গণসমাবেশের স্থান নিয়ে আ’লীগের জেদাজেদিতে সংঘাতের আশংকা
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : বিএনপির ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ কোথায় হবে-তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একরকম অনিশ্চয়তা। ইতোমধ্যে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, তারা নয়াপল্টনেই গণসমাবেশ করবে। সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব বলেছেন, তারা নয়াপল্টনেই ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ করবেন। একইসাথে সরকারকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতেও অনুরোধ জানান তিনি। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিনিধি দলটি মামলা, গ্রেফতারসহ ঢাকার গণসমাবেশের স্থান নিয়েও আইজিপির সঙ্গে কথা বলেছে। তারা আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ করার অনুমতি দিতে আইজিপিকে অনুরোধ জানান। বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতারা বলেছেন, গত ৮ বিভাগীয় গণসমাবেশের সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়নি। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে, ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে বাধা দিয়ে গণসমাবেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা করেছে। তাই তারা নয়াপল্টনেই ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে চান এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান। জানা গেছে, বিএনপি যে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান হিসাবে নয়াপল্টনকে টার্গেট করেছে সেটি জানাতেই আইজিপির সাথে বৈঠক করেছে। একাধিক নেতা জানান, তারা নয়াপল্টন ঘিরেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যাপক লোকসমাগম জমায়েতের লক্ষে ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ১১ সাংগঠনিক জেলার নেতাদের সঙ্গে স্কাইপিতে বৈঠক করেছে দলটির হাইকমান্ড। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিয়েও প্রতিদিনই ধারাবাহিক বৈঠক চলছে। এসব বৈঠকে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এড়িয়ে ‘কৌশলে’ চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কোনো মশাল মিছিল না করাসহ বিশৃঙ্খলা এড়াতে সতর্ক থাকার জন্য ঢাকাসহ সব সাংগঠনিক জেলাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
সূত্র মতে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটি বৈঠকেও ঢাকার কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে পূর্বে ঘোষিত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নির্বাচন নিয়ে এই সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় নয়াপল্টনে গণসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করা হয়। সব দুরভিসন্ধি, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ঢাকায় গণসমাবেশকে সফল করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির ঢাকা বিভাগে ১১টি সাংগঠনিক জেলা হলো-ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ জেলা, নারায়ণগঞ্জ মহানগর, গাজীপুর জেলা, গাজীপুর মহানগর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদী। গণসমাবেশে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে-এমন অশঙ্কা থেকে ইতোমধ্যেই ঢাকায় অনেক নেতাকর্মী চলে এসেছেন বলে জানা গেছে। তারা আত্মীয়, বন্ধুসহ পরিচিতদের বাসায় উঠছেন। দূরের জেলা থেকে আসা নেতারা এখনই নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় করছেন। ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দূর থেকে আসা নেতাকর্মীদের জন্য ইতোমধ্যে থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব মহানগর নেতাদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই চলছে প্রস্তুতি সভা, মতবিনিময় ও ঘরোয়া বৈঠক। গত এক সপ্তাহ ধরে গুলশান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিভাগীয় সব জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। প্রায় প্রতিটি বৈঠকে স্কাইপিতে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ব্যবস্থাপনা, অভ্যর্থনা, প্রচারসহ গঠিত সাতটি উপকমিটির নেতারাও দফায় দফায় বৈঠক করছেন। সমাবেশকে ঘিরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয় এখন সরব হয়ে উঠেছে।
