জন্মনিবন্ধনে ভোগান্তি
মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন
জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র একটি সরকারি বিবৃতি যা জন্মের তারিখ, জন্মের স্থান, লিঙ্গ এবং নবাগত শিশুর নাম নিশ্চিত করে। প্রতিটি শিশু জন্মের পর পরই তার মৌলিক অধিকারের সৃষ্টি হয়। আর এ অধিকারের অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার হচ্ছে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার অধিকার। এটি কারও করুণার বিষয় নয়! শিশু জন্মের পর পরই তার জন্ম নিবন্ধন করা প্রয়োজন। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসারে শিশু জন্মগ্রহণের পর জন্ম নিবন্ধীকরণের কথা বলা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিশু জন্মের পর পরই নিবন্ধন করা হয়। আমাদের দেশেও প্রতিটি শিশু জন্মের পর পরই বাধ্যতামূলক জন্ম নিবন্ধনের কথা বলা আছে। কিন্তু কার্যকরী উদ্যোগ না থাকায় জন্মনিবন্ধনে ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। জন্মনিবন্ধন প্রতিটি মানুষের আইনি অস্তিত্ব প্রমাণ করে এবং তারা যে এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত তাও প্রমাণ করে। জন্ম নিবন্ধন না করলে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যেমন স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, তেমনিভাবে মর্যাদাও পাওয়া যায় না। আইনগত সমস্যার সমাধানও করা যায় না। বর্তমানে এই সনদ ব্যতিত সরকারি কোন সেবা পাওয়া যায় না।
২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হলেও কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। স্কুলের ভর্তি থেকে শুরু করে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোবাইলের সিম, পাসপোর্ট, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ব্যাংকে হিসাব খোলা, জমি রেজিস্ট্রেশন, করোনার টিকা, বিবাহ রেজিস্ট্রেশনে জন্মনিবন্ধন সনদ খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এই সনদ পাওয়ার জন্য রীতিমত ভোগান্তির শিকার হতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে জন্মের প্রথম দিনই নবাগত শিশুর জন্মনিবন্ধন সম্পূর্ণ করে ফেলে। অথচ আমরা এখানো তা করতে পারিনি। যতটুকু জাতীয়পরিচয় পত্র ডিজিটাল হয়েছে তার মধ্যে আবার ভুলের ছড়াছড়ি। যেমন কারও বাবার নামে ভুল, কারও মায়ের নামে ভুল, কারো নিজ নামে ভুল, কারো বয়সে ভুল। এসব ভুল সংশোধনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সংশোধন করতে গেলে পায়ের স্যান্ডেল খয় হয়ে যায়। সংশোধন হয় না। জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে এত হয়রানি ও গড়িমসি কেন তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি নির্ধারিত ফি থেকেও কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। ডিজিটাল সেবার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ভোগান্তি দূর করা। কিন্তু ভোগান্তি আরও বাড়ছে।
জন্ম সনদ একটি শিশুর অধিকার ও রক্ষাকবচ। একজন নাগরিকের জাতীয়তা, বয়স, নামকরণ, স্থায়ী ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম ইত্যাদি মৌলিক বিষয় প্রমাণের জন্য জন্ম সনদের ভূমিকা অপরিসীম। মহান জাতীয় সংসদে পাস হওয়া জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী জাতি ধর্ম, বর্ণ গোষ্ঠী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও গ্রাম গঞ্জে এখনও অনেক শিশুর নিবন্ধন সঠিক সময়ে করা হয় না। ফলে স্কুলের শিক্ষক কিংবা পাড়ার বড় ভাই; বয়স কখনো কমিয়ে কখনো বাড়িয়ে নিবন্ধন করে দেয়। এতে করে বিপত্তি দেখা দেয়। অনেকে জন্মনিবন্ধন সনদ আনতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। আমার পরিচিত একজন রাজধানীর গেন্ডারিয়াতে বসবাস করেন। ওই ভদ্রলোকের দুই সন্তান। কিছুদিন আগে ছোট সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়েন। স্থানীয় জন্মনিবন্ধন কার্যালয়ে গেলে বলা হয় আপনার গ্রামের বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের জন্মসনদ লাগবে। অথচ ওই ভদ্রলোক প্রায় ৩০ বছর আগে থেকেই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেন। তারপর বললেন-বাড়ির বিদ্যুৎ মিটার বিল লাগবে, জমির দলিল লাগবে, পর্চা লাগবে, স্বামী স্ত্রীর ভোটার আইডি কার্ড লাগবে। অথচ ভোটার আইডি কাড দিয়ে সবকিছু করা যায়। অহেতুক কেন এই হয়রানি তা বোধগম্য নয়। এ যেন কাব্য রচনার মতো প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ এখন নিজের বা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার। ভোগান্তির কথা মনে হলে মনে হয় জন্মের চেয়ে নিবন্ধনই কঠিন। নাগরিকসেবা পাওয়ার জন্যে জন্মসনদ ও মৃত্যুসনদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ কারণে দুটি সনদ পেতে সবাই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশন অফিসে ছুটছেন। কিন্তু সনদ পাচ্ছেন না। পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। জন্মসনদের ঝামেলা দেখে মনে হয় জন্মই যেন আজন্ম পাপ।
জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আরো সহজ করা প্রয়োজন। যেন গ্রামের সহজ সরল ও নিরক্ষর মানুষ অনায়াসে তা পায়। জাতীয় পরিচয়পত্র কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছে। অথচ ক্রুটিমুক্ত আমরা করতে পারিনি। ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে। এই দুটো সনদ ছাড়া যেহেতু কোনো সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় না তাই অনতিবিলম্বে সারাদেশে ওয়ার্ডভিত্তিক জনবল নিয়োগ দিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর সব তথ্য জন্মনিবন্ধন নথিভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে জনগণের দুর্ভোগ কমবে। পাশাপাশি বয়স হেরফেরের ঘটনাও কমবে। আমরা কাগজে কলমে ডিজিটাল। বাস্তবে এখনো অ্যানালগ রয়ে গেছি। তা না হলে জন্মসনদের জন্য এত ভোগান্তি হবে কেন? শহরের প্রায় সব বাচ্চার জন্ম হয় হাসপাতালে।
জন্মের পর পরই হাসপাতাল থেকে জন্মের সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। হাসপাতাল যখন সার্টিফিকেট দেয় তখন যদি নিবন্ধনের জন্য যে যে এলাকার বাসিন্দা সে এলাকার ইউনিয়ন কিংবা পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের ঠিকানায় তথ্যটি পূরণ করে পাঠিয়ে দেয় তাহলে নতুন করে আর জন্মনিবন্ধন করা প্রয়োজন হতো না। সেখানে নামের সংশোধন করার সুযোগ দিলে যে কেউ নিজে নিজে সংশোধন করতে পারবে। হাসপাতাল থেকে তথ্য যাবে সিটি করপোরেশনে। তারা অভিনন্দন বার্তাসহ একটি জন্মনিবন্ধন নম্বর ওই মা-বাবার কাছে পাঠাবে। অনেকে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন কার্যালয়ে গিয়ে সেবা পাওয়া তো দূরের কথা! সঠিক নির্দেশনাটুক মানুষ পাচ্ছে না। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বৃটিশ ও নাই, পাকিস্তানও নাই। তাহলে কেন নিজ ভূমিতে নিজের অধিকার পেতে ভোগান্তির শিকার হতে হবে? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগী ভূমিকা পালন করলে জন্মনিবন্ধনের জটিলতার অবসান হতে পারে।