হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

কবির আহমদ সিলেট থেকে: চা-পাতা, কমলালেবু ও ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির কারণে সিলেটের সুনাম সুখ্যাতি ছিলো দেশে বিদেশে। চা পর্যাপ্ত উৎপন্ন হলেও শীতলপাটি হারিয়ে যাচ্ছে সিলেট থেকে। নতুন প্রজন্মের লোকজন এখন আর শীতলপাটির সাথে পরিচিত নন। কমলা ছাতক ও বিয়ানীবাজারে সৌখিন চাষিরা কিছুটা চাষ করলেও তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এক সময়ে সিলেটের শীতলপাটি যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করত শীতলপাটি বুননশিল্পীরা। তাদের এখন দুর্দিন যাচ্ছে। শীতলপাটির একমাত্র উপকরণ মুর্তা বেতের চাষ প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। অথচ একসময় সিলেট বিভাগে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি শীতলপাটি ছাড়া। সৌখিনতার প্রতীক ছাড়াও নকশি কারু খচিত শীতলপাটি উন্নত রুচি ও আভিজাত্যের একটি পণ্য।
বেতের সংকট এবং পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের প্রায়ই অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপড়েনের মধ্যে চলছে জীবন। তবুও জীবিকার তাড়নায় কোনোমতে আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পুরনো এই পেশা।
শীতলপাটির কদর সিলেট বিভাগ ছাড়াও দেশ-বিদেশে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে শীতলপাটি বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। এতে সরকার পাবে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ও রাজস্ব। পাশাপাশি বেকারদের হবে কর্মসংস্থান। শীতলপাটির উপকরণের অপ্রতুলতায় অধিকমূল্যে মুর্তা ক্রয় করতে একটি শীতলপাটি বুনতে যে পরিমাণ খরচ হয় সে অনুপাতে মূল্য পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ শীতলপাটি শিল্পীদের।
সরেজমিনে মৌলভীবাজারের বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওড়-সংলগ্ন নিভৃত পল্লী পশ্চিম গগড়া গ্রামে বীরেশ দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় বসে শীতলপাটি তৈরি করছেন রনজিত রায়। তার নিপুণ হাতে পাটিতে উঠছিল বাহারি রঙের নকশা। পাটিতে বাহারি নকশা তুললেও রনজিত দাসের মনে কোনো আনন্দ নেই। রাত-দিন পরিশ্রম করে আর্থিক স্বচ্ছলতা না আসায় মনে কোনো আনন্দ নেই। ভীষণ অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপোড়েনের মধ্যে চলছে তার সংসার। অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। তাই জীবিকার তাড়নায় কোনোমতে আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পেশা।
শীতলপাটি বুননশিল্পী রনজিত রায় ও সুখিলা রায় জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে শীতলপাটি তৈরি করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো লাভ নেই, বেতও পাওয়া যায় না। বেতের দাম দিয়ে পাটি তৈরি করে সংসার চালানো যায় না। অন্য কোনো কাজ জানি না তাই এই কাজ করি। যারা কাজ পারেন, লেখাপড়া শিখেছেন তারা চাকরি করছেন। বিদেশে গেছেন। তাদের স্বচ্ছলতা এসেছে।
বেতের শীতলপাটি তৈরি কেবল রনজিত রায়ের পারিবারিক পেশাই নয়, বাংলার ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের অংশও এটা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এই শীতল পাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। তবে এ ঘোষণা দেওয়ার পরে ভাগ্য ফিরেনি শীতলপাটির শিল্পীদের। কাঁচামাল সংকট ও নায্যমূল্য না পাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা। যুগ যুগ ধরে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও নায্যমূল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেকে এই পেশা ছেড়েছেন। তবে ঐতিহ্য হিসেবে বীরেশের মতো হাতেগোনা কিছু পরিবারে এখনও টিকে আছে পাটি শিল্পে। টানাপোড়নই যাদের জীবন সঙ্গী।
উন্নত ও সুক্ষ শীতলপাটির মূল্য দেড় হাজার থেকে ২৫ হাজার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলে শীতলপাটির এক ব্যবসায়ী জানান। এসব শীতলপাটি যতœসহকারে ব্যবহার করলে ২৫ থেকে ৩০ বছরেও নষ্ট হয় না। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মাপ ও নামের শীতলপাটি বুনা হয়। যেমন নয়নতারা, আসমানতারা, জোড়াকেচিরা, সিকি, আধুলি, টাকা ইত্যাদি।
এসব নাম ছাড়াও বিভিন্ন আকৃতি ও বৈচিত্র্য ভরপুর শীতলপাটি শহর ও গ্রামের বাজারে পাওয়া যায়। অতীতে মসজিদ ও বিয়ে বাড়িতে শীতলপাটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু যুগের বিবর্তনে এখন আর শীতলপাটি ব্যবহার না করে কার্পেট ও ডেকোরেটার্সের আসবাবপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে বাড়তি আরাম আয়েশের জন্য শীতলপাটি এখনও অভিজাত পরিবারগুলোতে দেখা যায়।
শীতলপাটি হস্তশিল্পকে কিছুটা টিকিয়ে রেখেছে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের বনাঞ্চল। প্রাকৃতিকভাবে বনবিভাগের জমিতে মুর্তা চাষ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। গাছ ও বাঁশ মহালের মত মুর্তার মহাল থেকে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের শীতলপাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মুর্তা ক্রয় করেন। অনেকে নিজেদের ক্ষুদ্র পরিসরে মুর্তা চাষ করলেও চাহিদার তুলনায় নগণ্য। ফলে মহাল থেকে মুর্তা ক্রয় করতে হয়। বর্তমানে সিলেটের ছাতক বনরেঞ্জের অধীনে ২০০ একর পতিত জমিতে মুর্তা বনায়ন করেছে বন বিভাগ। বন বিভাগের এ উদ্যোগ শীতলপাটি হস্তশিল্পের জন্য সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। সিলেট ছাড়াও মৌলভীবাজারের রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া উপজেলায় শীতলপাটি হস্তশিল্প রয়েছে। বিশেষ করে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের দাসগোত্র। বর্তমানে এ পেশায় মুসলমানদের কুটির শিল্পে দক্ষ ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছে।