আশরাফ আল দীন একজন নীরব কবির গল্প

সোলায়মান আহসান
আজকাল সাহিত্যাঙ্গনে ‘কেশে’ জানান না দিলে অস্তিত্ব নাকি লোকান্তরিত থেকে যায়। তাছাড়া নিয়মিত পত্র-পত্রিকা-সাময়িকীতে হাজিরা না দিতে পারলে ইস্কুলের নিয়মে মাইনে দিতে না পারার কারণে নাম কাটা যাওয়ার মতো লেখকও বাদ পড়েনÑহিসেবের খাতা খেকে। শুধু লেখা প্রকাশ নয়, ফি বছর গ্রন্থ প্রকাশও একটা অনিবার্য শর্তÑ লেখক পদবাচ্য হওয়ার জন্য। অন্যথায় লেখক বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যান।
তাছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, যে যার লেখার মূল্যায়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন। গ্রন্থ প্রকাশ হলে (প্রকাশের ব্যবস্থা করে) লেখক যত্মসহকারে সেই গ্রন্থ পত্র-পত্রিকায় কিংবা সুধি লেখক সমাজে পৌঁছে দেয়ার এক রেওয়াজ চালু হয়েছে। কিন্তু সেই গ্রন্থ প্রাপ্তি সংবাদ কিংবা গ্রন্থালোচনা কোনো কিছুই ঘটবে না। যদি লেখক তার গ্রন্থের ওপর নিজে আলোচনা করিয়ে (এক্ষেত্রে কখনও লেখক তার গ্রন্থের আলোচনা নিজে লিখে অন্য কারু নামে চালিয়ে) দিলে গ্রন্থালোচনা ছাপা হয়ে থাকে।
ইদানীং মোবাইলের যুগে ‘ফেসবুক’ আরেক প্রচার মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে। যারা ‘ফেসবুকে’ নিয়মিত ‘ফেইস’ দেখাতে পারেন (লজ্জার মাথা খেয়ে) তারাও লেখক হিসাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
এই যখন পরিস্থিতি, স্বল্পপ্রজ লেখকদের কে আর মনে রাখে কষ্ট করে! কে মূল্যায়ন করে তাদের সৃষ্টিরÑএকান্ত স্বার্থবুদ্ধি যদি না থাকে! আর স্বার্থ উদ্ধারে লেখকের সক্ষমতা এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় বটে! যেমন অনেক লেখক পত্রিকার সম্পাদকÑ তিনি একজন সক্ষম ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত। তাঁর হাতে লেখা প্রকাশের ক্ষমতা থাকায়Ñ লেখক প্রকাশক তাঁর লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হন। আবার কোন লেখক বড় আমলা, অর্থশালী কিংবা ক্ষমতাবানÑতাঁর ব্যাপারেও প্রকাশক, লেখক, সম্পাদকগণ আগ্রহী হয়ে থাকেন।
কিন্তু এসব স্বার্থ উদ্ধার যখন হবার নয়, এমন লেখককে কে ‘পুছে’! ফলে আমাদের এই পোড়া দেশে অনেক সৃষ্টিশীল কবি-লেখক কালের এই কুটিল পাঁকে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন। সে রকম একজন কবি-ব্যক্তিত্ব (অন্য অভিধায়ও পরিশ্রুত) আশরাফ আল দীন (১৯৫৪)।
কর্মজীবন কেটেছে কঠিন সামরিক অঙ্গনে- নিয়মতান্ত্রিকতায়। দেশে এবং বিদেশে। নানা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে কিভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর প্রিয় ‘সাহিত্যচর্চা’ সে আরেক অধ্যায়। সেদিক যাবো না। শুধু সাধুবাদ জানাব।
তাঁকে নিয়ে নানা মত জনান্তিকে-তিনি সত্তর না আশির কবি। দশক বিভাজনে ফেলে লেখক-মূল্যায়ন একটা প্রচলিত প্রক্রিয়া বটে-উপেক্ষণীয় নয়। তবে কালের ঝড়ো বাতাসে দশক উড়ে যায়, লেখক দাঁড়িয়ে থাকেÑতাঁর সৃষ্টির গ্রহণযোগ্যতার ওপর।
আমার বিবেচনায় আশরাফ আল দীনকে সত্তর দশকের কবি হিসেবে দাঁড় করানো যায় নির্দি¦ধায়। একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। আমরা যখন মধ্য সত্তরে তুমুলভাবে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত, ষাটের অন্যতম কবি আফজাল চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেটে ‘সংলাপ’ নিয়ে সাহিত্য-সংঘবদ্ধতায় সচকিত, চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো একটি যৌথ কাব্যপ্রয়াস ‘লৌকিক অলৌকিক’ এর মাধ্যমে আশরাফ আল দীনের সঙ্গে সংযোগ। সেটা ১৯৭৮ এর কথা। তখন গ্রন্থ প্রকাশ তত সহজ ছিল না। ঋদ্ধমান কবিরাও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য হা-পিত্যেশ করতেন। চাঁদা তুলে কবির গ্রন্থ প্রকাশের ঘটনাও সেসময় ঘটেছে। তাই চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘লৌকিক অলৌকিক’ কাব্যগ্রন্থে ৬জন কবির গুচ্ছ কবিতা স্থান পেয়েছিল। আলোচিত কবি ওই ছয় জনের একজন। তখন নাম ছিল জি.র মো আশরাফ।
আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। সেখানে অবস্থান করে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখা অসম্ভব প্রায়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও চালিয়ে গেছেন মনের খোরাকÑসাহিত্যকে। প্রকাশ করেছেন একের পর এক কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন নামে- যে নামে তিনি এখন অভিষিক্ত।
উল্লেখনীয়, তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল পদমর্যাদায় থাকা অবস্থায় নিয়মমাফিক ২০০৬-এ অবসরে যান। তিনি জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে (২০০১-০২) বাংলাদেশের সেনা কন্টিনজেন্টের আফ্রিকার সিয়েরলিওনে দায়িত্ব পালনকালে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় একটি হাত হারান। এতদসত্বেও তিনি লেখা থেকে বিরত থাকেননি।
তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পরাজিত করতে পারেনি, হতদ্যোম হননি কোন ভালো কাজ হতে।
এরপরও চার (৪) টি কাব্যগ্রন্থসহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কমপক্ষে ৯টি। কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে-
১ নির্জন এসেছিল আজ (১৯৮৭)
২ রাত বাড়তে থাকে (১৯৯০)
৩ কষ্টকথা (২০০৪)
৪ পড়ন্ত বিকেল (২০০৯)
এছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমনÑ ছোটদের ছড়া, রূপকথা, শিশুশ্রম, ভ্রমণকাহিনী, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কবিতার ওপর সামান্য আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো। প্রকৃতপক্ষে কবিতার ওপর মন্তব্য করা কঠিন বিষয়। একান্ত দায়ে না পড়লে এবং বুদ্ধি বিভ্রাট না ঘটলে কবিতার ওপর কেউ লিখতে যায় না। আল মাহমুদের ভাষায়Ñআমি কবিতা লিখলেও কবিতা বুঝি না। আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষায়Ñঘরের চাকর-বাকরদের দিয়ে কবিতার আলোচনা লেখাতে হবে। আর শামসুর রাহমানের ভাষায়- আমি সাধারণ পাঠকের জন্য কবিতা লিখি না।
তার মানে কবিতা নিয়ে কিছু লেখালেখির দায় বা কিছু বলার সাহস রাখেন এমন লোকের সংখ্যা কম। বর্তমান কালে আরও কম। কেউ চায় না অন্যের জন্য এ পরিশ্রম করতে। অন্যভাবে বলা যায়Ñসম্পর্ক সাধু রাখতে চায় সর্বতো।
প্রকৃত পক্ষেই কবিতা এক জটিল শিল্প। কবি নিজেও কবিতা সম্পর্কে ঠিকঠাক বলতে পারেন না। এ জন্য জনৈক সাহিত্য সমালোচক কবিতাকে ‘রহস্যময় নারী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। হলে কি হবে, তা বলে কবিতা নিয়ে কম কথা হয় নাÑকতো বিশ্লেষণ, কতো আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা চলে দিনের পর দিন। শেষ হয় না কবিতা নিয়ে কথা বলা। কবিতার অন্তর্গত বিষয় ও শরীরের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া ভার। এখন জটিল জীবনের আবর্তে মানুষের বোধ ও উপলদ্ধি এতো বেশি দ্বান্দ্বিক ও পৌনপুনিক রহস্যপ্রিয়Ñগুরুভারে পীড়িত যা উদঘাটন মানবÑসাধ্যের বাইরে।
আইরিশ ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য সমালোচক লরেন্স স্টিয়ার্ন (Lawrence Sterne, 1713-1768) এটাকে বলেছিলেন-“Gravity, a mysterious carrage of the body to conceal the defect of the mind..”
