সোমবার ১৩ জানুয়ারি ২০২৫
Online Edition

কুরআনের ডাক ও শায়খুল হিন্দ (রহ)

।। হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ ।। শায়খুল হিন্দ হযরত মওলানা মাহমুদুল হাসান গেলো শতকের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সিপাহসালার, বড় মাপের আলেমে দ্বীন ও ঐতিহ্যবাহী দেওবন্দ মাদরাসার প্রথম ছাত্র। তাঁকে দিয়েই ছাত্তা মসজিদে দেওবন্দ মাদরাসার ক্লাস শুরু হয়। তিনি কুরআন কারীমের সফল অনুবাদক ও তাফসীরকার হিসেবে গোটা জীবনটাই কুরআন এবং কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত করছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ বুজুর্গ আলেম শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসানকে ইংরেজরা গ্রেফতার করে মাল্টায় পাঠিয়ে দেয়। মাল্টার কারাগারে বসেই ওস্তাদ মাহমুদুল হাসান কুরআনের অনুবাদে তাফসীরের কাজ শুরু করেন। সূরা আল মায়েদা পর্যন্ত আসার পর কুরআনের মালিক তাঁকে আর এ সুযোগ দেননি। তাঁর রেখে যাওয়া কাজটাই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাববীর আহমদ ওসমানী সম্পন্ন করেন, এটাই আমাদের দেশে ‘তাফসীরে ওসমানী' নামে পরিচিত। মাল্টার কারাগারে ইংরেজদের অত্যাচারে শায়খুল হিন্দ এক সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইংরেজরা ভাবলো, মাল্টার কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় যদি তিনি মারা যান তাহলে সারা ভারতে আগুন জ্বলবে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ইংরেজরা অবশেষে তাকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তি পেয়ে শায়খুল হিন্দ তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান দেওবন্দে ফিরে এলেন। দেওবন্দে এসে তিনি ভারতের সব কয়টি মত ও পথের আলেম-উলামাদের এক সমাবেশের আয়োজন করেন। সম্মেলনে ভারতের সর্বমতের উলামা-মাশায়েখ পীর-বুজুর্গরা তাতে উপস্থিত ছিলেন। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা শাববীর আহমদ ওসমানী, মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রাহিমাহুমুল্লাহ)সহ আলেম-উলামারা শায়খুল হিন্দের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য সে মজলিসে এসে হাজির হন। শায়খুল হিন্দ তাঁর স্বভাবগত ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে নবীর উত্তরাধিকারী উলামায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি আমার কয়েক বছরের মাল্টার বন্দী জীবনে আমাদের বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি। চিন্তা-ভাবনার পর আমি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। সে সিদ্ধান্তের কথা বলার জন্যেই আজ আমি এখানে আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। উলামায়ে কেরাম সবাই সে কথা শোনার জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালো। তিনি বললেন, আমাদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য আমি দু'টো জিনিসকে দায়ী মনে করি। একটি হচ্ছে, কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আমাদের মধ্যকার ঐক্য বিনষ্ট হয়ে গেছে। এ দুটো দুর্বলতা থেকে বাঁচতে পারলে আমরা পুনরায় ভারতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম মাওলানা শফি (রহ) এই অনুষ্ঠানে তখন ছাত্র হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর ‘ওয়াহদাতে উম্মত' বইতে এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, শায়খুল হিন্দ যে দু'টো কারণের কথা বলছেন, আসলে তা একটিই কুরআনের সাথে সম্পর্ক দুর্বল হওয়ার কারণেই আমাদের মাঝে অনৈক্যের ফেৎনা সৃষ্টি হয়েছে। শায়খুল হিন্দ ওস্তাদ মাহমুদুল হাসান কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কের যে অবনতির কথা বলেছেন-তা কি ছিলো? তিনি কি কুরআন তেলাওয়াতের কথা বলেছেন- না মনোযোগ দিয়ে তা শোনার কথা বলেছেন? কেননা তদানীন্তন ভারতবর্ষে কুরআনের সুললিত তেলাওয়াতের কোনো অভাব ছিলো না। দেশের হাজার হাজার মসজিদ, মক্তব, মাদরাসায় কুরআনের সুন্দর তেলাওয়াতের শানদার ব্যবস্থা ছিলো। স্বয়ং শায়খুল হিন্দের কুরআনের তেলাওয়াতের প্রতি গভীর আগ্রহ ও মমত্ববোধের বিষয়টি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মাল্টার জেলে তাকে যেদিন প্রথম নেয়া হলো তখন রোযা শুরু হতে একদিন বাকি। জেলের সাথী মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীকে ডেকে তিনি আক্ষেপ করে বললেন, আমার জীবনের সম্ভবত এটাই হবে প্রথম রমযান, যখন তারাবীতে আমি কুরআন শুনতে পারবো না। শায়খুল হিন্দ নিজে কুরআনের হাফেজ ছিলেন না। