সিলেটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পাটা-পুতাইল

কবির আহমদ সিলেট থেকে: বাংলায় একটি প্রবাদ প্রবচন আছে, ঝি জব্দ কিলে, বৌ জব্দ শিলে, পাড়াপড়শী জব্দ চোখে আঙুল দিলে। আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ও ব্যবহারে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শিলপাটা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এটা ‘পাটা-পুতাইল’ নামে পরিচিত। একসময় মসলা বাটার একমাত্র সহজ উপায় ছিলো শিলপাটা। গ্রামীণ সমাজের প্রত্যেক ঘরে ঘরে শিলপাটা ছিল রান্নার মসলা বাটার অন্যতম পাথেয়। যদিও ডিজিটালের ছোঁয়ায় এখন মেশিনে তৈরি হয় হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, বাখর, গরম মসলা। আবার ব্লেন্ডার মেশিন দিয়ে পেয়াজ গোটা হয়। কিন্তু পাতা-পুতাইল এর মসলা আলাদাই স্বাদ। কিন্তু এখন পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় ভারতের মেশিনে কাটা শিলপাটা বাজার দখল করে নিয়েছে। তবে সিলেটের শিলপাটার মতো টেকসই না।
বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে হলুদ বাটো মেন্দি বাটো/বাটো ফুলের মউ,/বিয়ের সাঁজন সাঁজবে কন্যা... এইসব গীত গাওয়ার মাধ্যমে গ্রামের সকল শ্রেণী-পেশার মহিলারা বিয়ে বাড়িতে দু‘তিন দিন আগে থেকে হলুদ-মেন্দি বাটতেন। তাছাড়া সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভোজনবিলাসী গৃহিণীরা হরেক রকম স্বাদের মসলা বাটা করে দিতেন। কিন্তু কালের আবর্তে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, বাঙালীর সমাজ ব্যবস্থার পারিবারিক অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পাটা-পুতাইল এর ব্যবহার।
সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রকৃতি কন্যা জাফলং যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তেমনি এখানে রয়েছে খনিজসম্পদ পাথরেরও ভাণ্ডার। সেই পাথর কেটে রান্নায় রসদ জোগানো বিভিন্ন মসলা মিহি বা গুঁড়া করার জন্য অত্যন্ত নিখুতভাবে কারিগররা তৈরি করেন 'শিল-পাটা'। একসময় দেশের প্রত্যেকটি পরিবারে এ শিলপাটার ব্যবহার ছিল ব্যাপকভাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সিলেটের জাফলং এ আসা হাজার হাজার পর্যটক সিলেট থেকে চা-পাতার সাথে নিয়ে যেতেন পাটা-পুতাইল। কয়েকবছর আগেও জাফলং থেকে প্রচুর পাথর উত্তোলন হতো। কিন্তু এখন জাফলং থেকে পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ। তাই এই ব্যবসার সাথে জড়িতরা বড়ই কষ্টে দিন পার করছেন। তার মধ্যে ভরত থেকে ম্যাশিনে কাটা শিলপাটা দখল করেছে বাজার। কালের বিবর্তন ও আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদে ক্রমেই মানুষ হয়ে উঠেছে যন্ত্রমুখী। এ যুগে বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে সব ধরনের মসলা ভাঙানো বা গুঁড়া করা হয়, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে কমতে থাকে শিলপাটার ব্যবহার। প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়া শিলপাটার ব্যবহার এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। তবে মেশিন দিয়ে ভাঙানো পণ্যের চেয়ে পাটা দিয়ে তৈরি মসলার খাবার অনেক সুস^াদু বলে অনেকেই মনে করেন।
সিলেটের সারদাহল সংলগ্ন চাঁদনীঘাট এলাকায় এখনো কিছু শিলপাটার দোকান টিকে আছে। এখানে কারিগরদের নিপুণ কারিগরির মাধ্যমে তৈরি হয় আদি যুগের মসলা তৈরির যন্ত্র শিলপাটা। শিলপাটা তৈরির সময় সেগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা ধরনের নকশা। পর্যটন সিলেটের এসব শিলপাটা বিক্রির জন্য পরে চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিছুদিন আগেও প্রতিটি পাটা-পুতাইল ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকায় পাওয়া যেত। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং জাফলংয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধের কারনে পাটা-পুতাইল এর দাম বেড়েছে। এখন প্রতি সেট পাটা-পুতাইলের দাম ১৫০০ থেকে ৩০০০ পর্যন্ত।
শিলপাটা ব্যবসার সাথে জড়িত চাদনীঘাটের ব্যবসায়ী কালাম মিয়া জানান, আগে দেশের প্রত্যেকটি গ্রামের প্রত্যেক পরিবারেই পাটার ব্যবহার ছিল; কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেশিনে হলুদ, মরিচ ভাঙিয়ে মানুষ পাটা-পুতাইল থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জাফলংয়ে পাথর বিলুপ্ত হওয়ায় সিলেটে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ কমে গেছে পাটা-পুতাইল থেকে। কালের বিবর্তনে এখন আর পাটা আগের মতো চলে না। কালাম মিয়া আরও জানান, শিলপাটার ব্যবহার কমে যাওয়ায় অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা ধরেছেন। এরপরও কিছুকিছু ব্যবসায়ী সিলেটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে জাফলং অথবা সিলেটের সার্কিট হাউজ সংলগ্ন সুরমা নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী চাদনীঘাটে কোনোমতে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।