আর আমাদের মধুসূদন দত্তের (১৮২৮-১৮৭৩) ভাষায়-
কবির চিত্ত-ফুলবন মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
(মেঘনাদ বধ)
কবিতা কোথায় সৃষ্টি হয়, কখন কিভাবে হয়, কোন সময় ও পরিবেশে হয় তা যেমন কোনো ঠিকঠাক ঠিকানা নেই- তেমনি কবিতার-আত্মা (Poebry-soul) কোথায় থাকে কার দেহে বাসা বাঁধে তার হদিস আজতক কেউ পায়নি। হ্যাঁ, অন্ধের হাতি দর্শনের মতো কিছু বিবরণ কেউ কেউ দিয়েছেনÑ যা অসম্পূর্ণ অসঙ্গত এবং ভ্রান্তিবিলাস বৈ কিছু নয়। তাহলে কি কবিতা চিরদিন অনুদঘাটিতই থেকে যাবে? না, তা কেন সে রকম সম্ভবনা কম। পুরুষের কাছে নারী যেভাবে চিরদিন আগ্রহ ও আতিশয্যের আধার-কিন্তু চির রহস্যময় বলে পরাজয় যার সম্ভাবনাÑ তেমনি কবিতাও কবিতাপিয়াসীর কাছে আগ্রহের বিষয় হয়ে চর্চিত হতে থাকবে।
ভূমিকাংশে একটু বেশিই কথা বলা হলো। হয়তো কবিতা ও কবি নিয়ে আলোকপাতের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। আমার মনে হলো এসব কথাও বলা জরুরি।
আগেই বলেছি দশক বিচারে আশরাফ আল দীন সত্তর দশকের কবি-প্রতিনিধি হওয়া সঙ্গত। সত্তর দশক মানে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা উত্তর দশক। একদিকে যুক্তিযুদ্ধের হারানো, ধ্বংসের বেদনা, অপর দিকে মুক্তিলাভের উচ্ছ্বসিত আনন্দ ভরা হৃদয়। সবকিছুর মতো কবিতায় তেমন চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়নি এ দশকে।
তবে সত্তর দশক একেবারে নিস্ফলা ছিল না। এ দশকেও একঝাঁক কবি আমরা পেয়েছি এবং এঁদের বেশ কয়েকজনের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের কবিতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে।
এঁদের কয়েকজন- আতাহার খান, আবিদ আজাদ, আবু করিম, ময়ুখ চৌধুরী, মাসুদুজ্জামান, মাহবুব বারী, মাশুক চৌধুরী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, শিহাব সরকার, হাসান হাফিজ, সোহরাব হাসান প্রমুখ।
তালিকায় আরো অনেকের নাম সংযুক্ত করা যেতোÑসেটা আমার বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। সত্তর দশকের এক নীরব কবি আশরাফ আল দীন প্রতিপাদ্যÑযিনি নানা কারণে এই দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। ত্রিশের কবিদের মধ্যে যারা ড্রাইভিং সিটে থেকে কবিতাকে রাবীন্দ্রিক ধারা থেকে মোড় ঘোরাতে পেরেছিলেন- সেসব কবিদের প্রভাব পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। শামসুর রাহমানের কবিতায় জীবনানন্দীয় প্রভাব বেশ প্রলম্বিত ছিল। পঞ্চাশের অন্য কবিদের মধ্যেও কমবেশি ত্রিশের কবি, পশ্চিমা অথবা মার্কিনী কবিদের প্রভাব বেশ লক্ষ্যণীয়। ষাটের কবিদের মধ্যেও এ প্রবণতা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যূররিয়ালিস্ত (পরাবাস্তববাদ) ধারার কবি হিসাবে তিনি প্রমাণ করতে এ ধারার কবিতা লিখেছেন। কিন্তু সত্তরের দশকে একটা লক্ষ্যহীন লাগামছাড়া কবিতার তরী বেয়ে চলার ভাবসাব পরিলক্ষিত হয়। কবিতার ছন্দ এঁদের কাছে বাড়তি ঝামেলা মনে হতে থাকে। ফলে ছন্দহীন কবিতার ঝড় বয়ে যায়। এরমধ্যেও দু’চার জন কবি কবিতার পরম্পরা অস্বীকার করেননি। আশরাফ আল দীন এঁদের একজন।
আশরাফ আল দীন ছন্দের ব্যাপারে গোড়া থেকেই ছিলেন সচেতন। তেমনি তাঁর কবিতায় জীবনের মৌল উপাদান-বিশ্বাস, জীবন-দর্শন, মানব-ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, প্রাত্যহিকতা, প্রেম এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি ভালোবাসা-অত্যন্ত সহজভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কবিতা টেকনিক নির্ভর নয়Ñবিষয় প্রধান। তাঁর কবিতায় যে জীবন হয়তো আড়ালে পড়ে থাকে, দেখা যায় কম-তাকে তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। কাব্য-প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আবেগ-অনুপ্রেরণালব্ধ উচ্চারণÑএটা আশরাফের কবিতায় পরিপূর্ণই ধরা দেয়।
সত্তর এবং আশির দশকে একটা বিতন্ডা ছিল ‘আধুনিক কবিতা’ নিয়ে। অনেকে তাচ্ছিল্যভরে বলতেন- আধুনিক কবিতা দুর্ভেদ্য, বুঝি না। আধুনিক কবিতা, আবার কবিতা ? সেসব বাদানুবাদ, আলোচনা-সমালোচনা, ঘাত-প্রতিঘাতের বাতাবরণ এখনও চলছে না-এমন নয়। এ-ই বিতর্ক অন্তত ৭০/৮০ বছর ধরে চলছে। এ বিবাদ-বিসম্বাদের কোনো নৈয়ায়িক ভিত্তি নেই, এ কথা কিন্তু বলছি না। নদী বাঁক নেয় বলেই স্রোত ওঠে- স্রোত আছে বলেই নদীর ভাঙ্গা-গড়া আছে। জীবনের সঙ্গে নদীর সমিল খুঁজে পেয়েছিলেন ইংরেজ কবি রুপার্ট ব্রুক (Rupert Brooke)-নদীকে তিনি জীবনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। জীবন যেমন বয়ে যায়। তেমনি নদীও চলমান। সময় কখনও বাধা হয় না।
সাহিত্যের এমন চলার ইতিহাস আছে। ঋজু নয়, বিসপির্ল এবং চড়াই-উতরাই পথে। পাঠক বা কাব্যভোক্তারা অনেক সময় তা ঠাহর করতে পারেন না। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বসেন- কোথায় রবীন্দ্র-নজরুল তো পড়ে আমরা বুঝি! না, রবীন্দ্র-নজরুল কাব্যসম্ভার এতো সহজবোধ্য নয়! ছন্দোবদ্ধ বলে এর দোলা আমাদের প্রাণে এসে আঘাত করে। যেভাবে ভিন ভাষার, রাগনির্ভর গানের কথা না বুঝলেও সুরটা হৃদয়ে লাগে। আত্মবিমোহিত করে রাখে। শ্রবণসুখ পাওয়া যায়।
আশরাফ আল দীন এসব ব্যাপারে ভীষণ টনটনে। বুঝে সুঝে তিনি কবিতার পথ রচনা করেছেন। সে আলোচনায় প্রবেশ করব। আশরাফ খুব বেশি কবিতা লিখেননি। অন্তত আমার গোচরে আসেনি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সমুদয় কবিতার সংখ্যা ১৯৬। আর গ্রন্থ প্রকাশের ধারাও বেশ দূবরর্তী। যেমন- প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নির্জন এসেছিল আজ’ ১৯৮৭ তে প্রকাশের পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ৩ বছর অপেক্ষা ‘রাত বাড়তে থাকে (১৯৯০), তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘ ১৩ বছরের ঘুমঘোর কাটিয়ে ‘কষ্টকথা’ (২০০৪) এবং চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ৫ বছর অপেক্ষার পালা শেষ করে ‘পড়ন্ত বিকেল’ (২০০৯) আত্মপ্রকাশিত।
