বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

ইসলামী শিল্পকলা ও বঙ্গীয় সংস্কৃতি

 

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক 

দাঁড়াও হে বন্ধু একটুখানি, কাঁদি ক্ষণিকের তরে হারানো প্রিয়াকে স্মরে

হাওমাল আর দাখুলের এই ঢেউখেলা বালু আজও তার স্মৃতি বহন করে।

প্রাক-ইসলামী যুগের বিখ্যাত আরবী কবি ইমরাউল কায়েস এভাবেই মরুভূমিতে তাঁর বেদুঈন প্রেমিকার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে কাতর বিলাপ করেছেন। সেই কবে মরু উপত্যকায় সফর করার সময় প্রিয়া ঢেউখেলানো বালুরাশিতে তাঁবু ফেলেছিল। আজ তার স্মৃতি বলতে আছে শুধু তার অস্থায়ী উনুনের পাশে পড়ে থাকা আগুনে পোড়া কতগুলো কাল পাথরের নুড়ি। এই যৎসামান্য চিহ্নই কবির কল্পনায় প্রিয়ার স্পর্শের সাক্ষাৎ নিদর্শন। যাযাবর প্রেয়সীর ফেলে যাওয়া মরুবাসের কথা ভেবে কবির মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। প্রাক-ইসলামী যুগের আরবী কবিতা সাহিত্য হিসাবে সত্যিই অসামান্য, যাতে সৌন্দর্য, মানবিক আবেগ ও গভীরতর অনুভবের ভেতর দিয়ে আরব জাতির প্রাণের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। 

প্রেমিক যেমন প্রেমাস্পদের ফেলে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে হৃদয়ের ক্ষতের উপশম করত, তেমনি আরও একদল লোক সেকালে ছিল, যারা ভূতপূর্ব যুগের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আপন পূর্বপুরুষ ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের খোঁজ করত। অনুসন্ধিৎসু মনের এই খোঁজ থেকেই হয়তোবা প্রতœতত্ত্বের সূত্রপাত। অবশ্য পশ্চিমে আধুনিক জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে প্রত্নতত্ত্বের উদয় খুব বেশিদিন আগে হয় নি। তবে আমরা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আসার শব্দটি দেখতে পাই, আধুনিক আরবী ভাষায় যার অর্থ দাঁড়িয়েছে প্রত্নতত্ত্ব। কুরআনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কাজে লাগিয়ে জ্ঞান অন্বেষণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব প্রাচীন ইতিহাস জানতে সাহায্য করে। প্রাচীন লেখামালার অধ্যয়ন সেকালের শাসকদের সম্পর্কে এমন সব তথ্য তুলে ধরে যা অন্য কোন সূত্রের মাধ্যমে জানা হয়তো সম্ভব নয়। কুরআনের ‘বিশ্বাসীগণ’ (সূরা মু’মীন) অধ্যায়ে বলা হয়েছে: “তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে নি? দেখেনি তাদের পূর্বসুরীদের কি পরিণাম হয়েছিল? তাদের পূর্বপূরুষেরা তাদের চেয়ে সংখ্যায় ছিল অধিক, ক্ষমতায় ছিল গরীয়ান, আর [যেখানে তারা বাস করত সেই আবাস] ভূমিতে রেখে যাওয়া কীর্তির বিচারেও ছিল শ্রেষ্ঠ। তবু তাদের যাবতীয় অর্জন তাদের কোন কাজেই আসেনি” (৪০:৮২)। সত্যিই, প্রাচীন বহু সভ্যতা এমন সব মহাকায় স্থাপত্য আর সুপরিকল্পিত শহর-বন্দর তৈরি করেছিল, যার ভগ্নাবশেষ দেখে আজও আমরা চমৎকৃত হই। সেসব কীর্তি আজ আর নেই, আছে শুধু সেগুলোর যৎসামান্য চিহ্ন। কুরআনের এই আয়াত মানুষের অতীতকে বোঝার ক্ষেত্রে, আর বিরাট কীর্তিমান মহাপ্রতিপত্তিশালী প্রাচীন সভ্যতাদির পতনের কারণ অনুসন্ধানে প্রত্নতত্ত্ব যে কত প্রাসঙ্গিক, সে দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। 

কুরআনের ভাষ্যমতে কোন সভ্যতাই শুধু তার বাহ্যিক উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। যে কোন সভ্যতার টিকে থাকার এবং উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটার প্রথম সোপান হল আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে, বিশুদ্ধতা ও স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতার মধ্যে, আধ্যাত্মিক বিকাশ ও বস্তুগত উন্নতির মধ্যে এক নিপুণ ভারসাম্য বজায় রাখা। এই ভারসাম্যই মানব সভ্যতাকে একটি সুস্থ বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কুর’আনে নিকট প্রাচ্যের বেশ কিছু জাতির উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেমন: সামূদ, ‘আদ, শু‘য়াইব এবং নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা ফেরাউন শাসকদের আমলের মিশরীয় জাতি। বস্তুগত উন্নতির ফলে একসময়ে তারা প্রাচীন বিশ্বে বহু সফল বাণিজ্যপথ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। মাদায়েন-সালিহ, পেট্রা, মা’আরিব, নিনেভ, ব্যাবিলিয়ন ইত্যাদির মত তাদের প্রবাদপ্রতিম উন্নত নগরীগুলো নিকট প্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন বাণিজ্যিক পথের উপর এসব শহর শনৈ শনৈ বিকাশ লাভ করে। এসব শহরের স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ আজও আমাদের স্তম্ভিত করে। কিন্তু তাদের সভ্যতার ভিত্তি ছিল দুর্বল, ঘাটতি ছিল আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের। বস্তুগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক বিকাশ হয় নি তাদের। ফলে ক্ষণকালীন উন্নতির পর সেসকল সভ্যতা সামান্য স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট রেখে কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। সত্যিকারের প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান মানবজাতির জন্য খুবই কাজের জিনিস, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সংস্কৃতির মধ্যকার নানা যোগসূত্র খুঁজে পেতে এবং হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার ইতিহাস খুঁজে পেতে প্রতœতত্ত্ব অভূতপূর্ব সাহায্য করে। কুরআন এক অর্থে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের বস্তুনিষ্ঠ বিচারকেই উৎসাহিত করে, কারণ অনেকেই নিজেদের প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্যকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করে। 

