গায়েবি মামলা বাড়ছে দুই মাসে ১৫ হাজার নেতাকর্মীর আগাম জামিন
১৬৯ মামলায় ৬ হাজার ৭২৩ জনের তালিকা আইজিপির কাছে
নাছির উদ্দিন শোয়েব : বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত দুই মাসে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার গায়েবি মামলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দলটির নেতাদের দাবি-বিভাগীয় পর্যায় গণসমাবেশকে ঘিরে এসব মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা বহিনী। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশকে ঘিরে মামলা ও গ্রেফতার আরও বেড়েছে। এরই মধ্যে আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করছেন। গত দুই মাসে বিএনপির প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী জামিন নিয়েছেন। এরমধ্যে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সারা দেশে গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার এবং পুলিশের গুলীতে নেতাকর্মী নিহতের বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি। আইজিপির কাছে ১৬৯ মামলায় ৬ হাজার ৭২৩ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে।
গত ৩০ নবেম্বর আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে ভিড় করেন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মিথ্যা বানোয়াট ও গায়েবি মামলায় তাদের আসামী করে মামলার নামে হয়রানি করা হয়েছে। কারো কারো দাবি, যে মামলায় তাদের আসামী করা হয়েছে, সে মামলার সঙ্গে কোনোভাবেই তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না। শুধু প্রতিহিংসার জেরে তাদের মামলার আসামী করা হয়েছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী রোকনুজ্জামান সুজা বলেন, মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মামলায় ১৮৭ জনকে ও অজ্ঞাতনামা প্রায় ৫০০ জনকে আসামী করে একটি মামলা হয়েছে। সে মামলায় জামিনের জন্য আমরা আবেদন করেছি। এ প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত জানান, নাশকতার মতো গুরুতর অপরাধীদের আগাম জামিন দেয়া উচিত নয়। এমনকি আপিল বিভাগের যে নির্দেশনাগুলো রয়েছে, সেই আলোকে এ ধরনের মামলায় আগাম জামিনের কোনো সুযোগও নেই।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শাসকগোষ্ঠী বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও কারান্তরীণের পাশাপাশি বিরামহীন দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীমের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে পুলিশের অতর্কিত অভিযান ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ভোলার চরফ্যাশনে যুবদলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা ও শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করা, জামালপুর জেলাধীন মেলান্দহ পৌর বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম রেনু, আব্দুল আজিজ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মোঃ নবীনসহ ৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং নেত্রকোণা জেলাধীন পূর্বধলা উপজেলা বিএনপি নেতা আবু তাহের তালুকদার, শহীদুল্লাহ ইমরান, সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাবুল আলম তালুকদারসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২৫ জন নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা, মেহেরপুরে নেতাকর্মীদের নামে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়েরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও কারান্তরীণের পাশাপাশি বিরামহীন দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, ২৯ নভেম্বর সকাল ১০টায় ভোলার চরফ্যাশন সদর রোডে চরফ্যাশন উপজেলা যুবদল ও চরফ্যাশন পৌরসভা যুবদলের নব-নির্বাচিত আহ্বায়ক কমিটির শান্তিপূর্ণ মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলায় চরফ্যাশন উপজেলা যুবদলের সদ্য নবনির্বাচিত আহ্বায়ক শহীদুল আলম প্রিন্সসহ চরফ্যাশন উপজেলা যুবদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন এবং চরফ্যাশন উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরিফ ফরাজীসহ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। মেহেরপুর জেলা ও গাংনী উপজেলার বিএনপি নেতাসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ১১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫/২০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে নেতাকর্মীদের নামে বানোয়াট ও মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেফতার এবং নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অবৈধ সরকার দেশব্যাপী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে এসব ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা।
এদিকে ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঙ্গে দেখা করে ১৬৯টি ‘গায়েবী’ মামলার তালিকা দিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল আইজিপির দপ্তরে গিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি চিঠি পৌঁছে দেন, যেখানে এসব মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়। মহাসচিবের চিঠির সঙ্গে পুলিশ জানায়, ২২ অগাস্ট থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৯টি মামলার তালিকা দিয়েছে বিএনপির প্রতিনিধিদল। এসব মামলায় ৬ হাজার ৭২৩ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১৫ হাজার ৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৫৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে বিএনপির দাবি। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর প্রতিনিধি দলের নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশে যে গায়েবী মামলা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের লোকজন বোমা ফাটিয়ে আমাদের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে, গ্রেপ্তার করছে, এর একটি স্মারকলিপি মহাসচিবের তরফ থেকে আমরা আইজিপিকে প্রদান করেছি।
কয়েকটি মামলা: গত ২৮ নবেম্বর জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে বিএনপির ৩০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তাররা হলেন- জেলার মেলান্দহ পৌর বিএনপির সহসভাপতি আমিনুর রহমান রেনু (৫০), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ. আজিজ (৪৫), পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব ফাহাদুজ্জামান নবীন (৩২), যুবদল কর্মী ছামিউল ইসলাম (২৬) এবং ছামিদুল ইসলাম (৩৫)। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আতিকুল রহমান জানান, গোপন বৈঠকে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা চলছিল। এ সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় অধিকাংশরা পালিয়ে গেলেও ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় নাম উল্লেখ করে ৩০ জন ও অজ্ঞাত আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামী করে বিশেষ ক্ষমতার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। পাবনার সাতটি উপজেলা ও থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানে এক রাতে ১৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ২০টি ককটেল জব্দ করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় জেলা ও উপজেলা বিএনপির ৬০০ নেতা-কর্মীকে আসামী করে ৭টি মামলা করা হয়েছে।
২২ নবেম্বর রাতে ও পরদিন বিকেলে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। কোনো মামলায় পুলিশ আবার কোনো মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাদী হয়েছেন। তবে এসব মামলায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আর ককটেল বিস্ফোরণ, ককটেল উদ্ধার ও মামলাগুলোকে ‘সাজানো ও গায়েবি মামলা’ হিসেবে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, আগামী ৩ ডিসেম্বর বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ বানচালের ষড়যন্ত্রে এসব মামলা। অন্যদিকে বরিশালে বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে গৌরনদীতে হামলা-ভাঙচুরের মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন পেয়েছেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। ৩০ নবেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো.আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাককে প্রধান আসামী করে দলটির শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গত ৫ নভেম্বর মামলা করেন গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রাসেল রাঢ়ী। মামলার পরে গৌরনদী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হেলালউদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, পেনাল কোড ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় ইশরাক হোসেনকে প্রধান আসামী করা হয়েছে। এছাড়া গৌরনদী উপজেলার বিএনপি নেতা বদিউজ্জামান মিন্টু, সজল সরকার ও জাফরসহ নামধারী ৭০ জন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০/৬০ জনকে আসামী করা হয়েছে।