শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

জ্ঞান ও অজ্ঞতা

আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন 

জ্ঞান অর্থ আলো। আত্মশক্তি অর্জনই জ্ঞান, সম্পদের ক্ষয় আছে কিন্তু জ্ঞান চিরন্তন চিরসাথী। জ্ঞান আলোর মতো, অন্ধকারকে দূরীভূত করে আলোকিত করে। 

আল্লামা আদামাল আসমায়া কুল্লাহা” আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) কে সকল বস্তুর নাম শিখিয়ে দিলেন। সমাজের কুসংস্কারের ফলে প্রশ্ন জাগে, মানব জীবনের সুখের জন্য কোনটি অনুকূল- জ্ঞান না অজ্ঞতা? জ্ঞান আর অজ্ঞতার পার্থক্য বুঝতে পারলে হয়তো এ কথা বলা যেতে পারে। জ্ঞান গভীর জলের মাছের মতো ভেতরে থাকে। ফেনার মতো সব সময় ভেসে থাকে না, উপরে ধরাও দেয় না, আর অজ্ঞতা ভেসে থাকে এবং সবার সামনে নিজেকে বেশি জাহির করে। 

অজ্ঞতা, মূর্খতা, বর্বরতা, অশিষ্টতা, অসভ্যতা, বন্যতা, বর্বর জীবন, বন্য জীবন, বর্বর অবস্থা, শিক্ষাদীক্ষার বা সংস্কৃতির অভাব, কথায় বা লেখায় অশালীন কথার মিশ্রণ। যে ব্যক্তি স্বয়ং অজ্ঞ অথচ নিজেকে মনে করে সে পণ্ডিত, সে অজ্ঞতা মিশ্রিত অবস্থায়ই চিরকাল থেকে যাবে। এ চিকিৎসাহীন অবস্থা থেকে বাঁচার বা বের হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন-আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মতো! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না। (সুরা বাক্বারা: আয়াত ১৩) একজন জ্ঞানী তার কথায় কাজে প্রমাণ করেন তিনি ভালো বুঝেন ভালো বুঝাতে পারেন, কিন্তু অজ্ঞ নিজেই জানেনা তার বেশি প্রকাশই যে অজ্ঞতা। জ্ঞান সত্য উদঘাটনে ও অনুসন্ধানে মরিয়া থাকে। আর অজ্ঞতা মিথ্যাকে দিয়ে সত্য ঢেকে রাখতে চায়। আরেক দিকে জ্ঞান মানেই অবনত মস্তক। ঐতিহাসিক দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, প্রমাণিত, সত্য এবং বিশ্বাস এ তিনটির সমন্বয়কে জ্ঞান বলা হয়। 

জ্ঞানী কি প্রাতিষ্ঠানিক সনদধারী?  না সনদবিহীনদেরও জ্ঞানী বলা হবে? তা হলে জানতে হবে পৃথিবীতে বিগত হাজার হাজার বছর ধরে যারা অবদান রেখে আসছেন যাদেরকে লক্ষ কোটি মানুষ অনুসরণ করে আসছে তারাতো সবাই প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানী নয়? তাহলে আমরা কিভাবে জ্ঞানের সংজ্ঞা নির্মাণ করবো? তা হবে ভিন্নভাবে। যারা নিজেরা ছিলেন আলোকিত মানুষ, যাদের দ্বারা অপরজন উপকৃত হয়েছে, যারা অন্যের উপকারে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, যাদের পরামর্শ মেনে অপর জন আলোকিত হয়েছেন তারাই জ্ঞানী। একটি গোপন কথা হলো- কোনো জ্ঞানীই নিজেকে জ্ঞানী বলেননি। এটাও এক ধরনের জ্ঞানের স্বীকৃতি।

আপনি যদি আরবীতে জ্ঞানের বিশ্লেষণ করেন তাহলে আসে “ইলম” শব্দটি। ইলম মানে জ্ঞান। কোরআন পাকে ইকরা শব্দ দিয়ে যেমন ইলম অর্জনের গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি হাদীস শরীফেও আমাদের মহানবী (সা:) বাণী দিয়েছেন, তলাবুল ইলমে ফারিদাতুন আলা কুল্লে মুসলেমিন অমুসলিমাতুন”  প্রত্যেক নর নারীর জন্য ইলম অর্জন আবশ্যক। 

ইলম ওয়ালা ব্যক্তি নিজেকে জাহির করে না, নীরবে থাকতে পছন্দ করেন। এবং কোনো বিষয়ে না জেনে কখনো বলেন না, তর্কে জড়ান না। মহানবী (সা:) কে যখন কোনো প্রশ্ন করা হতো তিনি বলতেন, আমি জেনে বলবো, সাহাবাগণকে কোনো প্রশ্ন করলে তারা বলতেন জানি না। জ্ঞান বড়াই করার বিষয় নয়। আল্লাহ মানুষকে নতুন নতুন আবিষ্কার, পৃথিবীর সব কাজ পরিচালনা করা, দ্রব্য সামগ্রীকে সাজিয়ে গুছিয়ে কাজে লাগানো, এমনকি পৃথিবীর আশ্চর্য জনক উদ্ভাবন ও বিশ্লেষণ করার শক্তি দেয়ার পরও বলেছেন, আমি তোমাদেরকে যে জ্ঞান দান করেছি তা অতি সামান্য মাত্র। 