ভৌত বস্তুর বাহ্যিক, দৃশ্যমান আকার-আকৃতি মানুষের জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলোর অবয়বে নিহিত থাকে নানা তাৎপর্য। বস্তুগত নানা সামগ্রী শুধু আমাদের প্রয়োজন মেটায় তা নয়, সেগুলোতে নিহিত থাকে গুরুত্বপূর্ণ নানা সাংস্কৃতিক বার্তা। যেমন স্থাপত্য যে শুধু মানুষের আশ্রয়ের প্রয়োজনই মেটায়, তা নয়! বরং স্থাপত্য মানুষের নিজ আবাসস্থলটি শোভনরূপে সাজিয়ে রাখার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিও প্রতিফলিত করে। গুহায় বাস করা আদিম মানুষও নিজেদের বসবাসের গুহাগুলো চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে অলংকৃত করার চেষ্টা করত। বলাই বাহুল্য যে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের কাছে এসব সূক্ষ্ম নান্দনিক বিষয় মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী বিশ্বের স্থাপত্য ও শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে বিদ্যায়তনিক চর্চা পাশ্চাত্যে কিছুটা দেরি করেই শুরু হয়, কিন্তু মুসলিম পণ্ডিতরা ইসলামের আদি পর্ব থেকেই এধরনের ঐতিহাসিক বিষয়াদিতে আগ্রহী ছিলেন। যেমন, আল-মাকরীজী (১৩৬৪১৪৪১) ও আল-কালকাশান্দীর (১৩৫৫১৪১৮) মত পণ্ডিতেরা ঐতিহাসিক কায়রো নগরীর স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যাপারে যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তা এযুগের প্রত্নতাত্ত্বিক বা শিল্প-ঐতিহাসিকদের কাজ থেকে মৌলিক চরিত্রে খুব ভিন্ন ছিল না। মক্কার বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বাঙালি বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-মাদরাসা আল-সুলতানিয়্যাহ আল-গিয়াসিয়্যাহ আল-বাঙ্গালিয়্যাহ’র কোন কোন শিক্ষক ও পণ্ডিত (যেমন তাক্বী আল-দীন আল-ফাসী  [৭৭৫–৮৩২/১৩৭৪–১৪২৮] এবং জামাল আল-দীন মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-শীবী [৭৭৯–৮৩৭/১৩৭৮–১৪৩৩]) পদ্ধতিগতভাবে শিলালিপির অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে সে অঞ্চলের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করেন, যার সাথে বর্তমানকালের শিলালিপিবিদ্যা চর্চার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে সেকালের মুসলিম লেখক ও গবেষকদের শিল্পকলা, স্থাপত্য ও বস্তুগত সংস্কৃতি নিয়ে লেখা পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইপত্রের খুব সামান্যই আজ টিকে আছে। 

‘ইসলামী’ বিশেষণটিকে অনেক সময় একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব সংকীর্ণভাবে ব্যবহার করা হলেও এটিকে একটি সম্প্রসারিত ও উদার অর্থেও ব্যবহার করা যায়। বিশ্বজনীন, নিখিলপন্থী নানা সূফী মতবাদ অনুসারে মহাবিশে^র যাবতীয় উপাদানকেই ইসলামী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেহেতু সবই প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তী এবং ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই ধারণাটি কুরআনে আছে এভাবে: ‘সপ্ত আসমান ও পৃথিবী এবং এই দুইয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সব তাঁরই প্রশংসা করে। প্রতিটি জিনিসই তাঁর প্রশংসায় রত’ (১৭:৪৪)। অন্যদিকে ইসলামে উম্মাহ বা উম্মতের যে চিন্তা পাওয়া যায়, তার মধ্যে নিহিত আছে সামগ্রিক মুসলিম ঐক্যের ধারণা। এই ঐক্যের ছাপ মুসলিম সমাজের বস্তুগত সংস্কৃতি, দৃশ্যমান রূপ ও শৈলীতে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের শিল্প, চারুকলা ও স্থাপত্য ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও নানান ভাবে মুসলিম সংস্কৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে, যাতে মুসলিমদের সাথে সাথে অমুসলিমরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। ‘ইসলামী’ বিশেষণটি তাই ভেবেচিন্তে ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যবহার করা একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়, কারণ একেক অঞ্চলের শিল্পে নানা ধরনের আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলার প্রকাশ তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক ধারায় ভিন্ন ভিন্নভাবে রচিত হয়েছে। নানাবিধ ধর্মীয় প্রতীকও অঞ্চলভেদে বদলে গেছে ও ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যাপক অর্থে, ইসলামী সংস্কৃতি এক বহুমাত্রিক সংস্কৃতি।

ইসলামী বিশ্বের শিল্প, চারুকলা ও স্থাপত্য ইত্যাদির বড় অংশ ইসলামের আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থ্ার সরাসরি ও প্রত্যক্ষ প্রবর্তনের কারণে গড়ে উঠে। আবার দৃশ্যমান সংস্কৃতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশের উপর ইসলামের প্রভাব খুব স্পষ্ট না হলেও পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মাদরাসা, মসজিদের মত স্থাপত্য কিংবা জায়নামায, কুরআনের চারুলিপি ইত্যাদির মত শিল্পকলার বিকাশ নিতান্তই ইসলামের নিজস্ব প্রয়োজনেই ঘটেছে।  আবার দৈনন্দিন জীবনের বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও সামগ্রী যেমন বই-বাঁধাই, বস্ত্রশিল্প, কাঁচশিল্প, সিরামিক (চিনামাটির তৈরি বাসন-কোসন), গয়না-অলংকার ইত্যাদিতে ইসলামের সরাসরি প্রভাব ঠিক ততটা প্রত্যক্ষ নয়। তত্ত্বগতভাবে কোন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান মনে করতে পারেন যে মুসলমানদের জন্য শরিয়তের চেতনাবিরোধী কোন কিছু উৎপাদন করা বা ব্যবহার করা উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, নীতিগতভাবে যে কোন মুসলিমের সোনা বা রুপার থালা ব্যবহার করা অনুচিত, যেহেতু তা ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে। তবু কেউ তা করলেও সে মুসলিম উম্মতের অংশই থাকবে, কারণ ইসলামের মতে মানুষ মাত্রই ভুল করে। একদিকে যেমন আদর্শগতভাবে মুসলিম শিল্পীদের ইসলামী চেতনার বিরোধী কিছু সৃষ্টি করা উচিত নয়, অন্যদিকে এটাও বাস্তব যে কোন মুসলিমের পক্ষেই জীবনের প্রতি মুহূর্তে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া শিল্পীর সৃজনকর্ম মাত্রই যে তার ব্যক্তিগত মনোভাব ও ঝোঁকের পরিচয় বহন করে, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না।   

আদি ও মধ্যযুগে ইসলামী সভ্যতার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি একদিকে যেমন ইসলামী শিল্পকলার উন্মেষের কারণ, তেমনি ইসলামের গভীর আধ্যাত্মিক মরমিবার্তাও ইসলামী বিশ্বের বহুবিধ সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার প্রেরণার উৎস। পুরাতন বিশে^র এক বিরাট এলাকায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিজিত অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মুসলিম বিশে^র শিল্প ও স্থাপত্যের উপর বিশেষ ছাপ ফেলে। আবার ইসলামী শিল্পকলার অনেক উপাদান অন্য কোন সংস্কৃতির সঙ্গে লেনদেনের আগেই, শুধুমাত্র নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাতেই উদ্ভূত হয়। ইসলামের আদি যুগে আনাতোলিয়ার জামি‘ মসজিদগুলোর স্থাপত্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইন ক্যাথেড্রাল চার্চের স্থাপত্যিক পরিকল্পনার মিল, কিংবা মসজিদের মিহরাবের সঙ্গে গির্জার অল্টারের (তথা বেদির) অনুরূপতা এবং মিম্বারের সঙ্গে চার্চের পাল্পিটের সাদৃশ্য হওয়াটা অনেকটা স্বাভাবিক।  তবে ভুলে গেলে চলবে না যে মন্দিরে পূজার বেদির মতই খ্রিস্টান অল্টার মূলত ব্যবহার করা হয় অর্ঘ্য নিবেদন করার জন্য। অন্যদিকে মিহরাব হল ইমামের জন্য নির্ধারিত জায়গা, যেখানে তিনি নামাযের নেতৃত্ব প্রদান করেন। গির্জার পাল্পিট হল যাজকের জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চ, যেখানে তিনি ভক্তদের জন্য প্রার্থনা ক্রিয়া সম্পাদন করেন। আর মিম্বার হল মসজিদের ভিতরে মুসল্লীদের সামনে ইমামের জন্য নির্ধারিত মঞ্চ, যেখানে তিনি জুম‘আর ভাষণ দেন। যখন মদিনায় প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, সেটা ছিল একেবারেই খাঁটি নিজস্ব ধরনের একটি স্থাপত্য, যার সাথে সে অঞ্চলে প্রচলিত স্থাপত্যের কোনই মিল ছিল না। মুসলমান সমাজের বিশেষ কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে এই মসজিদের নির্মাণ, যা ইসলামপূর্ব যুগে বিরাজমান ছিল না। অর্থাৎ রূপগত সাদৃশ্য দেখে লক্ষ্যগত পার্থক্য ভুলে গেলে ঠকতে হবে।

