সাহিত্যে নৈতিকতা

আহমদ মনসুর
দুই.
কাব্যরচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আচার্য মন্মটভট্ট লিখেছেন, “কাব্য রচিত হয় যশের জন্য, অর্থের জন্য, লোক- ব্যবহার শিক্ষার (পরিজ্ঞান) জন্যে, অকল্যাণ বিনাশের জন্যে, পরম আনন্দ লাভের হেতু এবং কান্তা-সম্মিত উপদেশ প্রয়োগ নিমিত্ত।” আবার দ্বাদশ শতকের খ্যাতিমান কাব্যতাত্ত্বিক হেমচন্দ্র বলেন, “কাব্যমান্দার যশসে কান্তা তুল্যোপদেশায়” -অর্থাৎ কাব্য রচিত হয় আনন্দের জন্য যশের কারণে এবং কান্তা তুল্য উপদেশ লাভের নিমিত্তে।”
এভাবে ভারতীয় কাব্যতত্ত্বে নৈতিকতা গুণের আবেশ লক্ষ্য করা যায় না। অবার পশ্চিমা সাহিত্যসেবীদের অনেকে কলা-কৈবল্যবাদের দোহাই পেড়ে সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার বিচরণ দেখতে রাজি নন। কিন্তু যেহেতু মানুষের জীবনে সাহিত্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাই “ শিল্পদর্শন ধর্ম প্রভৃতি সমস্তই অধুনা ক্রমশ মিলিবার পথে চলিয়াছে এবং এ সকল ভিন্ন ভিন্ন সাধনার সমন্বয় করাই যে পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ হইয়া উঠিতেছে, ইউরোপীয় কোন ভাবুকের লেখায় আজকাল এমনতর আভাস পাওয়া যায়। তাহার কারণ এই যে, খুব সম্প্রতি ইউরোপীয় মন বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছে যে বৈচিত্রকে সাজালেই তাহাকে মেলানো হয় না- তাহাতে বৈচিত্রের ভেদচিহ্নগুলি সমানই থাকিয়া যায়। একমাত্র আধ্যাত্মিকের অখ- বোধের মধ্যেই সমস্ত ভেদের বিলোপ এবং সমস্ত বৈচিত্রের মিলন ঘটিতে পারে।.. .. আর্টের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি যদি আধ্যাত্মিক জীবনে না হয় তবে মাঝখানের অভিব্যক্তিটাই আমরা দেখতে পাই খুব জাঁকালো রকমÑতখন এমন একটা নদীর দীর্ঘ বিচিত্র ধারা আমরা দেখি যাহার কোন শান্তিÑসমুদ্রের মধ্যে অবসান ঘটে নাই, হঠাৎ এক যায়গায় যাহার ধারা বালু মরুর মধ্যে শোষিত হইয়া গিয়াছে।
সুতরাং আর্টের ভিতর হইতে মানব জীবনের পরিপূর্ণতার আদর্শ দেখিতে পাইলেও এ ভুল যেন না করি যে, ইহাই পর্যাপ্তÑধর্মের আর কোন প্রয়োজন নাই, সে ‘ ডগমা’ অথবা শুষ্ক মত মাত্র। ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, অনুভূতি এবং প্রকাশ এক জিনিস এবং জীবন অন্য জিনিস। আর্টের প্রকাশও এক জায়গায় থামিয়া নাইÑজীবনের গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে সেও বিচিত্র হইয়াই চলে। আর্টের স্বাভাবিক পরিণাম আধ্যাত্মিকতা ছাড়া হইতে পারে নাÑ নদীর যেমন স্বাভাবিক অবসান সমুদ্রে।’(৫)
কাব্যে নৈতিকতার জোর দিয়ে শেলী বলেছেন, “কোনো প্রকার নির্দিষ্ট নৈতিকতার সুপারিশ না করলেও কবিতার একটি নৈতিক প্রভাব আছে; কারণ নৈতিকতা হচ্ছে শুধু মানস জীবনের উন্নততম এবং সুন্দরতম রূপ এবং মনের প্রাণশক্তি নিহিত এর কল্পনাশক্তির মধ্যে। কাব্য এই কল্পনাশক্তিরই পরিপোষণ করে। কাব্যে আমরা সেই পৃথিবীতে বাস করি যেখান থেকে বস্তুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা এবং কর্মের নৈতিকতা উদ্ভূত হয়।”
