যুদ্ধ : সভ্যতার কল্যাণ ও অকল্যাণ
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
এক বছর অতিক্রান্ত হলেও রাশিয়া-ইউক্রন যুদ্ধ কোন পরিণতিতে পৌঁছতে পারেনি। সামরিক শক্তিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মনে করেছিল তারা অতি সহজেই দেশটিকে পরাভূত করতে পারবে। কিন্তু সে আশায় আপাতত গুঁড়ে বালি পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। শক্তির দিক থেকে অসম হলেও চলমান এই যুদ্ধ কিন্তু একতরফা হয়নি। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনতা রাশিয়াকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এমতাবস্থায় পরাক্রমশালী রাশিয়া ক্রমেই পশ্চাদপদ অনুসরণ করছে বলেই মনে হচ্ছে। যুদ্ধ যে কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয় তাও ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
মূলত, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর ১০ মাস পরও যুদ্ধে তেমন কোনো সামরিক সাফল্য দেখাতে পারেনি বরং যতই দিন যাচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি ততই তাদের প্রতিকূলেই চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘ পরিসরে যুদ্ধ চলায় রাশিয়ার জাতীয় অর্থনীতি ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। উপর্যুপরি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি রীতিমত লেজেগোবরে অবস্থার মধ্যেই পড়েছে। অবস্থা এমন সঙ্কটময় হয়ে পড়েছে যে, চলমান যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে আগামীতে তাদের যুদ্ধব্যয়ও নির্বাহও সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। ফলে দেশটিকে এখন আপোষরফার পথেই হাঁটতে হচ্ছে।
একথার প্রমাণ মিলেছে খোদ রুশ প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকেই। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি চান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। আর এ সমাধান চান তিনি কূটনৈতিক উপায়ে। সম্প্রতি শুক্রবার চীনের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এ তথ্য জানিয়েছে। বিষয়টিকে রুশ প্রেসিডেন্টের বিলম্বিত বোধদয় হিসাবেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল।
প্রতিবেদন অনুসারে, সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, রাশিয়া চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চায় এবং তা অবশ্যই কূটনৈতিক উপায়ে হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক সফরের সময় হোয়াইট হাউস বলেছিল, প্রেসিডেন্ট পুতিন সমঝোতা করতে ‘তেমন আগ্রহই দেখাচ্ছেন না’। এমনকি, ইউক্রেনে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট মোতায়েনের কথা বলা হলে পুতিন অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, প্যাট্রিয়টের ‘প্রতিষেধক’ আছে। এসবের একদিন পর, প্রেসিডেন্ট পুতিন যুদ্ধ বন্ধের আগ্রহের কথা জানালেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তিনি আন্তরিক, না এটি তার যুদ্ধ কৌশল এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা না গেলেও চলমান যুদ্ধ নিয়ে যে ক্রেমলিন খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই তা নিশ্চিত করে বলা যায়। যা তার বক্তব্য থেকেই অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট স্পষ্টতই বলেছেন, ‘যুদ্ধকে আরও বেগবান করা আমাদের লক্ষ্য নয় বরং আমরা যুদ্ধের অবসান চাই। আমরা এর পরিসমাপ্তি চাই। যত দ্রুত বন্ধ করা যাবে ততই মঙ্গল।’ সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি বহুবার বলেছি, শত্রুতা বাড়ালে তা ক্ষতিই ডেকে আনে। কমবেশি সব যুদ্ধই কূটনৈতিক উপায়ে শেষ হয়। যত দ্রুত সম্ভব আলোচনায় বসা উচিত। চুক্তি করা উচিত। যারা আমাদের বিরোধিতা করেন তাদের মধ্যে যত দ্রুত এই উপলব্ধি আসবে ততই মঙ্গল।’
প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাম্প্রতিক বক্তব্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কূটনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, তিনি এখন আপোষের পথেই হাঁটছেন। কারণ, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে তিনি যতটা দ্রুত সাফল্য আশা করেছিলেন, বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি বরং যুদ্ধে দেশটির অর্জন যৎসামান্যই। তাই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি সমঝোতার পথেই অগ্রসর হতে চাচ্ছেন।
কোন সামরিক অর্জনই দীর্ঘস্থায়ী হয় না বা সাফল্য বা শান্তি আনে না বরং এক অনাকাক্সিক্ষত তিক্ততাই সৃষ্টি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সে কথাটা আবারো দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর রুশ প্রেসিডেন্টের বিলম্বিত বোধদয় আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সহায়ক হবে।
মূলত, কোন যুদ্ধই সামরিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সঙ্গত কারণেই সকল যুদ্ধেই প্রচুর বেসামরিক লোকের হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। যেমনটি আমরা চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করছি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইতিমধ্যেই উভয় পক্ষের বিপুল সংখ্যক সৈন্যের প্রাণহানী ঘটেছে। ইউক্রেনের অনেক সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা মাটির সাথে মিশে দেয়া হয়েছে। এমনকি রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রেহাই পায় নি শিশু ও মাতৃসদনও।