মুসলিম জাহানের ক্ষেত্রে ‘সেকুলার আর্ট’ বা ‘ইহজাগতিক শিল্পকলা’ পদটির ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাত্ত্বিক বিচারে হয়তো যুক্তি খাড়া করা যেতে পারে যে মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজই ধর্মীয় কাজ বা ইবাদত (সৎকর্ম) হয়ে উঠে, যদি তা সৎ নিয়ত (তথা উদ্দেশ্য) থেকে করা হয়। ফলে একান্ত ইসলামী বিচারে কোন কাজই ধর্মের ঊর্ধ্বে বা নীতিগতভাবে তাৎপর্যহীন নয়। অথচ মুসলমান শাসকদের গড়া সুশোভন রাজকীয় প্রাসাদগুলোর নান্দনিক আবেদনও উপেক্ষা করার জো নেই, যেগুলো বলতে গেলে শরীয়তের চেতনার সঙ্গে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মনে রাখতে হবে যে ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্যের বিচারকে শুধু দৃশ্যগত মূল্যায়নে সীমাবদ্ধ করাটাও হবে এর এক ধরনের সংকীর্ণ পর্যবসান। বিপরীতে আবার ইসলামী শিল্পকলার নান্দনিকতা উপেক্ষা করে ইসলামী শিল্পকলার শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বা তার মরমি চিহ্ন ও প্রতীককেই একমাত্র অনুসন্ধানের বিষয় করে তোলাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। মোদ্দা কথা ইসলামী শিল্পকলা অধ্যয়ন মাত্রই যে একটি জটিল প্রক্রিয়া, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ক্ষেত্রটিতে সঠিক পরিভাষার ব্যবহার ও শব্দ চয়ন থেকে শুরু করে এর গভীর তাৎপর্য অনুধাবন ইত্যাদি বিষয়গুলো কখনো কখনো বেশ শ্রমসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। 

পুরাতন দুনিয়ায় তথা পূর্ব গোলার্ধে ইসলামের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে উদীয়মান ইসলামী সভ্যতায় সৌন্দর্যের ধারণা ক্রমশ আরও বিশ^জনীন হয়ে ওঠে, যার প্রকাশ ঘটে ইসলামী নান্দনিক অভিব্যক্তিতে। এতে নানা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক উপাদান আত্মীয়কৃত হতে শুরু করে, হোক তা পুবের বা পশ্চিমের। ফলে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্রমশ আন্তর্জাতিকতা ও বিশ^ায়নের পথে এগিয়ে যায়। একদিকে যেমন ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি যত জটিল ও গভীরতাস্পর্শী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে এর শিল্পকলাও হয়ে ওঠে তত পরিপক্ব। ঐকতান, ধারাহিকতা, ভারসাম্য, সুষমা, আপেক্ষিকতা ও বৈপরীত্য এবং অন্যান্য নানান রূপগত (যথা জ্যামিতিক আকৃতি, রং, ঢং ইত্যাদি) বিষয়াদিতে ইসলামী শিল্পকলা ক্রমশই হতে থাকে সমৃদ্ধিশালী। এতে এমন সব গুণের মিশেল ঘটে, যার মধ্য দিয়ে এতে গতিশীলতার সঞ্চার হয়। 

প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুর নিজস্ব কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য থাকে যা তার দৃশ্যরূপকে অন্য আরেকটি বস্তুর দৃশ্যরূপ থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে, তা সেই বস্তুর উৎপাদনকারী যে ধর্মের বা মতেরই হোক না কেন। তাই কোন ইসলামী বৈশিষ্টপূর্ণ শিল্পবস্তু বিশেষ একজন অমুসলিম কর্তৃক তৈরি হলেও সেটি ইসলামী বলেই বিবেচিত হয়। ইসলামী বিশ্বের বহু অঞ্চলেই তো ইসলামী স্থাপত্য, এমনকি মসজিদ নির্মাণেও অমুসলিম শিল্পী ও কারিগরেরা সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে ভক্তিবাদী মুসলমানেরা ইসলামী শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে শিল্পীর এক অচ্ছেদ্য আত্মিক বন্ধন খুঁজে পান। মহানবীর (সা.) সময়ে কতিপয় মুনাফিক (তথা বকধার্মিক) ব্যক্তিরা মদিনায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু নির্মাতারা চাইলেও এটি মসজিদ বলে মর্যাদা পায় নি, কারণ তাদের উদ্দেশ্য খাঁটি ছিল না। আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের বিচারে মসজিদ স্থাপনার মর্মগত ভিত্তি হল তাকওয়া বা গভীর আধ্যাতিœক অনুভুতি। প্রথম দিন থেকেই যে মসজিদের ভিত স্থাপন করা হয়েছে তাকওয়ার ওপর-সেটাই তোমার সালাতের জন্য অধিক উপযুক্ত।  (আল-কুর’আন, ৯:১০৮)।

পুরাতন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটতে শুরু হলে এবং মুসলিম জাহানের সীমা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকলে অমুসলিম সমাজের সঙ্গে মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। অনেক অমুসলিম সমাজ মুসলিম সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর একটি উদাহরণ হল সিসিলি যেখানে নরম্যান অধিকারের পূর্বে দীর্ঘকাল জুড়ে মুসলিমরা শাসন করেছিল। নরম্যানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ইসলামী সংস্কৃতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব সেখানে থেকে যায় এবং সিসিলির নরম্যান রাজারা স্থানীয় ইসলামী সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণ করে। নরম্যান রাজাদের আমলে তৈরি একাধিক স্থাপত্য এবং রাজকীয় শিল্পবস্তুতে ইসলামী অলংকরণের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। ইসলামী সংস্কৃতির সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকায় সেগুলোকে অনেক সময় বৃহত্তর অর্থে ইসলামী শিল্পকলা বলে গণ্য করা হয়। আর সত্যিই তো নানা ধরনের বিচিত্র মানব সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট বিভেদরেখা টানা সহজ নয়, কারণ প্রতিটি সংস্কৃতি নানা সমাজ ও জাতির মধ্যে লেনদেন ও মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। মানবীয় শিল্পকলাকে কখনও কখনও কোন একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতির ঐতিহ্যের গণ্ডির মধ্যে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হলেও শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এর সার্বজনীনতার সত্যটা অনেকটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে ‘ইসলামী’ শব্দটির সংজ্ঞা ও ব্যবহার বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। ‘ইসলামী’ বলতে কোন কোন সময় সচেতন বা অচেতনভাবে কোন বস্তুবিশেষের প্রতি নির্দিষ্ট কোন দৃষ্টিভঙ্গি আরোপিত করা হয় বা নির্দিষ্ট কোন তাৎপর্য বোঝান হয়। তবে একই সঙ্গে ইসলামী শিল্পবস্তু অন্যান্য গুণাগুণধারীও হতে পারে বৈকি; তাতে থাকতে পারে বিশেষ স্থানীয়, আঞ্চলিক বা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। কোন শিল্পবস্তু ইসলামী হওয়ার পাশাপাশি হতে পারে আরব, মিশরী, মধ্য এশীয়, তুর্কি, বাঙালি এমনকি বাংলাদেশীও। শিল্প ও স্থাপত্যের এহেন আঞ্চলিক প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা মুসলিম জাহানের একেক জায়গায় ও একেক সময়ে একেক রকম হতে পারে, এবং হয়েও থাকে। 

এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ঢাকা রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু শের-এ-বাংলা নগর, যেখানে পশ্চিমা স্থপতি লুই কানের পরিকল্পিত নকশায় জাতীয় সংসদ ভবনটি নির্মিত হয়েছে। এই স্থাপত্যিক নকশায় মসজিদের স্থাপনাটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে এবং তার মাধ্যমে ভবনটির একধরনের প্রতীকী ইসলামী পরিচয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এতে বাংলার ইসলামপূর্ব সংস্কৃতিগুলোর প্রতিফলন, আঞ্চলিক ঐতিহ্য, ঔপনিবেশিক যুগের প্রেক্ষাপট এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পরিচয়বাহী নানা স্থাপত্যিক উপাদানের মিশেল রয়েছে। একজন পশ্চিমা স্থপতির পরিকল্পনামাফিক নকশা করা হলেও স্থাপনার গঠনে স্থানীয় স্থাপত্যধারা ও বাংলার প্রাকৃতিক প্রতিবেশকে নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি পশ্চিমা স্থাপত্যিক ঐতিহ্য থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা ধারণা। সব মিলিয়ে পুরো স্থাপত্যিক কম্পেøক্সটি বহুবিধ বিচিত্র সংস্কৃতির এক অপরূপ মিশ্রণ হয়ে উঠেছে। যুগে যুগে ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কিভাবে নতুন নতুন নানা সংস্কৃতি ও ভাবকে আপন করে নিয়েছে, এটি তারই এক প্রতীকী উপস্থাপন হয়ে উঠেছে। 

সারা পৃথিবী জুড়েই ইসলামী স্থাপত্যিক ঐতিহ্যে মসজিদের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। যাঁরা প্রার্থনা করতে আসেন, মসজিদ তাঁদের দেয় এক প্রশান্ত আধ্যাত্মিক পরিবেশ। কিন্তু মুসলমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে মসজিদের আরও নানা ভূমিকা রয়েছে। নবী মুহাম্মাদ (সা.) তো মসজিদকে তাঁর সকল কর্মকা-েরই কেন্দ্রবিন্দু করেছিলেন, হোক তা সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয়। অনেক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় স্থাপত্য অতিশয় অলংকৃত হয়ে থাকে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য সাধারণ লোকদের উপাসনার প্রতি আকৃষ্ট করা। ইসলামে শৈল্পিক ও নান্দনিকতাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হলেও বাহ্যিক সাজসজ্জা ও অলংকরণকে চূড়ান্ত বা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দান করা হয় নি। বরং অনেক মুসলিম সমাজে দেখা যায় যে মসজিদের অলংকরণ সেখানকার আঞ্চলিক শিল্প ও স্থাপত্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। উদ্দেশ্য একটাই, যেন উপাসনাকারীরা আধ্যাত্মিক অন্বেষণের বদলে স্থাপনার নান্দনিকতার প্রতি বেশি মাত্রায় ঝুঁকে না পড়ে। বিখ্যাত রাজধানী শহর যেমন, কায়রো,

ইস্পাহান অথবা দিল্লিতে যে চমৎকার স্থাপত্য দেখা যায় তা অবশ্য আমাদের অন্য কথা বলে। কিন্তু মোটের উপর ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্য যত না জাঁকজমকপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মুসলিম সমাজে মসজিদের কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে যুগে যুগে মসজিদের মধ্য দিয়েই ইসলামী স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নির্মাণশৈলী ফুটে উঠেছে। একদিকে তা বিশ্বাসীদের জন্য তৈরি করেছে আধ্যাত্মিক ভাব ও ভক্তিরসে পূর্ণ পরিবেশ, অন্যদিকে দর্শনার্থীদের তা করেছে রূপ ও গুণে মুগ্ধ। কুরআনে মসজিদের শৈল্পিক গুরুত্বের উল্লেখ আছে (৭:৩০)। অন্যান্য সংস্কৃতির ধর্মীয় স্থাপত্যের রূপ ও ক্রিয়াগত দিক থেকেও মসজিদের স্থাপত্য অনেক আলাদা। অনেক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় স্থাপত্যে কাঠামোর উল্লম্বতা ও উচ্চতার (তথা উপর-নিচ অক্ষের) উপর যেমন জোর দেওয়া হয়, সেখানে মসজিদের স্থাপত্যে আনুভূমিকতার (অর্থাৎ প্রসারতা ও ব্যাপকতার) উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি, যেন সর্বাধিক সংখ্যক লোক প্রার্থনায় অংশ নিতে পারে। সাধারণত মসজিদের প্রবেশ পথ হয় প্রশস্ত ও উন্মুক্ত যেন আজানের ধ্বনি শুনে সকলে জামাতে সমবেত প্রার্থনায় শরিক হয়। কিবলা কক্ষের সুপ্রশস্ত কেন্দ্রীয় পরিসরে সমবেত প্রার্থনাকারীদের মধ্যে কোন উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ থাকে না। অনেক মসজিদে আবার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ থাকে যেন সমবেত মুসল্লীর সংখ্যা বেশি হলে বাড়তি লোকের জন্য জায়গার সঙ্কুলান করা যায়। সুন্দর জীবনযাপন ও ভালভাবে থাকার জন্য ইসলামী স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনায় সবসময় জায়গার প্রশস্ততাকে অপরিহার্য মনে করা হয়েছে। ইসলামের আদিযুগে ইবন আল-মারাহ’র মত বিখ্যাত মুসলিম সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবিশারদগণ মনের শান্তির জন্য সুপরিসর স্থানকে আবশ্যক মনে করতেন। আল-মারাহ বলেন: ‘মানুষের মন প্রশস্ত বিস্তীর্ণ পরিসর দেখে সবসময়ই সুখ পায়, অন্তরাত্মা তাতে অসীম আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করে।’  মুসলিম বিশ্বের বিরাট অঞ্চল জুড়ে গ্রামাঞ্চলের এলাকায় বাড়িঘরে অতি সম্প্রতিকাল পর্যন্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ বা উঠান রাখার প্রথা সুপ্রচলিত ছিল। 

স্থাপত্যকে যেমন মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ বলে গণ্য করা হয়েছে, তেমনি ইসলামী নগর পরিকল্পনায়ও মসজিদকেও রাখা হয়েছে কেন্দ্রে। এমনকি বিশ^াসীদের জন্য পুরস্কারস্বরূপ যে ‘বেহেশত’ বা ‘জান্নাত’ তথা স্বর্গলোকের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার বস্তুগত সুবিধা বর্ণনায় স্থাপত্য বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কুর’আন ও হাদীসে জান্নাতের মনোরম বিবরণে সুশোভিত বাগানের কথা বলা হয়েছে। তাতে এমন সুখ ও আনন্দ লাভ করা যাবে যা কল্পনারও অতীত। মুসলমানেরা নামাযের জন্য যে মুসাল্লা বা জায়নামায (প্রার্থনার জন্য নির্দিষ্ট কাপড়) সাথে রাখে, তাতে প্রায়ই মক্কা ও মদিনায় অবস্থিত দুইটি পবিত্র মসজিদের নকশা অঙ্কিত থাকে। এ থেকেই বুঝা যায় বিশ^াসীদের জীবনে স্থাপত্যের প্রভাব কেমন। ইসলাম শিল্পবস্তু বা স্থাপত্য গড়ে তোলার কলাকৌশল বা পদ্ধতি শেখায় না বটে। কিন্তু স্থপতি ও শিল্পীরা ইসলামের মধ্যে সৃজনী ক্রিয়ার নানা প্রেরণা খুঁজে পান, সেইসাথে পান ব্যাপক স্বাধীনতা এবং শিল্প ও স্থাপত্য বিকশিত হওয়ার উপযুক্ত একটি সৃষ্টিশীল পরিবেশ। যুগে যুগে ইসলামী বিশ্বাসের ভাবগত সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী শিল্পকলারও অধিকতর বিকাশ  ঘটেছে।  

