আবারও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি
কয়েক মাস পরপর এবং যখন-তখন দাম বাড়ানোর পরিবর্তে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবসম্মত ও সম্ভাবনাময় পথে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও সরকার আগের মতোই নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে এগোতে চাচ্ছে। বিগত কয়েকদিনের খবরে জানানো হয়েছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর মতো বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চলেছে। এ ব্যাপারে যথারীতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনÑ বিইআরসিকে সামনে রেখেছে সরকার। উল্লেখ্য, বিদ্যুতের দাম শেষবার বাড়ানো হয়েছিল গত বছরের ২১ নবেম্বর। সেবার পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ানো হলেও ভোক্তা বা গ্রাহক পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়টি কার্যকর করা হয় ১২ জানুয়ারি থেকে। সরকারের পক্ষ থেকে একই সঙ্গে জানিয়ে রাখা হয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে নতুন করে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হতে পারে, যদিও গ্রাহকদের জন্য বাড়বে পাঁচ শতাংশ হারে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাইকারি পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১০ বার এবং গ্রাহক পর্যায়ে ১১ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি তথা সরকার।
প্রতিক্রিয়া ঘটবার আশংকার কারণে বিইআরসি অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিলম্বের এবং সত্য এড়ানোর কৌশলও নিয়েছে। তাছাড়া এ তথ্যটিও বিইআরসি জানিয়ে রেখেছিল যে, সরকারি ও বেসরকারি সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনে ৮ টাকা ২৮ পয়সা দরে। এজন্য পিডিবিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর কারণ জানাতে গিয়ে অতীতের মতো সেবারও প্রথমে ভর্তুকি কমানোর যুক্তিই দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বলা হয়েছে, প্রতি ইউনিটের মূল্য বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করার পরও সরকারের কাছ থেকে পিডিবিকে ভর্তুকি হিসেবে ১৭ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। নাহলে সংস্থাটিকে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হলো, পিডিবিকে সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। কারণ, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা বিইআরসি এবং বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ ও তাগিদ দিয়েছেÑ যার অর্থ, সরকারের পক্ষ থেকে যা কিছুই বলা হোক না কেন, বিদ্যুতের মূল্য না বাড়ালেও চলতো। একই ধরনের তথ্য ও প্রতিক্রিয়া জানা যাচ্ছে বর্তমান পর্যায়েও।
এরই পাশাপাশি জনগণের সচেতন অংশ বিইআরসির উদ্যোগে আয়োজিত গণশুনানির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রতিটি গণশুনানিতেই তথ্য-পরিসংখ্যানসহ এই মর্মে প্রমাণ হাজির করা হয়েছে যে, কথিত লোকসান কমানোর জন্য মূল্যবৃদ্ধি করার কোনো যুক্তি নেই। দরকার বরং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সিস্টেম লস ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের অবসান ঘটানো। রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল ধরনের বিদ্যুতের জন্য হাজার কোটি টাকার অংকে ভর্তুকি দেয়ারও অবসান ঘটানো দরকার। কারণ, এসব কর্মকান্ডের কারণেই বিইআরসির লোকসানের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এই লোকসানের দায় কোনোক্রমেই গ্রাহকদের ওপর চাপানোর যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার প্রায় নিয়মিতভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। প্রতিটি উপলক্ষেই এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন এটাই শেষবার, আর কখনো দাম বাড়ানো হবে না!
এ ধরনের বিভিন্ন কারণে আমরা প্রতি ইউনিটের জন্য প্রায় ২০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করি। এর কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে সুযোগ পেলেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড করার দাবি জানানো হয়। সরকার একই সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ থাকে। অন্যদিকে সংযোগ না পাওয়ার এবং বিশেষ করে সীমাছাড়ানো লোডশেডিং-এর মতো তথ্যগুলো কিন্তু প্রমাণ করে না যে, সরকারের দাবি সত্য ও সঠিক। এজন্যই গ্রাহকদের আড়াই-তিন হাজার, এমনকি চার-সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্তও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সংকট থেকে রেহাই মেলেনি, বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়ার জন্যও মানুষকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। অনেক শিল্প-কারখানা শুধু বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ার কারণে চালু করা যাচ্ছে না।
আমরা মনে করি, বিদ্যুতের সঙ্গে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন থেকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া পর্যন্ত সকল বিষয় জড়িত বলেই সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি বাতিল করা। নাহলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তিই শুধু বাড়বে না, শিল্পায়নের সঙ্গে সামগ্রিক জাতীয় সমৃদ্ধি যেমন বাধাগ্রস্ত হবে, তেমনি সৃষ্টি হবে না নতুন চাকরির সুযোগও। আমরা তাই দাম বাড়ানোর পরিবর্তে বিদ্যুতের ব্যাপারে বাস্তবসম্মত অগ্রসর হওয়ার দাবি জানাই।