কাব্য ব্যক্তিগত হওয়া না চাই, যখন কাব্য হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত তখন তা সমাজ মানসে প্রচুর অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ হয়। কিন্তু কাব্যে, কবিতায় কবি তার নিজ ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নৈতিকতা রসে সিক্ত করে প্রকাশ করেন তখন তা গোটা মানুষের অনুভূতির রূপ নেয়। দিবসের রবির কিরণ, রজনীর স্নিগ্ধ জোৎস্নার ধারা, মেঘ-মালার বারিপাত, ঘাসের মাথায় জমেওঠা শিশির, বিন্দুর গভীর প্রাণের রস যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য শোভায় অপূর্ব বিকাশ ঘটতে পরে, তেমনি সংগীত, শিল্প সাহিত্যের মাঝে নৈতিকতাবোধের পুণ্য প্রবাহ ও একটি জাতির উন্নতি, স্থায়িত্ব ও সংস্কৃতিতে একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে। আমাদের সাহিত্য নৈতিকতার উপাদান হতে বঞ্চিত হয়ে কত বড় শূন্যতার মুখোমুখি তা আমরা অনুভব করতে সক্ষম নই।
সাহিত্যে নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা আছে তাই বলে যদি সাহিত্যে নৈতিকতার নামে ধর্মীয় পুস্তক রূপে গড়ে ওঠে তা হলে সাহিত্যের অপমৃত্যু ঘটবে। সব সাহিত্যে নৈতিকতার ছাপ থাকবে বলে সব যায়গায় ধর্মীয় নির্দেশ -নিষেধের বাণীর বজ্র নির্ঘোষ ধ্বনি বেজে উঠতে হবে তা নয়। কারণ “ধর্ম নৈতিকার মৌল ভিত্তি হলেও ধর্ম ও নৈতিকতা এক জিনিস নয়। নীতিগতভাবে ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা অস্তিত্বহীন কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নৈতিকতা ধার্মিকতার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ধরে রাখে যে নিয়ন্ত্রক শক্তি তা সভ্যতর জগতের। কাজেই একদিকে যেমন ধর্ম ও নৈতিকতা স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন আর একদিকে তাদের রয়েছে আন্তনির্ভরতা। ধর্ম এক ধরনের জ্ঞান এবং নৈতিকতা হল সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার জীবনের অনুপ্রেরণা। কিভাবে চিন্তা ও বিশ্বাস করতে হয় ধর্ম সে প্রশ্নের উত্তর, কিভাবে আকাক্সক্ষা ও লক্ষ্যবিন্দু নির্ধারণ করতে হয় এবং কিভাবে জীবন যাপন করতে হয় সে প্রশ্নের উত্তর হল নৈতিকতা। অন্য কথাায় ধর্ম হলো বিশ্বাস, নীতি হল কর্ম। (৬)
মানব জীবনের প্রধান আলম্বন সাহিত্যের স্থায়িত্বের মূল সুর নৈতিকতা তথা নীতি চেষ্টাকে কেউবা সাহিত্যিকদের জন্য বড় আপদ মনে করেন। তাই আর্টের দোহাই দিয়ে সাহিত্য থেকে নীতির ইঙ্গিতটুকু সযত্নে মুছে ফেলতে চান। তবুও নীতি নৈতিকতা তার নিজস্ব শক্তিবলে কল্পপন্থার (Romanticism) কল্পনারাগে রঞ্জিত হয়ে, বস্তুপন্থার (Realism) বাস্তব চিত্রে বিচিত্র হয়ে শ্রেয়পন্থার (Idealism) রূপ নিতে সক্ষম হচ্ছে। সাহিত্যে জীবন-সমাজ-জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্ত কল্পনার উত্তাপে বিগলিত হয়ে সূক্ষ্ম সুকুমার বৃত্তি জন্মলাভ করে, তার মধ্যে যদি জগৎ সংসারের কল্যাণরূপী নৈতিকতার ছায়াভাসটি ফুটে ওঠে তখন ঐ সাহিত্য মানব পরিত্রাতার আসন দখল করতে সক্ষম হয়।
আমরা অনেক সময় নৈতিকতার আদর্শ হিসেবে মিষ্টিসিজমকে গতিশীল সাহত্যের পরিণত অবস্থার সামগ্রী ধরে নেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে “মানব-মন জড়ত্বের ভারে পিষ্ট এবং জীবনসমস্যায় ক্লিষ্ট হইয়া দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতা হইতে মুক্তি মাগিয়া অবার সাহিত্যে অজানা রাজ্যের লঘু কল্পনার আবাদ করে ইহাই মিষ্টিসিজম”(৭) অর্থাৎ ‘মিষ্টিসিজম’ হচ্ছে পরিণত বয়সের রোমান্স। কিন্তু নৈতিকতা শুধু ‘মিষ্টিসিজম’ এর মধ্যেই নয় বরং ‘কল্পপন্থা’, ‘শ্রেয়পন্থা’ ও ‘অলেকপন্থা’-এর সর্বস্তরে সমানভাবেই প্রবাহিত হয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারে। (চলবে)