সৌন্দর্য কোন স্বয়ম্ভূ বিষয় নয়, বরং তা আপেক্ষিক। এর বিচার অনেকটাই দর্শকের দৃষ্টি ও ধ্যানধারণার উপর নির্ভর করে। বিশ^াসীরা কুরআনেও নানা আধ্যাত্মিক উপাদান খুঁজে পেতে পারে, যা তাদেরকে সুন্দর সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে সাহায্য করে। কুর’আনে আমরা বিভিন্ন বাহ্যিক সৌন্দর্যের উল্লেখ পাই নানা প্রকাশভঙ্গিতে, যেমন জামাল (সুন্দর, ১৬:৬), হুসন (চমৎকার, ৩২:৭), সুরুর আল-নাযার (দৃশ্যত আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক, ২:৬৯) ইত্যাদি। বাহ্যিক সৌন্দর্যের মূল উপাদানগুলো কুরআনে যেসব শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে, সেগুলো হল: তাসওিয়্যাহ (অঙ্গসৌষ্ঠব, ৮২:৭), ওয়াযান (ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য, ১৫:১৯) ও কদর (সমানুপাতিক, ৫৪:৪৯), ইখতিলাফ (বৈপরীত্য, ৩:১৯০), যুয়্যিনাহ ( আকর্ষণীয়, ৩৭:৬, ৭:৩০), ও ইত্কান (খুঁতহীনতা, ২৭:৮৮)। তবে সৌন্দর্যকে যা সত্যিকারের পরিপূর্ণতা দান করে, তা হল কতগুলো মৌলিক মানবীয় গুণ।  এগুলোর প্রকাশ ঘটে আদল (ন্যায়বিচার, ৩:১৯১), হক (সত্য, ৮:৩০) ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এসব বিষয় স্থান পেয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিতে বাহ্যিক সৌন্দর্য নৈতিক সৌন্দর্য বিবর্জিত হলে তা আর সুন্দর থাকে না। সত্য ও সুন্দর এখানে এক সূত্রে গাঁথা। কতকটা এরকমই ধারণাই যেন উহ্য রয়েছে ভারতীয় দর্শন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ এর মধ্যেও!

ইসলামী শিল্পকলা যে বিকাশ লাভ করেছিল তার কারণ বাধা নিষেধের বেড়াজালে ইসলামী সংস্কৃতি আটকে থাকে নি। শরীয়তের স্পষ্ট লংঘন না করলে শিল্পকলা চর্চায় কোন বাধা ছিল না। ইসলামী শিল্পকলার রূপ ও মাধ্যম সদা সর্বদা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা কোন আলাদা ও স্বয়ম্ভূ বিষয় নয়, বরং তা ফুটে উঠেছে বিভিন্নতা, বহুত্ব, বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে। প্রথাগত গ্রাম্য মুসলিম সমাজে শিল্পবৃত্তির প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতির উপাদানগুলোকে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ আকার দেওয়ার মাধ্যমে। গ্রাম্য সমাজের লোকেরা দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্রকে সাদামাটা সাজসজ্জা ও অলঙ্করণের মধ্য দিয়ে সুন্দর করে তোলে। এভাবে এগুলো একদিকে ব্যবহারকারীদের শৈল্পিক ও আত্মিক চাহিদা পূরণ করে। একই সঙ্গে সেগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনও পূরণ করে। ফলে ইসলামী সংস্কৃতিতে মানুষের জীবনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সৌন্দর্যের প্রতি ঢের বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে বস্তুর সৌন্দর্যবর্ধনে রঙের গুরুত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায় (৩৫:২৭-২৮)। মহানবী (সা.) কিছু রং বেশি পছন্দ করতেন, যেমন: হালকা সবুজ, নীল, সাদা ইত্যাদি। ইসলামী শিল্পকলায় সাধারণত খুব বেশি ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বা জটিল মনস্তাত্ত্বিক ভাষার ব্যবহার নেই, বরং সহজ ও বোধগম্য ভাষাই এতে প্রচলিত। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে নিগূঢ় বা বিমূর্ত ভাষারও ব্যবহার হয়েছে বটে, তবে তার উদ্দেশ্য হল ঐশ্বরিক সৃষ্টির অন্তরালে লুকানো বিবিধ সত্য উপলব্ধি করতে মানুষের ক্ষমতার যে সীমাবদ্ধতা, তা বোঝানো। এমন একটি উদাহরণ হল ‘অ্যারাবেস্ক’ (Arabesque)। ইসলামী শিল্পকলার উপাদান, গঠন, বিন্যাস ও রূপগত আকার-আকৃতি সাদামাটা হলেও বিষয়গত দিক দিয়ে তা সুক্ষ ও উঁচুমানের।

ইসলামী শিল্প সত্যকে আরও বোধগম্য করার চেষ্টা করে। শৈল্পিক প্রকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম শিল্পীরা প্রকৃতিদত্ত সত্যকে গোপন না করতে কিংবা ঈশ্বরের সৃষ্টির বাস্তবতাকে বদলে না ফেলতে সাধ্যমত চেষ্টা করে। মানুষের সীমাবদ্ধ শৈল্পিক প্রতিভাকে বাস্তবতা ও সত্যের মধ্য দিয়ে যথাযথ উপস্থাপন এত সহজ নয়। তাই বাধ্য হয়ে কখনো কখনো শিল্পীরা ঈশ্বরের সৃজনীক্ষমতার সঙ্গে তাদের নিজেদের মানবিক শিল্পপ্রতিভার সীমাবদ্ধতা ও পার্থক্য বোঝাতে দুর্বোধ্য কিংবা ভাবমূলক প্রকাশভঙ্গির আশ্রয় নেয়। যেমন প্রতিকৃতি অঙ্কনের ক্ষেত্রে তারা সাধারণত ত্রিমাত্রিক জীবন্ত ছবি না এঁকে দ্বিমাত্রিক ছবি আঁকতে বেশি পছন্দ করে। অন্য কথায় ঈশ^রের সৃষ্টির হুবহু অনুলিপি কেউ তৈরি করতে পারে, এমন কোন বিভ্রান্তির অবকাশ তারা দিতে চায় না। এভাবে ঐশ্বরিক ক্ষমতার সামনে নিজের দীনতার কথা তারা সবসময় মনে রাখে, যেন কখনো ঔদ্ধত্য প্রকাশ না পায়। ‘অ্যারাবেস্ক’ এই চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ, যেখানে লতাপাতার নকশা কখনোই ঠিক প্রকৃতির অনুরূপ হয় না, বরং হরেক রকম জ্যামিতিক আকারে উপস্থাপিত হয়।