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীও হাফেজ ছিলেন না, কিন্তু ওস্তাদের আক্ষেপ যেন তাঁকে নতুন এক প্রেরণায় উজ্জীবিত করে দিলো। রোযা শুরু হলে তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১ পারা মুখস্থ করে তারাবীতে শায়খকে শোনাতেন। এভাবে রোযার মাস শেষ হতে হতে শায়খের পুরো কুরআন শোনার আরজু যেমন পূর্ণ হলো, মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীরও পুরো কুরআন মুখস্থ হয়ে গেলো। কুরআনের প্রতি যার অন্তরের এ অবিশ্বাস্য সম্পর্ক তিনি শুধু তেলাওয়াতের দুর্বলতাকেই জাতির অবনতির মৌলিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবেন, তেমনটি তো হতে পারে না। শায়খুল হিন্দ এখানে যে কথা বলেছেন তা অবশ্যই আরও মৌলিক। আমাদের সময়ে এ কথা আরও অনেকেই বলেছেন। মুসলিম মিল্লাতের প্রাণপুরুষ আল্লামা ইকবাল কতো সুন্দর করেই না এ কথাগুলো বলেছেন। ইকবালের কথাগুলোকে যদি আমরা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বর্ণিত সেই হাদীসের সাথে মিলিয়ে পড়ি তাহলে মনে হবে, ইকবাল মূলত তাঁর লেখায় সেই হাদীসের ব্যাখ্যাই করেছেন মাত্র। হাদীসটিতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআন হচ্ছে এমন এক গ্রন্থ, যা জাতিসমূহকে যেমন অধঃপতনের নিম্নভূমি থেকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়, তেমনি এ মহান গ্রন্থের সাথে ভিন্ন আচরণের কারণে জাতিসমূহ আবার উন্নতির শীর্ষদেশ থেকে অবনতির নিম্নতম স্থানেও পৌঁছে যায়। আমি হাদীসটির হুবহু শাব্দিক অনুবাদ না করে ভাবার্থটাই শুধু এখানে পেশ করলাম। প্রিয়নবীর হাদীস ও সমকালীন ২ জন উচ্চমানের চিন্তাবিদের সুরে আমরাও বলতে চাই, জাতি হিসেবে আজ আমাদের অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে, কুরআনের সাথে আমাদের চরম উন্নাসিক আচরণ। কুরআন মাজীদে সম্ভবত এমন একটি জাতির চরিত্রই আল্লাহ তায়ালা এঁকেছেন সূরা আন নামলের ৩০তম আয়াতে। আল্লাহর নবী (আল্লাহর দরবারে) ফরিয়াদ জানিয়ে বলবেন, হে আমার রব, আমার জাতি এ কুরআনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছিল। আসলে আল্লাহর কিতাবের সাথে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের আচরণের প্রশ্নে আহলে কিতাব ও একশ্রেণীর মুসলমানদের মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই। কোনো জাতির কাছে যখন আল্লাহর কোনো কিতাব মওজুদ থাকে, তখন সে জাতির এ দুনিয়ায় বাঁচা মরা, আয় উন্নতি সকল কিছুর সম্পর্ক সে কিতাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। কুরআন কারীমে সূরা আল-মায়েদার ৬৬তম আয়াতের দিকে একবার লক্ষ্য করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-যদি তারা (আল্লাহর যমীনে) তাওরাত ও ইনজীল এবং যা তাদের মালিকের কাছ থেকে তাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করতো, তাহলে তারা তাদের মাথার ওপর (আসমান) থেকে ও তাদের পায়ের নীচ (যমীন) থেকে পাওয়া রিযিক ভোগ করতে পেতো; তাদের মধ্যে অবশ্য একদল ন্যায় ও মধ্যপন্থি লোক রয়েছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই হচ্ছে এমন, যাদের কর্মকান্ড খুবই নিকৃষ্ট। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্টের অনুসারী ইহুদী খৃস্টানরা তাদের কাছে মজুদ আল্লাহর কিতাবকে কখনো প্রতিষ্ঠা করেনি, সুতরাং আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা মতো তারা কল্যাণও সেভাবে লাভ করতে পারেনি। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান তাঁর বাকি জীবনে সমগ্র হিন্দুস্তানে কুরআনের পক্ষে দু'টো বড় কাজ যেমন নিজে করেছেন, তেমনি অন্যদের তা করতে বলেছেন। তাঁর যুগান্তকারী এ কাজ দু'টো ছিলো দেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে, অলিত-গলিতে কুরআন পড়ার ক্লাস এবং সর্বত্র কুরআনের দারস চালু করা। শায়খুল হিন্দের ভাষায় এর প্রথমটি ছিলো নাযেরা কুরআন ও দ্বিতীয়টি ছিলো আওয়ামী দারসে কুরআন। এ দু'টো কর্মসূচি কিভাবে গোটা হিন্দুস্তানে দীর্ঘদিন ধরে কুরআনের শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং এ কুরআনের শিক্ষা কিভাবে ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল্যবান অবদান যুগিয়েছে, ভারতীয় মুসলমানদের পরবর্তী সময়গুলোর ঘটনাপ্রবাহই আমাদের সে কথা বলে দেবে। জাতির জীবনে হাজার সমস্যা, হাজার জঞ্জাল থাকতে শায়খুল হিন্দ তৎকালীন ভারতের আলেমদের কেন কুরআন নিয়ে পড়ে থাকতে বললেন? তিনি নিজেই বা কেন কুরআন পড়া ও সাধারণ্যে কুরআন বুঝানোর কাজে সবাইকে আত্মনিয়োগ করার উদ্বাত্ত আহবান জানালেন, এ কথাটার কিন্তু এখনো জবাব দেয়া হয়নি। হ্যাঁ, এ কথার ওপর কিছু আলোকপাতের পরেই পরবর্তী বিষয় আলোচনার প্রয়াস পাবো। লেখক : আল কুরআন একাডেমী লন্ডনের ডাইরেক্টর জেনারেল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ

string(11) "18.97.14.89"