অবশ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দীর্ঘ বিরতি কিংবা কবিতার সংখ্যাল্পতা কাব্যমান বিচারের মানদন্ড নয়। তাছাড়া তিনি শুধুই কবিতা লিখেছেন এমনটাও নয়। বাংলা সাহিত্যে এমন বহু বড় কবিদের আমরা পেয়েছি (তখন প্রকাশনা দুরূহ ছিল) যাঁদের কবিতাগ্রন্থ জীবদ্দশায় ৪/৫টির বেশি বের হয়নি। সেটি আরেক বিশ্লেষণ।
আশরাফ আল দীনের ব্যাপারে সোজাসাপ্টা একটা মন্তব্য করা চলে Ñতিনি পরিচ্ছন্ন মেজাজের কবি। সাহিত্য তাঁর কাছে জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বটে, একমাত্র নয়। তাঁর কাব্যমেজাজ এবং বাস্তব জীবনের সংঘাত ‘কাব্যচর্চাকে’ খানিকটা ব্যাহত করেছে, বিরত রাখতে পারেনি। সামগ্রিক জীবন নির্বাহে মৌলিক দর্শন রয়েছে। সেটা সরাসরি বললে হয়তো বলা যাবেÑইসলামী দর্শন। না, আমি তা বলব না। সব কিছুর মধ্যে ‘ইসলাম’ লেবেল লাগিয়ে দিলেই সুচিহ্নিত হয় না বিষয়। ইসলামের আওতা সম্পর্কেই আমাদের ধারণা (অধিকাংশের) স্বচ্ছ নয়। ‘দীন’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে পারলে আমরা ইসলামী দর্শনের আওতা খুঁজে পাবো। তখন পৃথিবটিা অনেক বড় মনে হবে।
আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) তাই বলেছিলেন-
স্থানের গন্ডিমুক্ত মানুষের স্বাধীন মানস
প্রভাত বায়ুর মতো গতিশীল সমীরণ সৃষ্টি করো
তোমার পাষাণ চিরে নির্গত হোক সহস্র প্রব্রণ
খুদীর সমুদ্রে ডুবে কলীমের আঘাত সৃষ্টি করো।
উর্দু সাহিত্যের আরেক দিকপাল (যিনি গোলাম আলীর কণ্ঠে গীত গজল ‘চুপকে চুপকে’র জন্য খ্যাত) আজাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মওলানা হাসরত মুহানীর (১৮৭৫-১৯৫১) চিন্তাধারা এবং জীবনদর্শনও ছিল দিগন্ত প্রসারী। আজ থেকে শত বছর আগে তিনি নিখিল ভারতের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব করেছিলেন। কংগ্রেস সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে তিনি হতোদ্যম হননি। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে মানুষকে জাগিয়ে তোলেন। ‘উর্দুয়ে মোয়াল্লা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। মানুষের কাছে পৌঁছে দেন প্রকৃত আদর্শ চিন্তা।