কোন কোন সংস্কৃতিতে ভাস্কর্য ক্ষমতার প্রতীক, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সেটিকে ঐশী ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী শিল্পকলায় ভাস্কর্য ততটা গুরুত্ব পায় নি। ইসলামে মানব ও মানবীয় শরীরের সৌন্দর্য হল সর্বোত্তম ঐশ্বরিক সৃষ্টি (আশরাফ আল-মখলুকাত, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে মহানবীর একটি উক্তিতে)। তার রূপ এত প্রবল ও তীব্র, যে মানবসৃষ্ট শিল্পকলায় তা পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা আদৌ সম্ভব নয়। ফলে সাধারণভাবে ইসলামী সংস্কৃতিতে মানুষের তথা প্রাণিজগতের ভাস্কর্য কখনো তত জনপ্রিয় হয়নি। তবে জড় জগতের ভাস্কর্য সবসময়ই ইসলামী সংস্কৃতিতে বহুল প্রচলিত ছিল। মুসলিম সমাজের দেশীয় ঐতিহ্য এবং স্থানীয় চারু ও কারুকলাকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে সফলভাবে ফুটিয়ে তোলার একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হল জেদ্দাহ শহর। আবার মক্কা শহরের প্রবেশপথে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিগত শতাব্দির শেষের দিকে নির্মিত তিনটি মাটির সুরাহী বা কলসির ভাস্কর্য, যেখান থেকে এক ঝর্ণায় অনবরত পানি গড়িয়ে যাচ্ছে, যা এই শহরের প্রতি আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই সুরাহীগুলোর ভাস্কর্য এই শহরের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আদিকালে এই শহরের মানুষেরা হারাম শরীফের মধ্যে মাটির পাত্রে তীর্থযাত্রীদের জমজমের পানি বিতরণ করত। এই প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা কুরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে (৯:১৮-১৯) যা অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত মক্কা আল-মুর্কারমা অঞ্চলে অল্পবিস্তর প্রচলিত ছিল।

চারুলিপি হল ইসলামী সংস্কৃতির আরেকটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা। কুর’আনের লিপিকলা একজন মুসলমানকে ঐশ্বরিক বার্তার চাক্ষুষ সৌন্দর্য এবং একই সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা ও বিষয়গত মহিমা জানান দেয়। সনাতন প্রথাগত সমাজে নিরক্ষর আমজনতা ইসলামী চারুলিপি পাঠ করতে পারত না বটে, কিন্তু সুদৃশ্য লিপিশৈলী তাদেরকে অন্তত দৃশ্যরূপের নান্দনিক শোভার মূল্যায়ন করতে শেখাত। সব স্থাপত্যিক শিলালিপির প্রাথমিক কাজ আসলে লিখিত বার্তা বহন করা ছিল না। বরং মাঝে মাঝে অলংকরণই ছিল মূল উদ্দেশ্য, কারণ দেখা যায় কোন কোন স্থাপনায় সন্নিবেশিত চারুলিপির অবস্থান এত উপরে যে তা খালি চোখে পড়া বা পাঠোদ্ধার করা সম্ভব নয়। ইসলামী সংস্কৃতিতে লিখিত শব্দ শুধু ভাষাগত যোগাযোগেরই মাধ্যম নয়, বরং শৈল্পিক প্রেরণারও এক ভরপুর উৎস। প্রত্যেকটি হরফ বা অক্ষরের বাহ্যিক গঠন ইসলামী লিপিকলার রচনাশৈলীকে নতুন নতুন মাত্রা দেয়। আরবী সাহিত্যেও হরফের আকার-আকৃতি উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যা মরমিবাদী ইবন আল-ফরিদের একটি কবিতার চরণে খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে:

কখনো যদি মনে কর আমাকে বা হরফের নিচের নুকতার চেয়েও ক্ষুদ্র,

তবুও পৌঁছাব অনেক উঁচুতে, পারবে না তুমি কোনদিন ছুঁতে, যতই সেয়ানা হও না কেন।  

লিখিত রূপ ইসলামী সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ঐতিহাসিক বিচারে মুসলিম সমাজ কখনো পুরোপুরি সাক্ষর ছিল না। বিদ্যা বা আল-‘ইলম তথা শিক্ষা গ্রহণ করাকে ইসলামে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই ইলমকে সাধারণ সমাজে জনপ্রিয় করতে মুসলিম সমাজ তেমন একটা সফলতা কখনো অর্জন করেনি। কুরআনে অবতীর্ণ হওয়া প্রথম পংক্তিতেই বলা হয়েছিল ‘পড়’, যদিও মহানবী (সা.) নিজে লেখাপড়া জানতেন না। তবে তাঁর এই নিরক্ষরতার দরুণ শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত নিপীড়িত শ্রেণীর দুঃখ-বেদনা যেন তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি ও প্রকাশ করতে পেরেছেন। 

ইসলামের একটি মৌলিক নীতি হল লা যারারা ওয়া লা যিরারা, যার প্রভাব মুসলিম সামাজিক জীবনে গভীর। এটি মহানবীর একটি উক্তি, যার অর্থ: “ক্ষতি করা যেমন ঠিক না, তেমনিভাবে ক্ষতি ঘটতে দেওয়াও কখনোই ঠিক না”। এই নীতি মুসলিম সামাজিক মেলবন্ধন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি সামাজিক স্বার্থ ও ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষা করে। এই একই নীতি মুসলিম সমাজের নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। মুসলিম সমাজের নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের নৈতিক বিবেচনার মধ্যে রয়েছে নগর উন্নয়ন বনাম সামাজিক উন্নয়ন, স্থানীয় সরকারের অধিকার বনাম ব্যক্তিগত অধিকার, পারিবারিক মালিকানা বনাম রাষ্ট্রিয় স্বার্থ ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয়। এসব খুঁটিনাটি বিষয়াদি নিয়ে ইসলামী আইনশাস্ত্রে এতই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা হয়েছে যে তা সত্যিই আমাদের অবাক করে। স্থাপনা নির্মাণের কৌশলগত দিকের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে স্বভাবতই কোন দিকনির্দেশনা নেই। তবুও শরীয়তের সঙ্গে স্থাপনার নিয়মনীতির একপ্রকার পারস্পরিক সম্পর্ক কোন না কোনভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। শরীয়তের উদ্দেশ্য যেহেতু যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণ, ফলে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য উত্তম নকশা ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু দার্শনিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাগত উপাদান যোগান দেয় ।  

