বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

একমাস পরও সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছেনি পাঠ্যপুস্তক

সামছুল আরেফীন : নতুন বছরের একমাস পেরিয়েছে তিনদিন আগেই। কিন্তু এখনও সকল শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছেনি সবগুলো পাঠ্যবই। এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় তিনটি শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হয়েছে। বইয়ের মানও অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দিকে বই পেতে দেরি হলে ওয়েবসাইট থেকে পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। 

গত শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি এনসিটিবি। ফেব্রুয়ারি-মার্চেও কোনো কোনো মুদ্রণকারী বই দিয়েছিল। বইয়ের কাগজের মান নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল। এবারের পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল আগেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংকট কমাতে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনে বই উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো হলে শিক্ষার্থীদের যেমন আনন্দের সীমা থাকে না, তেমনি পড়াশোনায়ও আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু গত বছরে যে সংকট দেখা গিয়েছিল এবারো সে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, ছাপাখানার পাওনা পরিশোধ না করা, কাগজের কাঁচামাল সংকট, প্রেস মালিকদের অসহযোগিতা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল সংকট, কাগজসহ বই ছাপানোর অপরিহার্য উপাদানের দাম বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি লোডশেডিং- এর কারণে এবারো সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

প্রতিবছর ১ জানুয়ারি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হতো। তবে করোনার সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর উৎসব করে বই দেওয়া হয়নি। এ বছর উৎসব করে বই বিতরণ করা হলেও এখনও সব বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে বই দিচ্ছে। 

এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই। ভালো মানের ম-ের সংকটসহ কিছু কারণে এবার সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বছরের শুরুতে স্কুলে স্কুলে উৎসব করা হলেও এখনো সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি। আবার বইয়ের মানও অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৫০ লাখ ২৩ হাজারের বেশি বই ছাপা বা ছাপার পর উপজেলা পর্যায়ে পাঠাতে ছাড়পত্র হয়নি। তবে প্রাথমিকের সব বইয়ের ছাড়পত্র হয়েছে। তারা জানতে পেরেছেন, অনেক উপজেলায় বই গেলেও বিতরণ পর্যায়ে এসে অনেক বিদ্যালয়ে বই যায়নি। এমনকি ঢাকাতেও এমন ঘটনা আছে। তবে অতি শিগগির এই সমস্যাও দূর হয়ে যাবে।

এবার প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেক জায়গায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে সপ্তম শ্রেণিতে এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। যেহেতু এই শ্রেণিগুলোর বইগুলো একেবারে নতুন, তাই সব নতুন বই হাতে না পাওয়ায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অসুবিধা হচ্ছে। পুরোনো শিক্ষাক্রমের সব বইও অনেক জায়গায় সব শিক্ষার্থীর হাতে যায়নি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ইন্সপেকশন এজেন্ট প্রত্যেকটা প্রেস থেকে বই ছাড় দেয়। এটাকে পোস্ট ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) বলে। পিডিআই করার পর বইগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে যায়। পিডিআই যখন করা হয়, তখন ধরে নেওয়া হয় বইগুলো ট্রাকে উঠে গেছে। তবে ইন্সপকেশন থেকে মাধ্যমিকের ৫০ লাখের বেশি বই পর্যন্ত ছাড় হয়নি। 

এনসিটিবিতে মুদ্রণ কাজের তদারককারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে নিয়মিতভাবে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি অংশ পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবৈধভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের সহযোগিতায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে রি-সাইকেল্ড কাগজ ক্রয় করে অত্যন্ত নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে। আর নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হলে একদিকে ছাপার মান খারাপ হয়, অন্যদিকে বইও তেমন টেকসই হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ে ছাপানো ছবি থেকে কালি উঠে যায়, ছবি বোঝা যায় না।

বই মুদ্রণ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কয়েক বছর আগে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। তারা তখন বলেছিল, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তকের পা-ুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। তাদের প্রতিবেদনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পা-ুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়।  

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবই না পাওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, যেসব শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া বাকি ছিল, তাদের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেওয়ার কথা ছিল। কাজেই কোথাও যদি বই পৌঁছতে দেরি হয়ে থাকে অবশ্যই আমি তা দেখবো। তবে আমি সবাইকে বলবো, আমাদের কিন্তু ওয়েবসাইটে প্রত্যেকটি বই দেওয়া আছে। যদি কোথাও কোনও ব্যত্যয় ঘটেও তাহলে যেন সেই ওয়েবসাইট থেকে বিশেষ করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারেন, কোনও অসুবিধা নেই। গতকাল শুক্রবার সকালে চাঁদপুর সার্কিট হাউজে এলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