এতোসব কথা আলোকপাত করলাম-একজন কবি কখনও সংকীর্ণ গন্ডিতে শ^াস নিতে পারেন না। তাতে তাঁর চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। আল্লামা ইকবাল ‘পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা’ ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের কেউ ছিলেন না। জিন্না ইকবালের দর্শন (স্বপ্ন) বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন মাত্র। মওলানা আবুল কালাম আজাদ সারা জীবন কংগ্রেস করেছেন, কিন্তু মুসলমানদের স্বার্থ বিক্রি করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। যে কারণে তার জীবনীমূলক গ্রন্থ India wins freedom এর ৩০ পাতা ত্রিশ বছর পর প্রকাশের শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। সেই অপ্রকাশিত ৩০ পাতায় কি আছে? আমরা পড়ে দেখেছি ? দুর্ভাগ্য, ইতিহাসের এসব সর্পিল পথে হেঁটে আমরা খুঁজি না প্রকৃত সত্য এবং ইতিহাসের শিক্ষা। কখনও একজন কবি যখন স্বীয় পঙ্ক্তিতে সত্য উচ্চারণ করেন, আমরা কবির মতিভ্রম আন্দাজ করি।
একজন কবির ভেতর যেসব গুণ থাকা আবশ্যকÑআশরাফ আল দীনের মাঝে আছে। তবে আর সব সৃষ্টিশীল বিষয়ের মতো কবিতাও একটি জটিল প্রক্রিয়া। শিল্পী যদি গলার চর্চা, সঙ্গীত সাধনা ছেড়ে দেন বা বিরতি দেনÑতবে তার কন্ঠ গান গাওয়ার জন্য উপযুক্ত থাকে না। তেমনি কবি-সাহিত্যিককেও লেগে থাকতে হয়। নিমগ্ন থাকতে হয় সাহিত্য চর্চায়। প্রতিদিন নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হয়। পঠন-পাঠন এবং চর্চার মধ্য দিয়ে শাণিত করতে হয়। প্রতিভা আছে, এমনিতেই হয়ে যাবে। এটা ভ্রান্ত ধারণা।
আশরাফ আল দীন অবশ্য কবিতা চর্চা থেকে নিজেকে কখনও সরিয়ে নেননি। কিন্তু নানা কারণে লেগেও থাকতে পারেননি। যে কারণে তাঁর কবিতার ভেতর উৎক্রান্তির ধারা খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে নেমে পড়ার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়, পরবর্তীতে শ্লথগতিই যেনো দৃশ্যমান।
আশরাফ আল দীন ‘রোমান্টিক’ কবি। কবি মাত্রই তা হয়ে থাকেন। তবে আশরাফ আল দীনের রোম্যান্টিসিজম শুধুই ‘নারী প্রেম’ এর দ্বারা তাড়িত নয়। নারীর প্রতি প্রেম আছে, দায়িত্ববোধও তিনি অনুভব করেন। একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
ঃ কলতলাতে সব জমানোÑনিথর নীরবতা ;
যখন হলি রূপের আধার চপল হল চাল
কলতলা তোর পর হল ওই জীবন হল কাল।
(কলতলা ও উপমাবিশেষ, নির্জন এসেছিল আজ)
আরেকটি-
তুমি ভীষণ অভিমানী।।
আমার কথায় রাগ করেছো জানিÑ
নন্দিনী হে,
বুঝলে না’তো
এ সংসারে প্রথামতো’
বেতস-লতা, মাটির সুবাস
ফুলকুমারী, মেঘ ও বাতাস
(তুমি, নি.এ.আ)
একটি কবিতায় জীবনানন্দীয় প্রভাব বেশ প্রকট ধরা পড়ে।
উদ্ধৃতিÑ
শুভ্রা ! তুমি যেও না। যেতে যেতেই হারাবে পথে
তারপর কোনদিন পাবেই না আর ঠিকানাটি খুঁজে।
আমি তো’ মুখ বুজে খাস্তা ওঠা সস্তা কোন জরাজীর্ণ
দালানের কোণে পড়ে থাকবো অপলক স্থির
(জীবনের প্রতিকূলে, নি.এ.আ)
এটা অবশ্য শুধু আশরাফ আল দীনের ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষণীয় তেমনটি নয়, ত্রিশের দশকের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশের প্রভাবভুক্ত ছিলেন পরবর্তী দশকের অনেকেই। এছাড়া রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত বাংলা কবিতার যে নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন পঞ্চপান্ডবখ্যাত কবিগণ, তাঁদের প্রভাবও সুদূরপ্রসারী হতে দেখি।