গণসমাবেশ সফলের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির দল নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ সফল করার জন্য নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। বিএনপি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গণসমাবেশ সফল করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশকে নিয়ে অবৈধ সরকার যেন বেসামাল হয়ে পড়েছে। শুরু করেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার, মিথ্যা কাহিনি সাজিয়ে পাইকারি হারে মামলা, গভীর রাতে নেতাকর্মীদের বাড়িতে ডাকাতের মতো হানা দিচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার চরম মাত্রায় শুরু করেছে আওয়ামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মনে হয় পুলিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শপথ গ্রহণ করেছে যেভাবেই হোক ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে হবে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাসহ ঢাকা মহানগর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই সরকার জনআতঙ্কে ভুগছে। তাই ঢাকায় গণসমাবেশের কথা শুনেই দিশেহারা হয়ে দমনের নিষ্ঠুর পথ অবলম্বন করেছেন।
এদিকে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশসহ কয়েকটি ইস্যুতে সারা দেশে ধরপাকড় চলছে। এ অভিযানে সরকারের অবস্থান হার্ডলাইনে। এ বিষয়ে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, বড় উৎসব-অনুষ্ঠান হলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করি। ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান ছাড়াও এই মাসে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট আছে।এসব অনুষ্ঠান ঘিরে আমরা প্রতি বছরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাই। আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজনৈতিক সমাবেশ ঘিরে কেউ যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সেজন্য আগাম তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে।
গণসমাবেশ করার বিষয়ে স্থান ইস্যুতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন মুখোমুখি অবস্থানে। অনেক আগে থেকেই চলছে নেতাদের বাকযুদ্ধ। ক্ষমতাসীন দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতির পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন। অপরদিকে সুশৃঙ্খলভাবে গণসমাবেশ করতে নয়াপল্টনকে নিরাপদ মনে করছে বিএনপি। এজন্য তারা সেখানে সমাবেশ করার বিষয়ে ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশকে খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে বিষয়টি সমাধান করা উচিত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অন্যথায় যে কোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এতে কোনো পক্ষই লাভবান হবে না। দেশ বড়ম ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন তারা।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। না হলে কেন নয়াপল্টনের পার্টি অফিসের সামনে ছোট এলাকা সমাবেশের জন্য বেছে নিল? পার্টি অফিসে সমাবেশ করার জন্য বিএনপির এত দৃঢ়তা কেন? এখানে তাদের কি কোনো বদ উদ্দেশ্য আছে?
অপরদিকে নয়াপল্টনে এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঢাকার গণসমাবেশ নয়াপল্টনেই হবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে হবে। তিনি সরকারকে সংঘাতের পথে না গিয়ে সিদ্ধান্ত বদল করারও আহ্বান জানান। দলটির নেতারা মনে করছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগের মতো খোলামেলা নেই। চারদিকে দেওয়ালবেষ্টিত উদ্যানে প্রচুর গাছপালা। বসার জায়গাও তুলনামূলকভাবে কম, ঢোকার ফটকগুলো ছোট। ফলে বড় আকারের সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢুকতে এবং বের হতে বেশ কষ্ট হয়। তাছাড়া বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল ফটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকেন। অতীতে সেখানে সমাবেশ শেষে বের হয়ে ফেরার পথে অনেক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া সমাবেশ ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রলীগের হামলার আশঙ্কাও করছেন তারা।
স্থান নিয়ে দুদলের টানাটানিতে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর মতে, সংঘাত করে শেষ পর্যন্ত কেউ লাভবান হয় না। যে পক্ষই করুক। যানজট ও নাগরিক দুর্ভোগের প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু এ যানজট তো রাজধানীতে প্রতিদিনের চিত্র। কোনো মিছিল-সভা না থাকলেও ঢাকা শহরে যানজট থাকে। ক্ষমতাসীন দলের সভা-সমাবেশ করতে গেলে তো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। বিএনপির আবেদন মেনে নিলে এই সরকার ক্ষমতা হারাবে-এ রকম তো কোনো ব্যাপার ঘটবে না। তাহলে এই জেদাজেদি করার কি দরকার। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে নয়াপল্টনে সভা করে অভ্যস্ত। সেখানে শৃঙ্খলা ভঙ্গের তো কোনো কারণ নেই। সরকার একটা সমঝোতা করে বিএনপিকে অনুমতি দিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।