জ্ঞান বলতে কোন বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থাকাকে বুঝায়। এটা বহিঃপ্রকাশ ধরনের হতে পারে (যেমন ব্যবহারিক গুনাবালী সম্পন্ন বা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন) অথবা বহিঃপ্রকাশ ধরনের নাও হতে পারে (যেমন কোনো বিষয়ে শুধু তাত্ত্বিক দিকটি বোঝা); এটা কম বা বেশি ফর্মাল বা নিয়মার্বতিতা সম্পন্ন হতে পারে। [১] দর্শনশাস্ত্রের, জ্ঞান নিয়ে যে অংশটি আলোচনা করে তাকে জ্ঞানতত্ত্ব বলে। দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠানিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন “প্রমাণিত সত্য বিশ্বাস” বলে, যদিওবা প্রচুর সংজ্ঞা রয়েছে জ্ঞানের উপর এবং প্রচুর তত্ত্ব রয়েছে এটির অস্তিত্ব নিয়ে।

কবি জন মিল্টন বলেছেন আমি নিজেই জানি না কোনটা আমার জন্য প্রযোজ্য। আর কোনটি অপরের জন্য প্রযোজ্য। অথচ তিনি প্যারাডাইজ লস্ট লিখে অবাক করে দিয়েছেন।

জীবন কখনো সরল রেখায় চলে না। জীবনের পদে পদে বক্র রেখাও আছে। জীবনের সময় সমান তালে যায় না, দুঃখ কষ্টে জড়িত সময় বয়ে চলে। যারা জ্ঞানী তাদের কাছে দুঃসময় আসলেও তারা জ্ঞান দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে সময়টি অতিক্রম করেন। অজ্ঞরা মাঝপথে ঝরে পড়ে বা বিপদ থেকে উঠতে কষ্ট হয়। কারণ তারা সঠিক পথ চিনে না।

যে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ স্রষ্টাকে চিনতে পারে না। যে জ্ঞান স্রষ্টার বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করে, পাপিষ্ট শয়তানের প্ররোচনায় জীবনকে গোনাহের কাজে নিমজ্জিত করে, নফসের পূজারী হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানকে অগ্রাহ্য করে জীবনের সুখকে উৎকৃষ্ট অর্জন মনে করে। স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি ফরজ বিধানাবলী ছেড়ে দিয়ে থাকে। সে জ্ঞানী হতে পারে না, সে অজ্ঞ। আমাদের শিক্ষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন কোনো লোক যত জ্ঞান ই অর্জন করুন যদি কোরআনের জ্ঞান অর্জন না করে তাহলে সে জ্ঞানী নয়।

মানুষের জীবনে আর্থিক সাফল্যের সঙ্গে জ্ঞান ও অজ্ঞতার সম্পর্কটি গভীর নয়। একজন অজ্ঞ মানুষও আর্থিকভাবে সফল জীবন কাটাতে পারেন, বিপরীতে একজন জ্ঞানী কাটাতে পারেন দারিদ্র্যে জর্জরিত জীবন। তবে মর্যাদার প্রশ্নে জ্ঞান আবশ্যক। যে গৃহস্থের অভাবজনিত সমস্যা নেই, জীবন উপভোগের উপকরণ তার সামনে কম নয়।

আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। জন্মগতভাবে অন্যান্য প্রাণীদের মতোই প্রাণী। তবে অন্যান্য প্রাণী ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো, জ্ঞান থাকা বা না থাকা। কথা বলতে পারা না পারা। আমাদের খেয়ে দেয়ে শুধু জীবনযাপন করলেই হয় না, অর্জন করতে হয় জ্ঞান, হতে হয় জ্ঞানী, পরিচালনা করতে জগতকে। 

অন্যের উপর নির্ভর করে চলা মূর্খতার মাধ্যম। নিজে উপার্জন করে নিজে কষ্ট করে নিজের বুদ্ধি দিয়ে অর্জন করা জ্ঞানীর কাজ। কোনো লোক অন্যের সম্পদকে নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করাকে জ্ঞানী বলে না। বাবার সম্পদ পরিচালনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে তবে নিজে অর্জন করে পরিচালনা করলে তাতে জ্ঞানীর পরিচয় পাওয়া যায়। বাবার সম্পদ পরিচালনা করতে গিয়ে সম্পদের অপচয় করলে তাও অজ্ঞতা। জ্ঞানের অভাব আর অজ্ঞতার ফলে পৃথিবী আজ বিশৃঙ্খলায় ভরে গেছে। সম্মানহানি হচ্ছে সম্মানিত লোকের। অপাত্রে জ্ঞান পরিবেশন করা হচ্ছে। জ্ঞান আহরণের লোক নেই। হযরত লোকমান আঃ এর জ্ঞানের কথা কোরআনেও উল্লেখ রয়েছে। সেই জ্ঞান কেউ উদঘাটন ও পরিবেশন করে না।

আমাদের আরেকটি সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো, আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের ধর্ম ইসলামে প্রতিটি মানুষকে বলা হয়েছে জ্ঞান অর্জন করার কথা, জানানো হয়েছে এর অশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত।

মানব জাতিকে জ্ঞান অর্জন করতে ও সঠিক পথ বোঝাতে আল্লাহ তায়ালা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাজিল করেন হিকমতময় জীবন বিধান আল কোরআন। আল্লাহতায়ালা সুরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত নাজিল করার মধ্য দিয়ে, ওহি বা কোরআন নাজিলের সূচনা করেন। ওই ৫ আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াতে-ই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইকরা বিসমি রব্বিকাললাজি খালাক, খলাকাল ইনসানা মিন আলাক।’ অর্থাৎ পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।

জ্ঞান অর্জনের প্রথম স্তর হলো পড়া আর পড়া। না পড়ে কেউ কখনো জ্ঞানী হয়নি।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