অন্যান্য অঞ্চলের মত বাংলায়ও মূলধারার সূফীরা মুসলিম সমাজের জন্য শরীয়তের গুরুত্বের উপর জোর দিতেন। তাদের মতে শরীয়ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের জন্য ইহজগতে একটি সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করে, আর পরজগতে মেলায় স্বর্গীয় পুরস্কার, যাকে প্রতীকী অর্থে জান্নাত বা বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। বেহেশতের বর্ণনায় গাছপালা, ফুল, নদী ও পানির সুষম বিন্যাসে প্রাণবন্ত পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। এই অভিকল্পনা তাই মানুষের জন্য আনন্দদায়ক পরিবেশের একটি রূপকল্প স্বরূপ। ইহজাগতিক জীবনে মুসলিম নগর পরিকল্পনায় বরাবরই পরিবেশগত ভারসাম্য ও সামাজিক বৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যতা ও খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে ইসলামী নগর পরিকল্পনায় জ্যামিতিক বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে মহাজাগতিক কল্পনার ভাবপ্রবণতাও দেখা যায়। নগরের বাগান বিন্যাসের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে নজরে পড়ে। মহাজাগতিক সজ্জার সবচেয়ে দারুণ প্রকাশ সম্ভবত ৮ম শতকে প্রতিষ্ঠিত বৃত্তাকার বাগদাদ শহরে দেখা যায়, যেখানে প্রাচীন মুসলিম নগর পরিকল্পনাকারী ও স্থপতিরা তাঁদের অ্যাস্ট্রোলব, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ও জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞানকে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অতীতে মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ছিল নির্মাতা ও কারিগরদের নিবেদিত শ্রমের ফল। তা ছিল ঐতিহ্যের নিগড়ে বাঁধা। মুসলিম বিশে^র গ্রামাঞ্চলের মিস্ত্রি ও কারিগরেরা তাদের প্রথাগত ওস্তাদদের কাছে একমাত্র হাতেকলমে শিক্ষানবিশি করেই স্থাপত্য বিদ্যায় হাত পাকাতেন। তবু তারা এমন সব দালান নির্মাণ করতে পারতেন যা গ্রামীণ জনগণের প্রয়োজন দিব্যি মেটাত। দুর্ভাগ্যবশত যন্ত্রপ্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে সাদামাটা অথচ আবেদনময় এসব মসজিদ অতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। আজ ইসলামী স্থাপত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকটা যান্ত্রিক কিংবা উৎপাদিত পণ্যবিশেষ, যা গ্রাহক, স্থপতি ও ঠিকাদারদের এক বৈশ্বিক বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে চালিত হয়। স্থাপত্যের নানা সমস্যার জবাব খুঁজতে পশ্চিমা স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে স্থানীয় ও ঐতিহ্যগত উপাদানের মিশেল ঘটিয়ে তথাকথিত আধুনিক জাতীয় স্থাপত্যধারা তৈরি করা হচ্ছে। অথচ আধুনিকতার অন্ধ অন্বেষণে প্রায়ই আত্মপরিচয় পড়ছে সংকটের মুখে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আঙ্কারার একটি আধুনিক মসজিদ। মসজিদটির ভেতরে মিহরাবের উপরে পবিত্র কুরআনের আয়াত বা বাণীকে আরবী হরফে না লিখে ল্যাটিন হরফে খোদাই করা হয়েছে।  শুধুমাত্র অতীতের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করাটাই যেন এখানে আধুনিকতা, আর কুরআনকে ল্যাটিন হরফে লিখলেই যেন পশ্চিমাকরণ হাসিল করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সফলতা নিশ্চিত করা হয়ে গেল। কিন্তু কুর’আনের লিখনে আরবী লিপির ব্যবহার যে শুধু চারুলিপির অত্যুচ্চ মানের শিল্পাবেদনই তৈরি করে তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বাসীরাও অতীতের সঙ্গে তথা সমকালীন বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে এক আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্থাপত্যকলায় স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধ্যান-ধারণা ও উপযুক্ত ভাষার ব্যবহার জরুরি। আধুনিক যুগে মুসলিম জাহানের স্থাপত্যে যে হাওয়া বদল এসেছে, তা ধরন, গড়ন, আকৃতি ও রূপের প্রয়োগকেও প্রভাবিত করেছে। এই প্রক্রিয়া অবশ্য ইসলামের ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকেই শুরু হয়, যখন মুসলমানেরা গ্রীক ও সাসানীয় (পারস্য) সংস্কৃতির বহু সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণ করে। এমনকি মহানবীর যুগেও মুসলিম সমাজের সঙ্গে মদীনার ইহুদি সমাজের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল, এবং মহানবী তাতে আপত্তি করেন নি যতক্ষণ তা ইসলামী চেতনার পরিপন্থী হয় নি। 

আধুনিক কাঠামোগত প্রযুক্তি ও স্থাপত্যিক প্রকৌশলের নির্বিচার ব্যবহার প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থায় যে বরাবর সুফল নিয়ে আসে, তা মনে করা হয়ত বা ঠিক হবে না। প্রযুক্তির সঙ্গে প্রচলিত সমাজের চিন্তাচেতনা ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের যথাযথ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য থাকলে তবেই না সুদূরপ্রসারী উন্নতি ও ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। মুসলিম সমাজে আধুনিক নির্মাণকৌশলের সাথে সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধ, প্রথাগত দক্ষতা ও পারিপাশির্^ক চাহিদার সমন্বয় করলেই একমাত্র সুদূরপ্রসারী উপযুক্ত স্থাপত্য তৈরি করা সম্ভব। এর একটি চমৎকার আধুনিক উদাহরণ হল বিগত শতাব্দির শেষের দিকে গড়ে তোলা জেদ্দাহ বিমানবন্দরের হজ্জ টার্মিনাল, যার নকশার মধ্যে পরিবেশ, পরিপার্শ্ব ও ইসলামী সাংস্কৃতিক চাহিদার উপযোগী স্থাপত্যিক ধ্যানধারণার ছাপ রয়েছে। বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মুসলমান তীর্থযাত্রীর মক্কায় প্রবেশপথ হিসাবে এর দৃশ্যগত গুরুত্ব অপরিসীম। নতুন দেশে তাদের প্রথম পদার্পণে অপূর্ব সৃজনীকল্পনার পরিচয়বাহী এই স্থাপত্য পরিসরটি যেন তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। এর টার্মিনালের বিস্তীর্ণ ছাদের সজ্জাটি সুষমভাবে বিন্যস্ত সারি সারি খোলা তাঁবুর মত। এটা হয়তো তাদেরকে এ যাত্রার শেষ গন্তব্য আরাফাত ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে তাদের থাকার একমাত্র স্থান সারিবদ্ধ তাঁবু। মুসলিম স্থাপত্যে কুপোলা তথা ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজের এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বড় গম্বুজের ব্যবহার যে মূলত তাঁবুর নকশা থেকে গৃহীত সেটা লক্ষণীয়, কারণ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় বসবাসকারী মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একদা তাঁবুবাসী যাযাবরের জীবন যাপন করত। যাযাবর জীবনে তাঁবুতে বসবাসে শহুরে জীবনের মত বিলাসের ছড়াছড়ি নেই, কিন্তু তা প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীবনের অস্থায়ী চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা ইসলামী বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মানবসমাজের নগরায়নের বিষয়ে শরীয়তে কোন বাধানিষেধ নেই, কিন্তু হিতাহিত বিবেচনা না করেই নগরায়নের সীমাতিরিক্ত প্রসার কখনো শুভ ফলাফল ডেকে আনে না, যার একটি জলজ্ব্যান্ত উদাহরণ হল বর্ত্তমান ঢাকা শহর। স্বাধীনতার পরে এলোপাথাড়িভাবে বেড়ে উঠা এই শহরটির পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টি ইদানিংকালে এতটাই উপেক্ষিত, যে সেটি মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার চরণ: ‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট’ (মানসী)। অস্বাভাবিক নগরায়ন জন্ম দেয় অতিব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনাচরণের। তার ফলে যখন চিরাচরিত মূল্যবোধ ও সহজাত মানবীয় বন্ধন উপেক্ষিত হয়, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত প্রকৃতির কাছাকাছি সহজ-সরল জনগোষ্ঠীর জীবনধারার পরিপন্থী।

