বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

স্বাধীনতা ও আমাদের প্রত্যাশা 

এ কে আজাদ

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস ধরে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার গ্লানি মুছে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় আমাদের এই শস্য শ্যামল মাতৃভূমি। আশা ছিল মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ডানা মেলে আকাশে উড়ব। কারও চোখ রাঙানী আমাদেরকে অবদমিত করতে পারবে না। শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হব না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমরা পাবো ভোট দেয়ার অধিকার। গণতন্ত্রের ভেলায় ভেসে মাঝির ভাটিয়ালী গানের মতো আমরা পাব মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পাবো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। পাখির গানের মতো আমরা পাবো বাকস্বাধীনতা। ঝরনার পানির মতো থাকবে আমাদের প্রাণের উচ্ছ্বলতা। আমরা পাবো স্বাধীন ভৌগলিক অবস্থানের সাথে সাথে আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি, আর আমাদের থাকবে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে দাঁড়াবে নৈতিকতাপূর্ণ এক শক্ত মজবুত ভিত্তির উপরে। আমরা পাবো নিপীড়নহীন এক শান্তিময় সমাজ। 

এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের স্বাধীনতার ৫১ বছর পরে আমরা যদি পর্যালোচনায় বসি তাহলে কী দেখতে পাই? আমরা কি মুক্তি পেয়েছি অর্থনৈতিক শোষণ থেকে? প্রতিষ্ঠিতি হয়েছে অর্থনৈতিক সাম্য? মুক্তি পেয়েছি কি সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে? আমরা কি ফিরে পেয়েছি আমাদের বাকস্বাধীনতা? স্বাধীন এই বাংলাদেশে রক্ষিত হচ্ছে কি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার? সুসংহত হয়েছে কি আমাদের কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র? আজ এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের একটি পর্যালোচনা হওয়া দরকার।  

যে গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, সেই গণতন্ত্রের অবস্থা আজও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে কি না তাও এখন পর্যালোচনায় আনা দরকার। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন দলগুলো পরমত সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা দেখানোর মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং তার পরিবেশ আমরা নিশ্চিতি করতে পেরেছি কি না সেটাও বিবেচনায় আনা আবশ্যক বটে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামতকে আমরা কতটুকু গুরুত্বে নিতে পেরেছি? গুটিকতক লোকের মতামত দেশবাসী মানুষের ঘাড়ে চাপাচ্ছি কি না- সেটাও বিশ্লেষণে যুক্ত করতে হবে। বহুমত আর বহুপথের যাত্রা আজ কতটা উন্মুক্ত। দলবাজী, আত্মীয়করণ, এলাকাকরণ, আর সীমাহীন দলীয়করণে আজ মানুষের নাভিশ্বাস যাতে না উঠে সে দিকটা নিশ্চিত করতে না পারলে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় তার লেশমাত্র থাকবে না। একটা নষ্ট সময়ের ঘূর্ণী আবর্তে চলে যাবে দেশ।  অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতে গেলে সত্যিকার অর্থে যা বুঝায় সেটি আমরা করতে পারিনি এখনও। মালেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরকে আমরা যদি বিবেচনায় নেই, দেখতে পাবো- গত বিশ বছরে তারা কোথা থেকে কোথায় গেছে, আর আমরা কোথায় আছি। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি যাতে সীমাহীন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে না পারে,  সেদিকে বিশেষ নজরদারী থাকা ছাড়া অগ্রগতি মুখ থুবরে পড়বে বারবার। দেশ যাতে চোর বাটপারের খনিতে পরিণত না হয়, সেদিকে চাই কঠিন নজরদারী। 

গার্মেন্টস সেক্টরে একের পর এক অস্থিরতা, বিদেশী কুটকৌশলে শ্রমিক অসন্তোষ, অগ্নিকান্ড ইত্যাদি যাতে আমাদের সোনার ডিমপাড়া হাঁস এই গার্মেন্টস সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। একের পর এক আন্তর্জাতিক মার্কেট হাতছাড়া হয়ে গেলে আমাদের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভে বড় ধরনের আঘাত লেগে যাবে। আমার দেশের পিঁয়াজ রসুন চাল ডাল গম মসলা সব কিছুই এখনো বহুলাংশে বিদেশের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও চক্রান্তকারী বিদেশীদের প্রভাব নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে আমাদের পুরো অর্থনীতিকে। আমাদের অর্থনীতিকে আমরা কি করতে পেরেছি পুরোপুরি স্বাধীন? তবে আশার কথা- আমরা এখন উন্নয়নের সড়কে চলতে শুরু করেছি। কিন্তু গতি বাড়াতে না পারলে ছিটকে যাবার আশংকাকেও মাথায় রাখতে হবে সব সময়।  

আর সংস্কৃতির কথা যদি বলি তাহলে বাজ পড়ে যে কোন বিবেকবান মানুষের মাথায়। আকাশ-সংস্কৃতির আড়ালে বিদেশী সংস্কৃতির সয়লাব হয়ে গেছে পুরো বাংলাময়। বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর দেউলিয়াপনা এবং অন্তসারশূন্য ও সংকীর্ণ একপেশে মনোভাবাপূর্ণ অনুষ্ঠানমালার অযাচিত উপস্থাপনার কারণে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে রুচিবান সচেতন মানুষেরা যাতে মুখ ফিরে না নেয় সেটা বিবেচনা করার সময় এখনই। অপরপক্ষে, প্রতিবেশী দেশে আমাদের কোন চ্যানেল প্রদর্শনের অনুমতি না থাকলেও বিনোদনপ্রিয় বাংলাদেশী মহিলারা ভারতীয় বিভিন্ন হিন্দি বাংলা সিরিয়ালের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছেন পুরোদস্তুর মত। এমনকি ভারতীয় সিরিয়াল দেখা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনমালিন্যের জের ধরে ঘর সংসার ভাঙার উপক্রমও নাকি হয়েছে আমাদের এই সমাজে। সন্ধ্যা হলেই স্ত্রীর হাতে টিভি রিমোটের রাজত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেক সংসারের কর্ণধার। আর শহুরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই হিন্দি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে শিশুদের বিনোদন মূলক নানা অনুষ্ঠানের কারণে। এমন কি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এবং বাঙালীদের নিজস্ব অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতাও পালিত হয় মোড়ে মোড়ে হিন্দি গান আর যুবক যুবতীদের নাচের তালে তালে। তাহলে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার হাল কি- সে প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে এখনই?  

এমতাবস্থায়, আমাদের আজকে শপথ নিতে হবে যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যাতে বিপন্ন হয়ে না পড়ে, বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে যেন আমাদের স্বাধীনতা। সকল হঠকারিতা, দলীয় সংকীর্ণতা, একপেশে মনোভাব আর ক্ষমতার লোভের কারণে আমাদের রক্তে-কেনা স্বাধীনতা যেন প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে কেউ- সে শপথও নিতে হবে আমাদেরই।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