বস্তুত, এই ভূম-লকে সৃষ্টিই করা হয়েছে সৃষ্টিকূলের অনুকূল ও বসবাসের উপযোগী করে। শুধু জীবের জীবন ধারণ নয় বরং জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে যা যা প্রয়োজন তার সব কিছুই আছে এই নশ্বর পৃথিবীতে। এই সৃষ্টিনিচয়কে যে সর্বাঙ্গ সুন্দর, সাবলীল ও অতিশয় সমৃদ্ধ করে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সার্থকভাবেই ফুটে উঠেছে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন-ধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ কবিতাংশে। যা সমঝদার কাব্য প্রেমিকদের মনে এক নির্মোহ আবেদন সৃষ্টি করে।
মানুষের কল্যাণেই সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। আর অনুসন্ধিৎসা ও নতুন কিছু করার ইচ্ছা মানুষের চিরন্তন। সে অনুসন্ধিৎসা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যও এসেছে। সে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালেই মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী ২০২৪ সালে তারা মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করতে সক্ষম হবেন। এমনকি পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহকে মনুষ্য বসতির জন্য উপযোগী করার চেষ্টাও করছেন তারা। কিন্তু নির্জীব চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহকে সজীব করার জন্য মানুষ যতটা তৎপর কিন্তু সুজলা ও সফলা বসুন্ধরার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে তারা ততটাই উদাসীন।
বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও মঙ্গল পৃষ্ঠকে জীবন ধারনের উপযোগী করার চেষ্টায় অঢেল অর্থও ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী নামক এই গ্রহটি যে ক্রমেই পরিবেশ বিপর্যয় ও সংঘাতের মুখোমুখি হয়ে ক্রমেই মনুষ্য বসতির অনুপযোগী হয়ে উঠছে তা নিয়ে সেভাবে ভাবা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global Warming) ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মনুষ্যসৃষ্ট দূষণকারী বস্তুর নিঃসরণ; বিশেষত সালফেট কণা শৈত্যয়ন ক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যা পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য ও জীব বৈচিত্রের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয় বরং উদ্বেগজনকও।
গ্রীন হাউস ইফেক্ট বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নই যে শুধু পৃথিবীর জীব বৈচিত্র ও সভ্যতার জন্য হুমকি এমন নয় বরং বিশ্বরাজনীতিতে সংঘাত ও শক্তির প্রতিযোগিতাও বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব পরাশক্তিগুলো এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বেশ পুলকবোধ করে। যুদ্ধ বা সমর বলতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর মধ্যে সুসংগঠিত এবং কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংঘর্ষকে বোঝানো হয়। চারিত্রিক দিক দিয়ে এটি প্রচণ্ড সহিংস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। তাই একটি শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন সেখানে বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর আরও অধুনিকায়নের লক্ষ্যে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে।
সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার রিপোর্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে উত্থান-পতন ও রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার পরও সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে দেশটি বিশ্বে তৃতীয় স্থান দখল করেছে। সামরিক ব্যয়ে সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র এবং এরপর চীন।
বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রতিরক্ষা খাতে তাদের ব্যয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াচ্ছে। যার সর্বশেষ পরিমাণ দাড়িয়েছে ৬৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এশীয় দেশ চীন সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতিরক্ষা খাতে দেশটি ২৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ইউরোপীয় দেশগুলো গত বছর সামরিক ব্যয় অনেক বাড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ন্যাটোভুক্ত অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, ফ্রান্স ও এস্তোনিয়ার সামরিক ব্যয় গত বছর আরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। আর ভারত সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধের ফল যে কখনো ভাল হয় না। অতীতে ফিরে তাকালেই তা ভালভাবেই উপলব্ধি করা যায়। যুদ্ধ শুধু মানুষের প্রাণহানীই ঘটায় না বরং মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করে। একই সাথে ব্যয় হয় প্রভূত অর্থের। যা শান্তির কাজে ব্যবহার হলে সভ্যতা আরও অনেক বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল। বিষয়টি আরও ভালভাবে উপলব্ধি করার জন্য অতীতের কিছু যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
১৯১৪-১৯১৮ সালে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ নিহত হন। ইউরোপ কেন্দ্রিক এই যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন প্রায় ৭ কোটি সেনা। এদের মধ্যে প্রায় এক কোটির মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