মুসলিম বিশ্বে স্থাপত্যের ঐতিহ্য অতি সমৃদ্ধ ও সুবিস্তৃত; সেই স্পেন থেকে সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত তার বিস্তৃতি। ইসলামী স্থাপত্যে আছে বহু ধরনের স্থাপনা: মসজিদ, মাদরাসা, মিনার, সরাইখানা, ঐতিহ্যবাহী ছাদে ঢাকা বাজার, সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত বাগান ও ফোয়ারা ইত্যাদি। অন্যদিকে ইসলামী জাহানের রাজকীয় স্থাপত্যও চিত্তাকর্ষক, যার মধ্যে আছে দুর্গ, প্রাসাদ, আদালত, সমাধি, ব্যক্তিগত স্নানাগার এবং নানাধরনের  শহর ও নগর। এগুলো মুসলিম স¤্রাট, রাজা ও শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ লাভ করেছিল। মুসলিম জাহানের রাজকীয় স্থাপত্যও অন্যান্য ধারার স্থাপত্য থেকে আলাদা। তবে রাজকীয় স্থাপনাগুলোর চরিত্র কিছুটা ব্যক্তিগত ও স্বতন্ত্র ধরনের। মর্মর পাথরের তৈরি তাজমহল নিঃসন্দেহে বিশে^র সুন্দরতম স্থাপনাসমূহের অন্যতম, যার অতুল শোভা আমাদের মনে জাগায় বিস্ময় ও সমীহ। কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত ধরনের রাজকীয় স্থাপনা নির্মাণে বিপুল সম্পদ ব্যয় করা বুঝি কখনো কখনো নৈতিকার প্রশ্নও উদ্রেক করে। পারস্যের বিখ্যাত সাসানীয় গালিচা সম্পর্কে খলীফা উমরের (রা:) প্রতিক্রিয়া এখানে মনে রাখার মত। বসন্তের গালিচা নামে পরিচিত এই মূল্যবান গালিচাটি পারস্য বিজয়ের সময় মুসলমান যোদ্ধারা সেসিফোনের রাজপ্রাসাদের রাজদরবারে খুঁজে পায়। গনিমতের অন্যান্য মালামালের সাথে এটি মদিনায় আনা হয়। খলীফা এই গালিচার মাধ্যমে নিজের বাড়ি কিংবা খিলাফতের দাপ্তরিক ভবন অলংকৃত না করে সোনা, রুপা, পান্না ও ইয়াশম (জেড) পাথরে খচিত এই মহামূলবান গালিচাটি খণ্ড খণ্ড করে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তাঁর এই সিদ্ধান্তটি একটি মহামূল্যবান ঐতিহাসিক শিল্পবস্তুর মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে এনেছিল। তবে নিষ্ঠাবান বিশ্বাসীর চোখে এটি ছিল অনৈতিকভাবে অর্জিত সম্পদের একটি ন্যায্য ভাগবন্টন। আর ধর্মপ্রাণদের কাছে এটি ছিল রাজকীয় শিল্পবস্তু বর্জন করার একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। 

অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই শিল্পই হোক, আর স্থাপত্য হোক, কোন কিছুই ইসলামী হয়ে উঠে না যদি তার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া ও উদ্দেশ্য ইসলামী আদর্শ ও ন্যায়নীতির অনুগামী না হয়। আবার ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্য বিভিন্ন অঞ্চলের বহুবিচিত্র উপাদানকে যেভাবে ঠাঁই দিয়েছে, সেটাও বোঝার বিষয়। রোমান অথবা রেনেসাঁ শিল্প ও স্থাপত্যের তুলনায় ইসলামী স্থাপত্য অবলীলায় আশপাশের দেশজ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ফলে এই শিল্প বহুকেন্দ্রিক, বহুআঞ্চলিক এবং বহুকালিক, এবং একই সঙ্গে স্থানকালপাত্র ভেদে তা হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক। খুব স্বাভাবিক কারণেই স্থানীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান ও বৈচিত্র্য যুগে যুগে ইসলামীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে এসেছে। সেগুলো যত বেশি ইসলামের সার্বজনীন চরিত্রের সাংস্কৃতিক চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, ইসলামী স্থাপত্য ও শিল্পও তত বেশি উৎসাহের সঙ্গে সেগুলোকে বরণ করে নিয়েছে। আর সত্যি বলতে কি কোন বিশেষ ধরন, রূপ বা উপাদানের কারণে কোন শিল্পব‘ইসলামী বা অনৈসলামী হয় না। বরং শিল্পবস্তু ও ব্যক্তির মধ্যে, তথা শিল্পকলা ও সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ বা সম্পর্কের নীতি থেকেই এটি ইসলামী পরিচয় লাভ করে। যে বাহ্য উপাদান আগে অনৈসলামী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল তাও ইসলামী কাজে পুনর্ব্যবহৃত হতে কোন বাধা নেই, যদি তার ব্যবহার ও প্রয়োগ ইসলামী হয়। কা‘বা ঘর একটা ভাল ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। ইসলামপূর্ব যুগে এটি মক্কার পৌত্তলিকরা মুর্ত্তি পুজার জন্য মন্দির হিসাবে ব্যবহার করত। মহানবীর (সা.) মক্কা বিজয়ের পর তা মসজিদ হিসাবে রূপান্তরিত করা হয়, এবং নামাজ আদায়ের ক্রিয়াটি সে জায়গাটিকে একধরনের ইসলামী চরিত্র দান করে। এটা যে শুধু মুলিমদের প্রার্থনার জায়গা, তাই নয়; বরং এটি ইসলামের একটি কেন্দ্রবিন্দু, যার দিকে মুখ করে সারা দুনিয়ার মুসলমানেরা দৈনিক প্রার্থনা করে। আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশে^র বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমরা কোন কোন অব্যবহৃত গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিনে মসজিদ হিসাবে ব্যবহার করছে, যেখানে গির্জার মূল স্থাপত্যিক চরিত্র হুবহু আগের মতই থেকে যাচ্ছে। বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উদাহরণ এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে! 

ইসলামী শিল্পকলা বলতে শুধু মুসলমান রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত রাজধানীতে সৃষ্ট বস্তু বা স্থাপনা বুঝলে সুবিচার হবে না। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ এলাকা এখনো গ্রামাঞ্চল যেখানে সাধারণ কারিগররা হস্তশিল্পের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে, এবং এক অপূর্ব দক্ষতার সাথে সেগুলোতে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে, তা কাঠের কাজ হোক, যেমন: পালঙ্ক বা কুরআন রাখার রেহেল; কিংবা হোক সূচের কাজ, যেমন: বাংলার বিখ্যাত সুজনি কাঁথা। গ্রামসমাজের সাধারণ লোকদের সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ এসব কুটির শিল্পের অবদানও ইসলামী শিল্পকলার ঐতিহ্যে কোন অংশে কম নয়। মুসলিম গ্রামসমাজে নির্মিত স্থাপনায় প্রাকৃতিক নানা উপাদানের অলংকরণের ফলে এর এক নিজস্ব সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সাদাসিধা হলেও স্থানীয় মুসলিমদের জীবনের চাহিদা পূরণে এগুলো মোক্ষম কার্যকর। আমরা যখন প্রকৃতির কাছাকাছি বসবাসরত গ্রামসমাজের জনগোষ্ঠীর উপর জোর করে নগরায়ন চাপিয়ে দিতে চাই, তখন সবসময় সেটা তাদের জন্য মঙ্গলকর হয় না। গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন গ্রামসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরের সুউচ্চ কংক্রিটের বিল্ডিংয়ে বসবাস করতে শুরু করে, তখন তাদের উপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মুসলিম বিশ্বের অগ্রগতির প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষদের অংশীদার করার সময় সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুভূতি ও সংবেদনের সঠিক অনুধাবন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মুসলিম সমাজের জন্য ইসলাম শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কতগুলো আচার-অনুষ্ঠান বিধিনিষেধের ব্যাপার-স্যাপার নয় যা সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনের উপর কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেওয়া। বরং এটি জীবনের সৃষ্টিশীল গঠনে এক অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস রূপেও মানব সমাজে এক অসাধারণ অবদান রাখতে পারে, এমনটি মনে করার ও যথেষ্ট অবকাশ ও রয়েছে।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