আশরাফ দেশ-সমাজ ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব অনুভব করেন। ঘুরে ফিরে তিনি সেই দায়িত্ব বোধের উচ্চারণ কবিতায় করেছেন। কখনও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার ভেতর তিনি দেশের ঘটনা প্রবাহ, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মিলিয়ে ভাবতে চান। উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
১.এরাই কি বর্গী সেজে প্রাচুর্যের লোভে
গিয়েছিল একদিন আমাদের দেশে,
ধন লুটে ঘর পুড়ে ইচ্ছেমতো মেরেছিল লোক
তছনছ করেছিল বাংলার সবুজ গ্রামগুলো।
(দেওলালী, রাত বাড়তে থাক)
২. যদি কেউ হায় গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে
সবগুলো পুরাতন নাম মুছে লিখে দেয়
আপন পিতার বা দলীয় কোন নেতার নাম,
(নাম প্রসঙ্গ, পড়ন্ত বিকেল)
কবিতা তো ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ! কিন্তু সেই ব্যক্তিগত অনুভূতিই যখন সমষ্টির মনের খোরাক হয়ে যায়, তখনই কবিতা হয় মানুষের। যেটাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেনÑনিজের অনুভূতিকে অন্যের করিয়া দেওয়া। কিন্তু এ কাজটি যদি সচেতনভাবে করতে না পারেন, কবিতা ক্ষুণœ হয় পদমর্যাদায়।
আশরাফের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো কবিতায় রূপ দিতে চেয়েছেন সাহজিকভাবে। কখনও সেই অনুভূতিগুলো পাঠকের মনে দোলা লাগা স্বাভাবিক, কখনও নাও লাগতে পারে।
উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
১. কবি তাকে বিপুল আবেগে পরী সাজাবে কি
কবিকে সে রুখে দাঁড়ালো রমণীয় দোষে!
এখন, পরীহীন পৃথিবী শুধু যুদ্ধের সাজে সাজে
(কবি কাহিনী, কষ্টকথা)
২. কবিরা প্রবাসে এলে ভুল করে কেউ
কখনো লিখতে বলো না কবিতা বা কাহিনী
তাদের আঁকতে বলো না ছবি, কখনো না।
কেবল তোমরাই যতœ করে সবিস্তারে লিখে
সঘন চিঠি দিও আর কবিদের পাঠানো
চিঠির পাতাগুলো আলগোছে রেখে দিও
(কবির প্রবাস, কষ্টকথা)
আশরাফ আল দীনের চারটি কাব্যগ্রন্থে হৃদয় ছোঁয়া অনেক কবিতা রয়েছে। তিনি সহজ সরলভাবে লিখেন। দুর্বোধ্যতা নেই। চাতুরী নেই, নেই তেমন মেদ তাঁর কবিতায়।
আবার জীবনানন্দ দাশের কাছে ফিরে আসি। আমরা প্রায়শ জীবনানন্দের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করিÑ ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; ।’ এরপরের অংশটুকু বলি না। পরের অংশে তিনি বলেছেনÑ ‘ কবিÑ কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব-নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে।”
সেই বিচারে আশরাফ আল দীন একজন পরিপূর্ণ কবি। শুধু প্রয়োজন তাঁর ‘নব-নব কাব্য-বিকিরণ ’ ঘটালো।