এ যুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে হয়েছে। এতে ৭ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছেন। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড দখল করেন। এর দুদিন পরেই ফ্রান্স এবং ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে তা বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়।
তাইপিং বিদ্রোহ
১৮৫১-১৮৬৪ সালে এ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে ২ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এটি চীনের সবচেয়ে বড় গৃহযুদ্ধ।
মোঙ্গল শাসনকাল
১২০৭-১৪৭২ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩ কোটি থেকে ৬ কোটি।
লুসান রেবেলিয়ন
১৭৫৫-১৭৬৩ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ। চীনে ট্যাঙ্গ এবং ইয়ান রাজবংশের মধ্যে সিংহাসন দখলের এই লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় দুই কোটি মানুষের।
কুইঙ্গ সম্রাজ্যের পতন
এ যুদ্ধ ১৬১৬-১৬৬২ সংগঠিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ২কোটি ৫০ লক্ষ। চীনের সর্বশেষ রাজবংশ হল কুইঙ্গ। মিঙ্গদের আক্রমণে এই রাজবংশের পতন হয়।
তৈমুর লং
১৩৬৯-১৪০৫ সালে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি।
দুনগান অভ্যূত্থান
১৮৬২-১৮৭৭ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ। চীনে দুনগান জাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল কুইঙ্গ রাজবংশের বিরুদ্ধে।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ
১৯১৭-১৯২১ সালে সংগঠিত যুদ্ধে ৫০ লক্ষ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। বলশেভিক পার্টির উদয় এবং ক্ষমতা দখলের সেই গৃহযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের।
নাপোলিওনিক যুদ্ধ
১৮০৩-১৮১৫ সালে সংগঠিত হওয়া এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৭০ লক্ষ। এক সঙ্গে একাধিক দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেই সময়ে। প্রায় বারো বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে চলা সেই যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের।
অতীতের কোন যুদ্ধই সভ্যতার জন্য সুখস্মৃতি বয়ে আনেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু হামলায় শুধুমাত্র হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক নিহত হন। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন।
অতীতে যুদ্ধ নিয়ে এমন দুঃসহ স্মৃতির পরও বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুদ্ধোম্মাদনা বন্ধ হয়নি। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেন যুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এই সবকিছুই বলে দেয় যে আগামী দিনে সশস্ত্র সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে প্রত্যেক দেশকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যে দেশগুলো ইতোমধ্যেই সামরিক শক্তিমত্তায় বলিষ্ঠ অবস্থানে পৌঁছেছে, তাদের মাঝেও এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য এখন বিশ্বের সবচেয়ে সঙ্কটময় অঞ্চলের একটি। সিরীয় যুদ্ধ এই সঙ্কটকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এই যুদ্ধের কারণে সংশ্লিষ্ট সব দেশকেই তাদের সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য করেছে। অর্থনীতিবিদ ন্যান তিয়ানের মতে, ‘ শুধুমাত্র ২০১৬ সালে সিরিয়া যুদ্ধে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে রাশিয়া।’ প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৫ সালে মোট বাজেটের ১৩ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে সৌদি আরব। ২০১৬ সালে এই ব্যয় ছিল ৯ শতাংশ। ইউরোপেও সামরিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্যেমতে, মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলো ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিরক্ষা গবেষক সিমন উইজম্যানের দেয়া তথ্যমতে, রাশিয়া ২৭ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর পর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোও অনেকটা একই কাজ করেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানব সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা সকল ক্ষেত্রেই মানব কল্যাণে ব্যবহার করা হয়নি। চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে প্রাণের স্ফুরণ ঘটানোর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহ ইতিবাচক। কিন্তু পৃথিবীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে সবার আগে। যখন এমন তাগিদই অনুভব করছেন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ তখন ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন পুরো বিশ^ পরিস্থিতিকে নতুন করে অস্থিতিশীল ও অশান্ত করে তুলেছে। তাই সভ্যতাকে শান্তিময় ও আর্তমানবতার কল্যাণে বিকশিত করতে অবিলম্বে সকল প্রকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। অন্যথায় সভ্যতা কখনোই বিশ্বশান্তির নিয়ামক হবে না বরং এক অনিবার্য পরিস্থিতি সভ্যতার পতন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠবে।