে হয় জেল, জুলুম, নির্যাতন। প্রভাবশালীদের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক হামলার শিকার হতে হয়। তারপরও একজন সাংবাদিক ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই সত্য প্রকাশের যুদ্ধে জয়ী হন। জনগণের স্বার্থে সত্য প্রকাশে সাংবাদিক আপোষহীন, সংগ্রামী। জাতির দুঃসময়ে, ক্রান্তিকালে সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তাদের লেখনির মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার।

আমাদের দেশে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ধরনের সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে। যার মধ্যে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক সংবাদপত্র রয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন-লাইন সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন সাংবাদিকতা শহর ছাড়িয়ে জেলা, উপজেলা তথা মফস্বলেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। এই সীমাবদ্ধতা ও নানাবিধ সমস্যা সত্ত্বেও স্ব-উদ্যোগে গড়ে উঠা স্থানীয় সাংবাদিকতা এখন অনেক দূর এগিয়েছে। মফস্বলে সাংবাদিকতা করে অনেকেই এখন জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। মফস্বলে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের প্রায় সবাই এলাকায় অতি পরিচিত মুখ। তারপরও পেশা ও নেশার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্থানীয় প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক সাংবাদিকতার সাথে জড়িত সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশে আপোষহীন ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাদের অনেক সংবাদ রাজধানী থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হচ্ছে, এমনকি মফস্বলের সংবাদ লিড নিউজ পর্যন্ত হচ্ছে। সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করার মতো সংবাদ প্রকাশ করছেন মফস্বলের সাংবাদিকরা। স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি, প্রশাসন, প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসী বাহিনীর হুমকিকে কোন রকম পরোয়া না করেই মফস্বলের সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত হামলা-মামলা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এতকিছুর পরও মফস্বল সাংবাদিকতার গতি আজ অপ্রতিরোধ্য। আঞ্চলিক, জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে প্রকাশিত অনেক দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে তার এলাকায় শক্তিশালী ভীত রচনা করেছেন।

জাতীয় সংবাদপত্র যদি জাতির কন্ঠস্বর হয়, তাহলে মফস্বলের সংবাদপত্র মফস্বলের কন্ঠস্বর, জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক যদি জাতির মুকুটহীন স¤্রাট হয়, তাহলে সাহসী সাংবাদিকতার কারণে মফস্বলের সাংবাদিকরাও মফস্বল এলাকার মুকটহীন স¤্রাট। একটি পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার যেসব যোগ্যতা নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে থাকেন, আজকাল মফস্বল সাংবাদিকদের অনেকেই একই ধরনের যোগ্যতা নিয়ে ওই পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে মফস্বলে কাজ করে যাচ্ছেন যথেষ্ট যশ, খ্যাতি ও সুনামের সাথে। সাংবাদিক হওয়ার জন্য প্রয়োজন লেখার সামর্থ্য, প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত শিক্ষা, কঠোর পরিশ্রম, সৎসাহস, সত্যানুসন্ধানী মনোভাব, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, কাজের ক্ষীপ্রতা, উদ্যোগী ও স্বাবলম্বী, খবর খোঁজার রোমাঞ্চ, সাংগঠনিক শক্তি, রাজনৈতিক ও পেশাগত জ্ঞান, বিশ্লেষণী মন, বন্ধু ভাবাপন্ন মনোভাব ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। একজন যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিকের এসব গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য মফস্বলের সাংবাদিকদের অনেকের মধ্যেই বিদ্যমান আছে বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা।

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতা আজ খুবই শক্তিশালী। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপকর্ম গোপন করে পার পেয়ে যাওয়ার দিন ক্রমেই যেন ছোট হয়ে আসছে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সাংবাদিক সমাজ কান্ডারীর ভূমিকা পালন করায় জনগণের ভালবাসা ও মন জয় করতে সক্ষম হচ্ছেন। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, সু-শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। 

সংবাদপত্রের বদৌলতেই জনগণ তাদের প্রত্যাশিত নাগরিক অধিকার ফিরে পাচ্ছেন। সন্ত্রাস, ঘুষ, দুর্নীতি, অপরাধের বিরুদ্ধে পত্রিকার সাংবাদিক যেন এক প্রচন্ড দ্রোহের নাম। হিটলার, মুসোলিনী, ফ্রাঙ্কো, আইয়ুব, ইয়াহিয়ার মতো পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসকই সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে কন্ঠ রোধ করার চেষ্টা করেছেন। যে কোন দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিবাদী শাসকই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হনন করার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। শাসকেরা যখনই জনগণের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের উপর জুলুমের ষ্টীম রোলার চালিয়েছে সাংবাদিকরাই তখন এ জুলুমের বিরুদ্ধে কলম নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে বার বার।

একজন সৎ সাংবাদিক কখনো স্বৈরাচারের কাছে মাথা নত করে না। অতীতেও কেউ করেনি। একজন প্রকৃত সাংবাদিক কখনো অসত্যের কাছে পরাজিত হয় না। স্বৈরাচারের বন্দুকের নলের সামনে বসেই সাংবাদিক ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন সত্যকে। দেশ ও জাতির স্বার্থে একজন সাংবাদিক জেল খাটতে এমনকি নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। সত্য প্রকাশই সাংবাদিকের ধর্ম, তার পেশা-নেশা ও সাধনা। আর একারণেই সংবাদপত্র জাতির কন্ঠস্বর, সাংবাদিক জাতির মুকুটহীন সম্রাট। যে কোন মূল্যে সাংবাদিকদের এ পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