জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান
প্রায় প্রতিদিন যাচ্ছি স্কুলে। একই রাস্তা একই বাহন। সদরঘাট ইসলামপুর মোগলটুলি মিটফোর্ট, তারপর চকবাজার। আমার যাত্রার ইতি। এরপর কোনো দিন উর্দুরোড, কোনো দিন জেলখানার গেইট বরাবর। হাঁটতে হাঁটতে নবকুমার উমেশদত্ত লেন। স্কুল যেনো আনন্দের কারখানা। এরই মধ্যে মাস ছয়েক পার। আহম্মদ স্যার আমাদের ক্লাস টিচার। বাংলা পড়ান। খুবই অমায়িক। ভদ্রতো বটেই। আমরাও খুব খুশি। পড়ান মজা করে। তারপর তাহের স্যার। ইংরেজির শিক্ষক। বেশ কড়া মেজাজ। তিনি ক্লাসে ঢুকলে সবার ঠোঁটে আঙুল। একজন দু’জন করে বাড়ছে ছাত্র। নতুন নাম নতুন চেহারা। রাজা স্কুলেও তেমন দেখেছি। নবকুমারে ইয়ার দোস্তে জমজমাট। হালিম আর মুহিবুরের সাথে ভাব হয়ে গেলো। একরকম গলায় গলায়। তিনজনেই একসাথে হাঁটাহাঁটি, মাতামাতি। ফেরিওয়ালাদের জটলা স্কুল গেইটে। আচার, আইসক্রিম, কোনো দিন চানাচুর-ঘুমনি খাই তিনজনে। এটি রোজকার রুটিন। সড়কের অন্যপারে মাঠ। টিফিনে এই মাঠেই খেলা, এই মাঠেই মেলা। আসলে এই মাঠ কিন্তু নবকুমারের নয়। আলীয়া মাদরাসা এই মাঠের মালিক। আমাদের দাপটে ওরা মাঠ ছাড়া। দেয়াল ভাঙা স্কুল বরাবর। এই ভাঙা দিয়েই আমরা ঢুকি মাঠে। অবস্থা দেখে মনে হবে এটি নবকুমার স্কুলের মাঠ। নবকুমারের তো কোনো জায়গাই নেই। যা-ও আছে স্কুলের সামনে, কাঠা দু’এক হবে। সেখানে তো আর খেলার সুযোগ নাই। তাই আলীয়া মাদরাসার মাঠই ভরসা। তবে মাঠ জটিলতা, ঠুকাঠুকি চালুই থাকতো। কখনো আপোসে কখনো ইট-পাটকেল। দেওয়াল মেরামত করলেও আমাদের কেরামতিতে পরদিন আবার উধাও। জোট বেঁধে হাঁটি। আমরা তিনজন। মাঠ পার হলে বড় সড়ক। মেডিকেল হোস্টেল বরাবর। মাদরাসা লাগোয়া দু’তিনটি হোটেল। ইডেন হোটেল নামে একটি বড় হোটেল। মেডিকেল ছাত্ররা এখানে চা-নাস্তা করে। আমরাও মাঝেমধ্যে ঢুঁ দেই। এ সড়কটি সুনসান। বড় বড় কড়ই গাছ। বিশাল বিশাল। তাই ছায়া ছায়া। অনেকগুলো খাম্বা স্তূপ করে রাখা। রাস্তার বামপাশে। মাঠের দেয়াল ঘেঁষে। আমরা সেখানে বসে আড্ডা দেই, প্রায় দিন। ঝিরঝিরে বাতাস, ঝুরঝুর ঝরে হলুদ পাতা। পাতার ফাঁক-ফকোর দিয়ে রোদের কণা টুপটাপ। বাতাস আর রোদের মাখামাখি। এক অন্যরকম আরাম। ইলিয়াসের ঘণ্টা কানে বাজতেই ভাঙে আড্ডা। এক দৌড়ে স্কুল। টিফিনের পর ক্লাশগুলো কেমন ভিজা ভিজা। নরম নরম। তখন শুধু ঘরে ফেরার চিন্তা। উথাল পাতাল করে মগজ। আসেন অংক স্যার। আমরা ডাকি গিয়াস স্যার। মিঠাকড়া মেজাজ। আমার জন্য জ¦ালাতন। স্যার যখন অংক ভাজেন, নজরে ফরফর করে শত শত মশা। অংক এক যম। দাঁত মুখ ক্যালিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। ভয়েরা ঢুশ দেয়। দুয়ে দুয়ে চার না ছয়, বলতে গিয়ে ঠোঁট কাঁপে। অংকের ধারাপাত কেবল উড়ে। হাত বাড়ালেও ধরা দেয় না। টেনেটুনে পাশ। না হয় অংকে রসগোল্লা। তাই ক্লাসে ঠোঁটে ঠোঁট কপাটি। বলতে গেলে অংকে লবডংকা। অপেক্ষায় থাকি ইলিয়াসের ঘণ্টার। ঘণ্টা বাজলেই খুশির ভূষি ঝুরঝুর। এরপর আর দুই ক্লাশ। তারপর ঢংঢং। ছুটিতেও একটা ভিন্নধাচের আনন্দ। স্কুল জুড়ে খুশির বাজনা। এমন বাজনা বাজে হররোজ। দলে দলে পথে নামি। কোনোদল উত্তরে, কোনো দল দক্ষিণে। পুব-পশ্চিমে বাড়িঘর। ঘরে ফিরতে ফিরতে আছর পার। বিকালটা কানামাছি ভিক্টোরিয়া পার্কে। পার্ক বলতে ছোট খাটো মাঠ। বেশ কটা গাছ আছে এ কোনা সে কোণায়। মাঠের পশ্চিমধারে বুক সমান দেয়াল। পূবে কতকটা ভাংগা। কতকটা কাটা তারের বেড়া। উত্তরে তৈরি হচ্ছে সৌধ। তৈরি প্রায় শেষের দিক। মেঝেতে বসানো হচ্ছে সাদা পাথর। সে পাথর ঘষামাজাতে দশ বারজন লোক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব দেখি। রোজ। মাগরিবের আজান পর্যন্ত চলে দেখা আর খেলা। ইংলেন্ডের রাণী ভিক্টোরিয়া নাকি একবার সভা করেছিলেন এখানে। গাছতলায়। এ কারণে মাঠের নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। রাণীর নামেই হোক রাজার নামেই হোক। নামে কিন্তু সে রকম সুগন্ধি উড়ে না। কোন কালে হয়তো উড়তো। ঠাঁটবাট ছিলো চেহারা সুরতে। ইদানিং জংগল জংগল। পাতাঝরা উড়নচণ্ডি। (চলবে)